“নবীন ধান্যে হবে নবান্ন”। কিন্তু তার প্রস্তুতি-পার্বণ কবে? নবান্নের প্রস্তুতি কার্তিক পেরোলে। কারণ খনার বচন আছে, “বেদের কথা না হয় আন, তুলা বিনা না পাকে ধান।” ‘বেদ’ বা জ্ঞানের কথা হল, শালিধান পাকবে তবে নবান্ন। আর ‘তুলা’ বা কার্তিক মাস না গেলে ধান পাকে না। তাই নবান্নের আনুষ্ঠানিকতার সূত্রপাত কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রাণের পয়লা তারিখে৷
অঘ্রাণের পয়লা মানেই শালিধান্যের ক্ষেত্র-উৎসব। আগের দিন কার্তিক সংক্রান্তিতে নবান্নের দেবতা ‘নবানে কার্তিক’-এর পূজা-আরাধনা হয়ে গেছে। লোকসমাজে কার্তিক শস্যরক্ষার দেবতা বলে কথিত, বিশেষত কাটোয়া মহকুমা, উত্তরবঙ্গের কোচবিহার প্রভৃতি অঞ্চলে। মাঠে মাঠে সোনালি ফসল তখন ধান্যলক্ষ্মী হয়ে ভূমিলক্ষ্মীর পদতলে ধরা দিয়েছে। এবার ‘আকবোল ধান’ (যে ধান আগে থেকেই লক্ষ্মীপূজার জন্য নিবেদিত হবার জন্য ঘোষিত) ‘মুঠ’ করে গোছ সমেত কেটে গৃহে আনার দিন। চাষীর ভাষায় ‘মুঠ আনা’। শ্রমজীবী মানুষের কাজে যেন ধরণীর ‘নজরানা’! গ্রামের গৃহস্থ পুরুষ এদিন মাথায় করে লক্ষ্মীকে ঘরে আনবেন।
গৃহস্থ তাই ভোরের স্নান সেরে নব বস্ত্র পরিধান করেছেন৷ হাতে কাস্তে, মাথায় গামছার উষ্ণীষ, কোমরেও গামছা, খালি পা। ঈশাণ কোণে গিয়ে তিনি আড়াই আলুই ধান কেটেছেন আড়াই প্যাঁচে তা পরম যত্নে বেঁধেছেন, “মাগো, তোমার কৃপা যেন জন্ম জন্মান্তরে পাই। সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার ভাত দিও মা। মাগো, অন্নলক্ষ্মী।” তার আগে কার্তিক অমাবস্যায় বাঁধনা পরবে গো-বন্দনা অনুষ্ঠানে গো-মাতার আশীর্বাদ নিয়েছেন চাষী, সন্তানের মুখে দুধের যোগান হোক। গোয়ালঘরে বখনা বাছুর আসুক।
‘মুঠ-ধান’ মাথায় নিয়ে গৃহে এসেছেন কৃষক। এ দেবতার আশিস। গৃহে লক্ষ্মীর আসন, উঠোনে-গোলাঘরে শস্যরূপা দেবী। আজও কলাবউ সেজে উঠেছেন। আটনে-উঠোনে-মরাইয়ে আজ মাঙ্গলিক পূজা। ময়মনসিংহগীতিকার কথা মনে হচ্ছে
“পাঞ্চগাছি বাতার ডুগুল
হাতেতে লইয়া।
ধানের গাড়ি মাঠ থেকে ঘরমুখো
মাঠের মাঝে যায় বিনোদ
বারোমাস্যা গাহিয়া।।”
এইবেলা পয়লা অঘ্রাণ থেকে শুরু হল ধান কাটার অনুষ্ঠান। এদিন থেকে কৃষকের ব্যস্ততা। নতুন ফসল উঠবে। একসময় ‘অগ্রে’ থাকা বাৎসরিক সময় মানেই ‘অগ্রহায়ণ’ বলে বিবেচ্য হত। অঘ্রাণেই শুরু পঞ্জিকার গণনা। বছরও শুরু, ধানও গোলায় আসছে।
ধান তো শুধু আমাদের আহার নয়, ধান আমাদের লোকায়তিক সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি। গোলায় ধান ভরে উঠলেই গলায় গান আসে! অর্থনীতির পুরোটাই তখন ধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত। সে আমন ধান, সেটাই শালিধন্য। আষাঢ়ে শুরু, আর কার্তিকে শেষ। এরপর ধানকাটা সারা হলে মাঠ বিষণ্ণ বিধবা।
দিকে দিকে মুনিশের হাঁকডাক আর মেসিনের ঘর্ঘর শব্দ। ধান উঠে জমি খালাস হবার অঘ্রাণ মাস এলো। সকাল থেকে সন্ধ্যে, মাঠের দেবতার সংস্পর্শে হাত পবিত্র হয়ে ওঠে কৃষি মজদুরের। মা লক্ষ্মী আশীর্বাদ করেন তাদেরও, শ্রমের বিনিময়ে আহারের সংস্থান হোক তাদের। তাই জুতো পায়ে জমিতে নয়, ভূমি স্পর্শ করে, মাথায় ঠেকিয়ে ভূমিকে ঢোকা। মোদের ধানই মোদের মান।
মুঠ-আনা ধানের গোছাই পুজো হবে নবান্নে। এরই মধ্যে ধান কাটা চলবে, মরাই পূর্ণ হবে, দেবী অন্নপূর্ণা কৃষকের বাস্তুতে অধিষ্ঠান করবেন। মা আর মেয়ে; দেবী দুর্গা আর দেবী লক্ষ্মীর যুগপৎ আশিস সঙ্গে নিয়েই নবান্ন খাওয়া হবে৷ এই খাদ্যের জন্য বিশ্বের অজস্র যুদ্ধ, লড়াই, ছলনা-প্রতারণা। গরীব কৃষক সকলকে খুশি করে তবেই নিজের ধানটুকু রাখতে পেরেছে। নবান্নের পশ্চাতে তার সংগ্রামের
এক দীর্ঘ অধ্যায়। নলপুজোতে মা-লক্ষ্মীর ‘সাধ-ভক্ষণ’ করিয়ে ‘ধান ডেকে’ যে আশার আলো আশ্বিন সংক্রান্তিতে দেখেছিলেন কৃষক, তাই আজ সোনালী সন্তানে বাস্তব হয়ে উঠেছে মুঠপুজোয়। মুঠোর মধ্যে আজ ধান্যকন্যা।
রজত বিশ্বাস এবং কল্যাণ চক্রবর্তী।