অশোক সেনগুপ্ত
ইতিহাসের পাঠ্যক্রম বদলানো নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে নানা মহলে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের পদক্ষেপকে সমর্থন করলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রান্ত প্রবুদ্ধ প্রমুখ তথা জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক ও গবেষক সংঘের প্রাক্তন রাজ্য কার্যকরী সদস্য ডঃ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “লুঠেরার ইতিহাস কেন জোর করে পড়ানো হবে?“
স্নাতকস্তরে বিএ ক্লাসের ইতিহাসের নতুন সিলেবাস নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। ‘আইডিয়া অব ভারত’ নামে নতুন একটি অধ্যায় পৃথকভাবে যুক্ত করায় উঠছে প্রশ্ন। মুঘলদের ইতিহাসের গুরুত্ব কমিয়ে বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, পুরাণের মতো বৈদিক সাহিত্যকে ‘গ্লোরি অব ইন্ডিয়ান লিটারেচার’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সর্বধর্মকে সম্মান দেওয়া সম্রাট আকবরের ইতিহাসের বদলে তাঁর সঙ্গে যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, সেই রাণা প্রতাপ, রানি দুর্গাবতী, চাঁদবিবি, হেমু বিক্রমাদিত্যদের মতো যোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। মুঘলদের পতনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
রঞ্জনবাবু এই প্রতিবেদককে বলেন, “ইতিহাসতত্ব অনুযায়ী যেকোনো ইতিহাস রচনায় ঐতিহাসিকের ‘আমি’ থাকে, যাকে বাদ দিয়ে ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। এই ‘আমি’ আসলে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি যা রচনাকালে চেতন বা অবচেতনে সক্রিয় থাকে এবং যা পরিবার -পরিবেশের সাথেই বেড়ে উঠে।একারনেই নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা কার্যত অসম্ভব।
যখন আগাথা ক্রিস্টির সেই বিখ্যাত গল্পের বাচ্চা মেয়েটি তার বাবাকে অভিযোগ করে জানিয়েছিল যে সে ইতিহাস পড়বে না কারণ একেকজন মানুষ একেকটি কথা বলে। তার বাবার উত্তরটি ছিল যে, “That is the real interest in History “. ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনা নিয়ে বঙ্কিম চন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রমেশচন্দ্র মজুমদার সকলেই বিস্তর অভাব অভিযোগ করেছেন। আজও ভারতের একটি বড়ো অংশের মধ্যে প্রচলিত ইতিহাস রচনা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। শাসক চিরকালই তাঁর আনুকূল্যে ইতিহাস রচনায় প্রভাব খাটিয়েছেন। হর্ষবর্ধনের শাসনে বাণভট্ট থেকে বাম শাসনে অনিরুদ্ধ বাবু, বা কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের দীর্ঘ শাসনের ফসল বিপানচন্দ্র, সকলেই শাসকের দোষ ক্রটি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন।“
মুঘলদের ছোট করে দেখানোর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় গৈরিকীকরণের অভিযোগও উঠছে। প্রগতিশীল ইতিহাসকে অগ্রাধিকার না দিয়ে প্রাগৌতিহাসিক বিষয়কে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও মোদি সরকারের দিকে আঙুল তুলছে রাজনৈতিক বিরোধীরা। যদিও তা মানতে নারাজ ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়কে সিলেবাস চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক অফিসার। যদিও সরকারিভাবে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি ইউজিসি। তবে এরপরেও বিতর্ক থামছে না।
রঞ্জনবাবু জানান, “এখনও দেশের ইতিহাস রচনায় বামপন্থী চেতনার মানুষ তথা ঐতিহাসিকদের কমবেশি প্রাধান্য রয়ে গেছে। এই প্রাধান্য অটুট রাখতে তাঁরা যে কোনও বিরোধী মতকে সেই সময় থেকে “গৈরিকীকরণ “বলে চিৎকার করতেন। যে সময় আইসিএইচআর তো দূরে, এমনকি সংসদেই বিজেপির কোনও প্রতিনিধি ছিল না।
একারনেই আচার্য যদুনাথ সরকার থেকে রমেশচন্দ্র মজুমদার, ঈশ্বরীলাল থেকে সরদেশাই সাহেব— সকলেই এদেশের মানুষের কাছে ব্রাত্য ছিলেন। মানে সুকৌশলে ব্রাত্য করে তাঁদের রাখা হয়েছিল।গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন বিরোধী কন্ঠস্বরের তীব্রতা প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রের ভীতকেই মজবুত করে, তেমনই ইতিহাসতত্বেও বিভিন্ন মতামত পরোক্ষে ইতিহাসের নির্মান- পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়াটিকেই সচল রাখে।
যাঁরা ইতিহাসের ভারতীয়করণ হচ্ছে বলে শোরগোল তুলেছেন, তাঁরা এই সোজাসাপটা বিষয়টি না বোঝার মতো মূর্খ নন। আফগানিস্তানের ইতিহাস বইতে গজনীর একজন লুটেরার উল্লেখ না থাকলেও বা রাশিয়া থেকে আগত নিজের আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় এদেশের জলবায়ু, সংস্কৃতি ও অধিবাসীদের গাল দেওয়া লুঠেরার ইতিহাস কেন জোর করে পড়ানো হবে- এই প্রশ্ন তোলা গণতন্ত্র ও ইতিহাসতত্ব, উভয়ের ভিত্তিকেই মজবুত করবে।“