মা-টি। তিনিই মা, তিনি বসুন্ধরা-ধরিত্রীর সুবিস্তীর্ণ গর্ভ। মাটির গর্ভে ফসলের জন্ম, তাই তিনি গর্ভধারিণী। মৃত্তিকা জননীর নিভৃত নিলয়ে সৃষ্টি ও বিকাশের অব্যাখ্যাত ও অব্যাহত গতি চিরকালীন। সুতরাং মাটিও মা; ফসল নিয়ে আবির্ভূত পৃথিবী এক মাতৃদেবী। মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা থেকে প্রাপ্ত মাতৃদেবী-মূর্তি ভারতবর্ষের মাতৃমূর্তির প্রাকরূপ; তা ছিল পৃথিবী মূর্তি — সেখানে একটি মূর্তির ক্রোড়দেশ থেকে একটি গাছকে বের হতে দেখা যাচ্ছে। মাটি বা পৃথিবী প্রাণশক্তি ও প্রজনন শক্তির প্রতীকরূপে আদিম কৌম সমাজের আরাধ্যা ছিল। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রবাদী মানুষ যে ভারতমাতা ও বঙ্গমাতা-র রূপ কল্পনা করে থাকেন, তা প্রকার মৃত্তিকা-পূজন। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতমাতার কথা বলেছেন।পৃথিবীপুজোর এই ‘মিসিং লিঙ্ক’ আজও সবদেশে সবজাতি গোষ্ঠীতে চলছে। মাটি-সংস্কৃতি স্মরণাতীত কাল থেকে বয়ে আসা এক জীবনবোধ, যার মূল প্রোথিত আছে মাটিতে এবং মানুষের অন্তরে। মাটি আমাদের ধারণ করেছেন, তাই তিনি মাতৃস্বরূপা। ৫ ই ডিসেম্বর বিশ্ব মাটি দিবস তারই অনুষঙ্গে গৃহীত বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠান। তাকে রক্ষা করলে আমরা বাঁচতে পারবো, মাটি কলুষিত হলে আমাদের মৃত্যু অনিবার্য। বিশ্ব মাটি দিবস মাটি সুরক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী এক শপথানুষ্ঠান। এই দিনে মৃত্তিকা-মাতাকে অন্তর থেকে রক্ষা করার ডাক দিতে হবে পল্লী প্রকৃতি থেকে; শহর-নগর-রাজধানী থেকেও। ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ভাবনার মধ্যে যেন মাটিকে চাষযোগ্য রাখার যথাযথ উদ্যোগ থাকে। মৃত্তিকা সম্পদকে যুক্তি-সংহতভাবে ব্যবহার করবো, শোষণ কিংবা লুণ্ঠন করবো না। মানুষের লোভ যেন মেদিনী-মাতাকে পীড়ন না করে। সর্বংসহা মাটিকে যেন প্রতিশোধ নিতে না হয় কোনোদিন। স্বচ্ছ মাটি, স্বচ্ছ কৃষি, স্বচ্ছতোয়া ভৌমজল আমাদের ভরসা। জৈবিক-চাষাবাদ এই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে; মৃত্তিকা ও জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা চাই; পরিবেশবান্ধব গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ চাই, সম্পদের আবর্তন-চক্র বজায় রাখা চাই। তবেই বছর বছর নবান্ন ঘুরে আসবে। নতুন ধানের গন্ধ পাবার পূর্বশর্ত হল মাটির সোঁদা গন্ধ। তা অক্ষত রাখতেই মাটি দিবস।

কল্যাণ চক্রবর্তী এবং অরিত্র ঘোষ দস্তিদার ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.