বিশ্বকর্মার সৃষ্টিকর্মের ওয়ার্কশপ এবং ভারতীয় শ্রমিক দিবস।

ভারতীয় শ্রমিক দিবস হিসাবে ‘পয়লা মে’-র পক্ষে ‘সেকুলারি’ ভোট দেবো, না সনাতনী ঐতিহ্য মোতাবেক ‘বিশ্বকর্মা পূজা’-য় আস্থা রাখবো — মূল আলোচনায় মনোনিবেশ করার আগে রবীন্দ্র-ভাবনার তত্ত্ব-তালাশ নিই। কারণ ‘সেকুলার-বাঙালি’ তথা ‘বামপন্থী-মানস’ মগজাস্ত্রে ধার দেবার আগে রবীন্দ্র-স্মরণ করে নেন, “সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ/চেতনাতে নজরুল……।”

‘শেষের কবিতা’-য় সৃষ্টি ও কারিগরির দেবতা বিশ্বকর্মার প্রসঙ্গ অবতারণা করে নান্দনিকতার একটি ঝলক দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। [আমার মনে হয় যেন বিশ্বকর্মার কারখানায় একটা পাগলা স্বর্গীয় স্যাঁকরা আছে; সে যেমনি একটি নিখুঁত সুগোল সোনার চক্রে নীলার সঙ্গে হীরে এবং হীরের সঙ্গে পান্না লাগিয়ে এক প্রহরের আঙটি সম্পূর্ণ করলে অমনি দিলে সেটা সমুদ্রের জলে ফেলে, আর তাকে খুঁজে পাবে না কেউ।”
“ভালোই হল, তোমার ভাবনা রইল না, অমিট, বিশ্বকর্মার স্যাঁকরার বিল তোমাকে শুধতে হবে না।”
“কিন্তু লিলি, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তোমাতে আমাতে মঙ্গলগ্রহের লাল অরণ্যের ছায়ায় তার কোনো-একটা হাজার-ক্রোশী খালের ধারে মুখোমুখি দেখা হয়, আর যদি শকুন্তলার সেই জেলেটা বোয়াল মাছের পেট চিরে আজকের এই অপরূপ সোনার মুহূর্তটিকে আমাদের সামনে এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ-চাওয়া-চাউয়ি করব, তার পরে কী হবে ভেবে দেখো।”
লিলি অমিতকে পাখার বাড়ি তাড়না করে বললে, “তার পরে সোনার মুহূর্তটি অন্যমনে খসে পড়বে সমুদ্রের জলে। আর তাকে পাওয়া যাবে না। পাগলা স্যাঁকরার গড়া এমন তোমার কত মুহূর্ত খসে পড়ে গেছে, ভুলে গেছ বলে তার হিসেব নেই।”] রবীন্দ্রনাথের বিরোধী গোষ্ঠী বাস্তবেও যে ছিল। নিজেই তার তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছিলেন ‘শেষের কবিতা’-র লেখক। এখানে ‘অমিট রায়’ বা ‘অমিট’ সেই ঘরানার পাঠক এবং স্নাতক। ‘নিবারণ চক্রবর্তী’ হচ্ছেন পন্থী-লেখক। উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বিরোধী মত হিসাবে বিশ্বকর্মাকে এক ‘স্বর্গীয় স্যাঁকরা’ হিসাবে তুলে ধরলেন। দেবতা নন, নিতান্তই এক প্রখ্যাত শ্রমজীবী। এই সূত্রে বামপন্থী শিল্পীদের দ্বারা বিশ্বকর্মা উপস্থাপনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা নয়। ভারতবর্ষে বসবাস করে সবসময় ভারতীয় ধারার বিরোধিতা করা যায় না, এটা এখন বুঝতে পেরেছে বামেরা। কারণ হিন্দুরাও একসময় চটে যাবে, এই আক্কেলজ্ঞান তাদের আসছে৷ ইদানীং শুনলাম একটি আর্ট কলেজে বামপন্থী ছাত্রেরা বিশ্বকর্মার শ্রমিক-সত্তাকে মেনে কলেজে বিশ্বকর্মা মূর্তি গড়ে তা সংরক্ষণে অনুমোদন দিয়েছেন বা দিতে বাধ্য হয়েছেন। ‘রাবীন্দ্রিক সূত্র’ মনে হয় এটাকেই বলে!

ভারতবর্ষের নিজস্ব শ্রমিক দিবস (Labour Day) অর্থাৎ বিশ্বকর্মা পুজো কয়েক হাজার বছরের পুরনো। কেবল শ্রমিকেরা দিনটিকে পালন করেন, তাই নয়, প্রকৌশলী বা ইঞ্জিনীয়ারেরাও পালন করেন। ফলে দিনটি ভারতবর্ষে প্রকৌশলী দিবস বা Engineers’ Day-ও বটে। শ্রমের মূল্যায়নে এবং দেব-আরাধনায় শ্রমিক-প্রকৌশলী বিচার ভারতবাসী করেন নি। ভারতবর্ষে আলাদাভাবে শ্রমিক দিবস ও প্রকৌশলী দিবসের ধারণা নেই। ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মাকে সমভিব্যাহারে পুজো করাটাই বিধি। এই প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে দেখাবো, নবজাগরণের কালে ভারতীয় মনীষায় ‘শ্রমজীবী’ সম্পর্কে ধারণা কেমন ছিল?

জানা যায়, ঊনিশ শতকে ‘শ্রমজীবী’ নিয়ে প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শিবনাথ শাস্ত্রী। স্বদেশী মন্ত্র দিতে শিবনাথ যেমন পুরোধা ছিলেন, শ্রমজীবী মানুষকে তাতে সামিল করার ব্যাপারেও ছিলেন সমান উৎসাহী। শিবনাথের কবিতা ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘ভারত শ্রমজীবী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। সম্পাদক ছিলেন শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় —
“উঠ জাগো শ্রমজীবী ভাই!
উপস্থিত যুগান্তর
চলাচল নারীনর
ঘুমাবার আর বেলা নাই,
উঠো জাগো ডাকিতেছি তাই।”
সমাজতন্ত্রের আদর্শ ভারতীয় ধারার মধ্যেই লালন করেছিলেন শিবনাথ। এমনকি বঙ্কিম ও বিবেকানন্দেও লালিত হয়েছে। তবুও তাঁরা ভারতীয় বামপন্থীদের কাছে কল্কে পান নি। কারণ তাঁরা শাশ্বত জীবনমূল্যকে অস্বীকার করতে চান নি। শাশ্বত ভাবনাকে অস্বীকার করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী করে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ে তা বিশ্ববাসী দেখেছেন।

মে শ্রমিক দিবস পালন ভারতীয় ঘরানা নয়, এটা ভারতবাসী এখন বুঝতে শুরু করেছেন। শ্রমের দেবতা বিশ্বকর্মা, আর শ্রমিক দিবস হচ্ছে ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। ‘বিশ্বকর্মা’ নামের মধ্যেই আন্তর্জাতিকতার সুবাস আছে। কাজেই দিনটি কেবল ভারত কেন বিশ্ব শ্রমিক দিবস হবার উপযুক্ত। ভারতে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটি সরকারিভাবে শ্রমিক দিবস হোক। বাংলায় এই দিনটিকে মদ-সংস্কৃতি ও অসভ্যতামির দিন করে তুলেছেন বামপন্থী শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ কনসার্ট। দিনটিকে কলুষিত করেছেন। এবার তাদের ক্লোজ করতে হবে। দিনটির মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই কাজটি মূলত করবেন রাষ্ট্রবাদী শ্রমশক্তি, তার পিছনে সামগ্রিক ঐতিহ্যপন্থীকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটি ভারতীয় শ্রমিকেরা কীভাবে পালন করেন? এদিন তারা আপন কর্মোন্নতির জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা জানান। বিশ্বকর্মা নির্মাতা, তিনি কর্মকার। তাদের বিশ্বাস বিশ্বকর্মা শিল্পের দেবতা, সহস্র শিল্পের আবিষ্কারক। তিনি হাজার শিল্পবিদ্যার অধিকারী। সনাতনী সংস্কৃতিতে বিশ্বকর্মাকে বিশ্বের যাবতীয় স্থাপনার আশীর্বাদক দেবতা বলে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। সকল কর্মের কারিগরী-দেবতা তিনি, সকল যন্ত্রের যন্ত্রী-দেব, সকল প্রযুক্তির প্রকাশ-শক্তি। স্থাপত্যবেদের রচয়িতা, সর্বদর্শী ভগবান। তাঁর চোখ, মুখ, বাহু, পদযুগল সর্বদিক জুড়ে রয়েছে। তাই দিয়েই তিনি ত্রিভুবন নির্মাণ করেছেন। শিল্পকে প্রকাশ করেছেন, অলঙ্কার সৃষ্টি করেছেন, দেবতাদের বিমান, রথ নির্মাণ করেছেন, নির্মাণ করেছেন দেবতাদের সকল অস্ত্র। তিনি দেবতাদের পুষ্পক রথ নির্মাণ করেছেন, করেছেন শ্রীবিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, লক্ষ্মীর কোষাধ্যক্ষ,কুবেরের কুবের পাস, কার্তিক বল, লঙ্কা নগরী, পঞ্চপান্ডবের ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি এবং শ্রী ক্ষেত্রেপ্রসিদ্ধ জগন্নাথের বিগ্রহ নির্মাতা। এক জন স্থাপত্য শিল্পী। দ্বারকাপুরী তাঁরই পারদর্শিতায় তৈরি হয়েছে, হয়েছে দ্বারকা-নগরীর বাস্তুবিদ্যার পরিকল্পনা। পৃথিবীর সকল গতির গন্তব্য-সহায়ক দেবতা৷ তাঁকে বিনম্র প্রণাম করে, স্মরণ-মনন করে কাজে নিয়োজিত হন শ্রমিকেরা। তাঁর আশিস প্রার্থনা করে দুঃসাহসিক নির্মাণ কর্মে ব্রতী হন। কাজেই তাঁর বাৎসরিক আরাধনার দিনটি অর্থাৎ ভাদ্রের সংক্রান্তিটি শ্রমের পুজো, শ্রমিকের স্বীকৃতি আর শ্রমিক-দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনার দিন।

তাই বলতে হয়, আপাদমস্তক বামপন্থী-শালুতে মোড়া ১ লা মে ভারতে শ্রমের পরব হতে পারে না।

আমাদের প্রথমে ভারতীয় হতে হবে, ভারতের সীমার মধ্যেই ভারতীয়ত্ব খোঁজ করতে হবে, ভারতের প্রাচীন ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে মান্যতা দিতে হবে। তারপর দুনিয়ার কমিউনিজমের সুলুকসন্ধান করতে বেরোতে হবে। তাই বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটিতে ভারতীয় রীতি মেনে শ্রমের পুজো আর শ্রমিকের পুজো করুন।

কল্যাণ গৌতম এবং সৌকালিন মাঝি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.