কাকাবাবু বললেন রাজেন অনেক পড়াশোনা করেছো, আমি এক জায়গায় কথা বলে রেখেছি, ওদের একজন হিসাব নিকাশ জানা কর্মচারী লাগবে, তুমি কাল থেকেই কাজে লেগে পড়। ৫ টাকা বেতন পাবে। তারপর না হয় অন্য চাকরি দেখো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, সদ্য প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে এবার কলম পিষতে হবে?( উল্লেখ্য, সেই সময় শিবপুর ইঞ্জিয়ারিং এর ক্লাস প্রেসিডেন্সি কলেজে হতো)। তার যে লক্ষ্য অন্য, কারিগরি বিদ্যায় তার দারুন আকর্ষণ, তিনি চান তার ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন ঠিকাদারি ব্যবসা। ছবিতে দেখা সাতমহলা অট্টালিকা, বিদেশি ক্যাসল গড়ে উঠবে তার তত্ত্বাবধানে।নতুন নতুন নকশা করবেন, প্ল্যান করে তাক লাগিয়ে দেবেন ইংরেজদের, তবেই না তার শিক্ষার দাম। তার বদলে কিনা ৫ টাকার কর্মচারী। না না তা সম্ভব না। শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলেন, কাকাবাবু আমায় কটা দিন সময় দিন, আমি স্বাধীন ব্যবসা করতে চাই।চমকে ওঠেন কাকাবাবু, ব্যবসা!! একি তোমার জয়নগরের মোয়া! অভিজ্ঞতা নেই, পুঁজি নেই, এমন কি নিজের ভাত জোটানোর ক্ষমতা নেই, ব্যবসা, ইঞ্জিনিয়ারিং! মরে যাই। ওসব আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়ো। কাজে লাগো। আমি অনেক দিন টেনেছি। এবার নিজের ব্যবস্থা নিজে করো।
কথা গুলো কাঁটার মতো বিঁধল রাজেনের। ভাতের খোঁটা, উপহাস? না এই কাকা তার নিজের না। বাবার মৃত্যুর পর মা বলে কয়ে তাঁর বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন।নাহলে সেই বসিরহাটের ভ্যাবলা গ্রামে থাকলে তার উচ্চ শিক্ষা হতো না এটা ঠিক। কাকাবাবুর কাছে নিরখরচায় থাকছে এটাও ঠিক।তাঁর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু তা বলে নিজের স্বপ্নকে তিনি ছেড়ে দেবেন না।তিনি নিজের প্ল্যানিং এ ঠিকাদারি ব্যবসা করবেন। গোরা সাহেবদের সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা আছে তার।তিনি বুঝে নিয়েছেন আর এই কাকার বাড়ি থাকাও সম্ভব না। নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতে হবে।
পরদিন থেকে নতুন জীবন শুরু হল তাঁর। কাকাবাবুকে প্রনাম জানিয়ে তাঁর আশ্রয় ত্যাগ করে কলেজের বন্ধু রামব্রহ্মের মেসে গিয়ে উঠলেন। শুরু করলেন প্রাইভেট টিউশানি। সকাল বিকেল ছাত্র পড়ানোর ফাঁকে সারা দিন ঘোরেন রাস্তায় রাস্তায়। তাকিয়ে দেখেন শহরের বড় বড় নির্মীয়মাণ অট্টালিকা। নিজের মনে করেন কাল্পনিক প্ল্যানিং।এই স্বপ্ন তাঁকে স্থির থাকতে দেয় না। বন্ধু রামব্রহ্মের কাছে শোনেন কলকাতা চিড়িয়াখান উদ্যানে নানা স্থাপত্য নির্মাণের কাজ করছেন কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ব্রাডফোর্ড লেসসি সাহেব। তিনি গেলেন সেখানে। নীরবে দাঁড়িয়ে দেখেন কাজ। একটি কাজ কিছুতেই লেসলি মিস্তিরিদের বোঝাতে পারছিলেন না। সাহেবের প্ল্যান বাস্তবে রূপ দিতে পারছিল না তারা। লেসলি অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে উঠছেন ক্রমশ।পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন রাজেনবাবু। স্যার আমি রাজেন্দ্রনাথ মুখারজি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। যদিও অসুস্থতার জন্য পরীক্ষা দেওয়া হয় নি, তাই ডিগ্রি নেই। কিন্তু কাজটা আমি খারাপ বুঝিনা। স্যার আপনি এইখানের নকশাটা একটু চেঞ্জ করে দিন, ওরা সহজেই করতে পারবে। মুল স্থাপত্যের কোনও পরিবর্তন হবে না। লেসলির অনুমতি নিয়ে নতুন নকশা বুঝিয়ে দিলেন মিস্তিরিদের।সহজেই কাজ হয়ে গেল। সাহেব ভুরু কুঞ্চিত করে বললেন, বাহ বেশ তো। কি করো তুমি? রাজেনবাবু বললেন ঠিকাদারি ব্যবসা করতে চাই, কিন্তু পুঁজি নেই। সাহেব বললেন বেশ, পলতা জল প্রকল্পের কাজের জন্য ভালো ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছি। করবে সে কাজ? যেন আকাশের চাঁদ এসে পড়ল রাজেনের হাতে। কিন্তু স্যার বরাত নেবার মতো অর্থ নেই। সাহেব বললেন, কিছু পুঁজি জোগাড় কর, আমরা অগ্রিম দিচ্ছি কিছু। ব্যাস শুরু হল রাজেনের জীবনের নতুন অধ্যায়।
কলকাতা তথা সারা বাংলায় ভগীরথ হয়ে নব জলধারার সঞ্চার করলেন রাজেন্দ্রনাথ। দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার, অথচ কি নিপুন ভাবে করছেন কাজ। প্রতিটি ইঞ্চিতে কড়া নজর। দেখে লেসলি সাহেব নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালেন যোগ্য লোককে খুঁজে বের করার জন্য। আর রাজেন্দ্রনাথের নাম সুপারিশ করলেন সরকারের কাছে। কলকাতা থেকে পলতা চল্লিশ ইঞ্চি ব্যাসের জলের পাইপ পাতার কাজের বরাত পেলেন তিনি। তার নাম ছড়াল সারা দেশে, আগ্রা, এলাহাবাদ, মিরাট, নইনিতাল, বেনারস এইরকম নানা শহরের জলপ্রকল্প আর পাইপ লাইনের কাজ পেলেন তিনি। তাঁর হাত ধরে খরা কবলিত বা পার্বত্য এলাকায় বাহিত হল জলধারা। সকলে কুর্নিশ জানালো তাঁর কারিগরি দক্ষতাকে।
তারপর চারদিকে তাঁর জয়জয়কার। বিভিন্ন ইংরেজ আসেন তাঁর সাথে যৌথ ব্যবসা করার আর্জি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত মার্টিন সাহেবের সাথে খুললেন যৌথ সংস্থা মার্টিন অ্যান্ড কোং। এরপর তিনি জলের লাইনের কাজ ছেড়ে হাত দিতে চাইলেন স্থাপত্য শিল্পের কাজে। বড় বড় অট্টালিকা,সুন্দর সুন্দর তাক লাগানো ডিজাইন বানানো এযে তাঁর কতো দিনের স্বপ্ন। লোকে দাঁড়িয়ে দেখবে তাঁর কীর্তি, প্রশংসা করবে, তবেই না সার্থক তাঁর কাজ। এই কাজের মাধ্যমেই বেঁচে থাকতে চান তিনি।
সুযোগ এল হঠাৎ করেই। বড়লাট লর্ড কার্জন রানী ভিক্টোরীয়ার নামে এক সৌধ বানাতে চান কলকাতায়। এমন সৌধ যেন ইংরেজদের রীতির সঙ্গে অনুপম আভিজাত্যে ঝলমল করে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্থপতি উইলিয়াম এমারসনকে অনুরোধ করেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ করার। এমারসন দরপত্র সহ নকশা চান। বিভিন্ন নামী দামী বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে নকশা জমা দিলেন রাজেন মুখোপাধ্যায়। দেখে তাক লেগে গেলো এমারসনের। তাঁর হাতেই দিলেন নির্মাণের ভার। কলকাতার বুকে গড়ে উঠলো বেলজিয়াম মার্বেলে তৈরি অপরূপ এক সৌধ। সামনে ব্রিটিশের প্রতীক সিংহ।আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল প্রাসাদ। চমক দিলেন শেষে। সৌধের মাথায় স্থাপন করলেন এক ছোট্ট ঘূর্ণায়মান পরী। অবাক বিস্ময়ে সবাই প্রত্যক্ষ করলো কলকাতার তাজমহল। কি অপরূপ সৌন্দর্য।
কপাল খুলে গেল তাঁর। এতদিনের স্বপ্ন সফল হল। বাংলা ও কলকাতা জুড়ে একের পর এক বিখ্যাত স্থাপত্যের কাণ্ডারি হয়ে রইলেন তিনি। তাঁর পরিকল্পনায় গড়ে উঠলো মহীশুর প্যালেস, টিপু সুলতান মসজিদ, বেলুড় মঠ, এসপ্ল্যানেড ম্যানসন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ বিধানসভা ভবন, ত্রিপুরা রাজবাড়ি, ইমামবড়ার মতো বিখ্যাত স্থাপত্য।আলাদা আলাদা ঘরানার স্থাপত্যের প্রতিটি তিনি ফুটিয়ে তুললেন অসাধারন দক্ষতায়। কিন্তু তিনি এতেও সন্তুষ্ট নন। তিনি গ্রেট রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। শুধু স্থাপত্য না, কারিগরি বিদ্যাতেও তিনি দেখাতে চান তাঁর প্রতিভা। তাই গঙ্গার ওপর যখন হাওড়া ব্রিজ গড়ার পরিকল্পনা হচ্ছে তার নকশাও করলেন তিনি। তাঁর পরিকল্পনায় নির্মিত হল এক বিস্ময়, এশিয়ার প্রথম বৃহৎ ঝুলন্ত সেতু।আজও যা বহন করে চলেছে বাংলার সম্পর্কের সূত্র। ব্রিটিশ তাঁর কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে স্যার উপাধি প্রদান করে।
এর মাঝেই মার্টিন সাহেবের মৃত্যু হওয়ায় মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির তিনিই একছত্র মালিক। হাওড়া আমতা রেলপথের কাজ হাতে নিয়েছেন। অজানা গ্রামকে জুড়েছেন শহরের সাথে। সবুজ মাঠের বুক চিরে ছুটেছে মার্টিন রেল। রানাঘাট কৃষ্ণনগর, আদ্রা বখতিয়ারপুর, দিল্লি সাহারানপুর, বারাসত বসিরহাটের রেলপথও তাঁর হাতেই তৈরি। শুধু ইঞ্জিনিয়ার হিসাবেই নয়, তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরের পর হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সফল বৃহৎ শিল্পপতি। মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি শুধু না, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি, ইস্কো, স্টিল করপরেশান অথোরিটি অফ ইন্ডিয়ার মতো বড় বড় কোম্পানির কর্ণধার ছিলেন তিনি।বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি শুধু কেরানী হতে জন্মায় না। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উচ্চাশা আর কাজের প্রতি একগ্রতা থাকলে সব বাধা দূর করে নিঃস্ব অবস্থা থেকে এভাবেও মাথা তুলে দাঁড়ানো যায়।
বিশ্বকর্মা পুজো তো হোল।কিন্তু বাংলার শিল্পে বড়ই আকাল আজ। প্রযুক্তির জন্য নির্ভর করতে হয় বিদেশের ওপর। কিন্তু এই বাংলাতেও একদিন ছিলেন এক বিশ্বকর্মা, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। যার কৃতিত্বের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে বাংলা জুড়ে।শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে। তার আদর্শে আবার বাংলায় জেগে উঠুক অনেক বিশ্বকর্মা। উজ্জ্বল হোক বাংলার মুখ।
তথ্য সূত্র, গুগল, উইকিপিডিয়া,
সৌজন্যে – শ্রীপীযূষকান্তি সিনহা।