ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০- ১৮৯১) ছিলেন বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক। প্রকৃতপক্ষে এই সাহিত্যের দ্বারোদঘাটক তিনি। কারণ তার আগে বাংলা সাহিত্য মূলত পদ্যে রচিত হত; বিদাসাগরের দেখানো পথে হাঁটলেন পরবর্তী কালের সাহিত্যিকেরা। তিনি সৃজনশীল সাহিত্য সে অর্থে রচনা করেন নি। মূলত লিখেছেন সমসাময়িক কালের প্রয়োজন মেটাতে, শিক্ষায় পাঠ্যপুস্তক হিসাবে। কিন্তু তাঁর প্রতিটি লেখার মধ্যে অতি উচ্চ সাহিত্য মানস এবং মুন্সিয়ানার ছাপ। তাঁকে প্রয়োজনের কাছে হার মেনে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল কেজো-সাহিত্য লিখতে, বই লিখতে।
তাঁর যাবতীয় লেখাগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. অনুবাদ ও অনুবাদমূলক রচনা
২. শিক্ষামূলক রচনা
৩. সমাজসংস্কারমূলক রচনা
৪. মৌলিক রচনা এবং
৫. বেনামী রচনা
দেখা যায়, তাঁর সৃজনশীল সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন গদ্যে লেখা প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৬০)। এটি একটি শোকগাথা। তাঁর প্রথম রচনা ‘বাসুদেবচরিত’, যদিও তা জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় নি, পরে পাণ্ডুলিপিও নষ্ট হয়ে গেছে। এটি ছিল ভাগবতের কৃষ্ণলীলার অন্তর্ভুক্ত কিছুটা স্বচ্ছন্দ অনুবাদ। জানা যায়, তাঁর দুইজন প্রামাণ্য জীবনীকার এই পাণ্ডুলিপিটি জীর্ণদশায় দেখেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি অনুবাদ গ্রন্থটি রচনা করলেও, আখ্যানের মধ্যে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের কাহিনী গ্রহণ করায় সম্ভবত তা কলেজে পাঠ্য হিসাবে গৃহীত হল না। তা অপ্রকাশিতই থেকে গেলো, অনেক পরে প্রকাশ করার জন্য তিনি পুনরায় চেষ্টা করলেও, তা হাতের কাছে আর খুঁজে পান নি। সম্ভবত এই পাণ্ডুলিপিটি তিনি রচনা করেন ১৮৪৫-৪৬ নাগাদ, যখন তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিত ছিলেন।
এরপর দেখা যায়, তিনি ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ গ্রন্থ লিখছেন। এটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ (১৮৪৭)। অনুবাদধর্মী, হিন্দি ‘বৈতাল পচ্চীসী’ গ্রন্থের দক্ষ অনুবাদ। কাজটি তিনি করেছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ মার্শাল সাহেবের নির্দেশে। বইটি পাঠ্য হয়েছিল এবং বাঙালি-সমাজ এই প্রথম এক মনোরম গল্পরসের আস্বাদ পেল। অনুবাদ কর্মের জন্য বিদ্যাসাগর গৃহ শিক্ষক রেখে হিন্দি ভাষা শিখেছিলেন।
‘বাংলার ইতিহাস’ (১৮৪৮) নামে তিনি একটি অনুবাদধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে সিরাজের সিংহাসন আরোহন থেকে লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকাল পর্যন্ত ৭৯ বছরের ইতিহাস ধরা আছে। বইটি তৎকালীন সময়ে ইংরেজিতেও অনূদিত হয়, অনুবাদ করেন মার্শেল সাহেব, নাম হয় ‘A Guide to Bengal’. বিদ্যাসাগরের ইতিহাসবোধ বইটির মধ্যে ধরা আছে। বইটিকে শিক্ষাবিভাগের তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা খুবই মান্যতা দিয়েছিলেন। সেই সময়ে জনপ্রিয় এই ইতিহাস গ্রন্থ।
বিদ্যাসাগর ১৮৪৮ সালে মহাভারতের বঙ্গানুবাদে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো যোগ্য ব্যক্তিকে মহাভারতের অনুবাদ করতে দেখে তিনি আর অনুবাদের প্রয়োজন মনে করেন নি। বইটির লেখা আর এগোলো না।
বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ একটি ক্লাসিক রচনা। রামায়ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য বাদ দিলে এমন সুন্দর রচনা আর নেই। লঙ্কাজয়ের পরবর্তী আখ্যান, আর সীতার পরিণাম নিয়ে এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। সাহিত্য গুণ তো এতে ছিলই; পদবিন্যাস, বাক্যপ্রকরণ, শব্দসম্ভার, সমাস-সন্ধি-অলঙ্কারের সৌকর্য প্রয়োগ করে বাংলা ভাষা শিখতে গেলে এটি ছিল সমকালের এক অপরূপ গ্রন্থ।
‘ভ্রান্তিবিলাস’ গ্রন্থে তিনি ইংরেজি ভাষায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন অনুবাদের মাধ্যমে। শেক্সপীয়ারের ‘The Comedy of Errors’ অবলম্বনে ১৮৬৯ সালে এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদানের পরে তিনি শিক্ষক ও ইংরেজিনবিশ বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে উত্তমরূপে ইংরেজি শিখে তবে অনুবাদ সাহিত্য রচনায় হাত দিয়েছিলেন।
মহাকবি কালিদাসের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। তিনি কালিদাসের কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন, যেমন ‘রঘুবংশম’, ‘কুমারসম্ভবম’ এবং ‘মেঘদূতম’। আর কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম’-এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন; ১৯৫৪ সালে তা ‘শকুন্তলা’ নামে প্রকাশিত হল।
শিক্ষামূলক রচনা হিসাবে অনবদ্য পাশ্চাত্য মনীষীদের নিয়ে জীবনীগ্রন্থ ‘জীবনচরিত’। ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটি চেম্বার্সের ‘Exemplary Biography’ অবলম্বনে লিখেছিলেন। এই বইয়ে বিদ্যাসাগর এমন চরিত্র বেছেছিলেন যারা অদৃষ্ট নয়, আপন প্রচেষ্টায় জীবনকে উন্নত করেছেন; যাদের সহিষ্ণুতা আছে, আছে অধ্যাবসায়, উৎসাহ, পরিশ্রম।
তাঁর ‘বোধোদয়’ গ্রন্থটিও শিশুশিক্ষা মূলক এবং স্কুলপাঠ্য বিষয়ক একটি গ্রন্থ। বেথুন সাহেবের বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য এটি রচনা করেছিলেন তিনি। ১৮৫১ সালে প্রকাশিত হয় এই বই। চেম্বার্সের ‘Rudiments of Knowledge’ অবলম্বনে লেখা হলেও বিদ্যাসাগর তারমধ্যে নানান গ্রন্থ থেকে মণিমাণিক্য আহরণ করে দিয়েছিলেন।
সংস্কৃত সাহিত্যে শিক্ষা সুগম করতে বিদ্যাসাগর লিখলেন, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’-র প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ। ১৮৫৩ এবং ৫৪ সালের মধ্যে তা প্রকাশিত হল। লিখলেন শিক্ষামূলক গ্রন্থ ‘বর্ণপরিচয়’ – প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, ১৮৫৪ ও ৫৫ সালে। ১৮৫৫ সালে প্রকাশ হল ‘কথামালা’। কথামালা হল ‘Aesop’s Fables’ অবলম্বনে ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ। এতে আখ্যান রস যেমন আছে, আছে শিক্ষণীয় নানান উপকরণ। ‘আখ্যানমঞ্জরী’-তে তিনি ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের নানান সদুপদেশ গল্প-আখ্যানে অনুবাদ করে প্রকাশ করলেন। পরে তা আরও সরল ভাষায় অল্পবয়স্কদের উপযোগী করে কয়েকটি ভাগে প্রকাশিত হল। বইগুলি চরিত্র গঠনের উপযোগী, তাতে পারিবারিক কর্তব্য শিক্ষা দেওয়া আছে। আছে পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃস্নেহ, গুরুভক্তি, অপত্যস্নেহ ইত্যাদি।
সহজে সংস্কৃত শেখানোর যে চেষ্টা বিদ্যাসাগর মশাই করেছিলেন তারই অনবদ্য সৃষ্টি ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’। ১৮৫১ সালে লেখা এই বই, তখন তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। এই বই পড়ে ছাত্রেরা বুঝতে পারলো, বই মুখস্থ নয়, ভাষা আয়ত্ত করার এক দারুণ গ্রন্থও থাকতে পারে। এই বইটিকেই সংক্ষেপে ‘উপক্রমণিকা’ বলা হয়।
বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য হল ১৮৫৫ সালে লেখা ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’। এখানে তিনি পরাশর সংহিতার শ্লোক উদ্বৃত করে প্রমাণ করেছিলেন বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, হিন্দু সমাজে বৈধ। প্রমাণ করেছিলেন বিধবাবিবাহের ফলে জাত পুত্র পিতার শ্রাদ্ধের অধিকারী এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে। ১৮৭১ এবং ৭৩ সালে তিনি লিখলেন সমাজসংস্কারের বহুবিবাহ রোধ সংক্রান্ত বই, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার।’ প্রতিবাদীদের মতামত খণ্ডন করে নিজের যুক্তিজাল বিস্তার করে আপন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করলেন সেখানে।
বিদ্যাসাগর অধিকাংশ পুস্তক শিক্ষা প্রসারের জন্য লিখলেও, অনুবাদধর্মী বই রচনা করলেও কিছু এমন রচনা আছে যার মধ্যে স্বাধীন মৌলিক চিন্তা স্তরীভূত হয়ে আছে। যেমন ১৮৫৩ সালে লিখলেন ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’। বইয়ের মধ্যে আছে সংস্কৃত ভাষার বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের নানান দৃষ্টান্ত।
বিদ্যাসাগরের সাহিত্য রচনার একটি অসম্পূর্ণ উদ্যোগের নাম ‘রামের রাজ্যাভিষেক’। ১৮৬৯ সালে লেখা শুরু করেন, কিন্তু শেষ করেন নি। ‘সীতার বনবাস’ যেমন শ্রীরামের উত্তরজীবনের কাহিনী। এই বইটি আবার শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বচরিতের চরিত্রায়ন। ‘সীতার বনবাস’ বইটির বিপুল খ্যাতি, তাকে এই দ্বিতীয় বইটি রচনায় উৎসাহ জুগিয়েছিল। বইটি ছাপার কাজ প্রেসে চলছে। এমন সময় বিদ্যাসাগর মশাই খবর পেলেন শশিভূষণ চট্টোপাধ্যায়ও একই নামে একটি বই ছাপার কাজ শেষ করে ফেলেছেন। তিনি অপেক্ষা করলেন। শশিভূষণের বইটি বেরোলো, কিনলেন। তিনি পড়ে এতটাই খুশি হলেন, নিজে আর নতুন করে লেখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন না। বাঙালি আর একটি সাহিত্য কীর্তি থেকে বঞ্চিত হল।
বিদ্যাসাগরের ‘আত্মজীবনী’ বইটি মৌলিক রচনার মধ্যে আসতে পারে। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হল স্বরচিত এই চরিত গ্রন্থ। নানান কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি আত্মকথন অধিক লিখতে সময় পান নি। শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ হল না। প্রথমে ছিল কাজের চাপ, তারপর শারীরিক অসুস্থতা। ১৮৯১ সালের ২৯ শে জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। পুত্র নারায়ণচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর চরিত (স্বরচিত)’ নাম দিয়ে অসম্পূর্ণ বইটি প্রকাশ করেন।
কাজের মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি সমাজসংস্কারক, শিক্ষাব্রতী। কিন্তু কেজো-পুস্তকের মধ্যেই তাঁর অপরূপ সাহিত্য সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। কেবল সাহিত্যই যদি তিনি রচনা করতে প্রবৃত্ত হতেন, একাত্তর বছরের জীবনে তিনি কত যে অসংখ্য সাহিত্য রচনা করতেন, কল্পনা করা যায় না! বিদ্যাসাগরকে বাঙালি মনে রাখবে এক দৃঢ়চেতা, অথচ কোমল হৃদয়ের দয়ারসাগর রূপে। মনে রাখবে সমাজসংস্কারের এক দীপবর্তিকা জ্বালানোর মনীষা রূপে। শিক্ষার আলো জ্বালাবার বাতিওয়ালা রূপে। কিন্তু কখনই আমরা ভুলে যাবো না তাঁর সাহিত্যসাগরেও ডুব দিতে।
তথ্যসূত্র:
১. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় — বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা (দে’জ সংস্করণের সংশোধিত পুনর্মুদ্রণ ২০০৫)।
২. অমলেশ মিশ্র — অনন্য বিদ্যাসাগর, তুহিনস প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১৬।
৩. শক্তি মণ্ডল — অনন্য বিদ্যাসাগর ফিরে দেখা, বিদ্যাসাগর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটি, কলকাতা, ২০১৯।
মৃত্তিকা ভট্টাচার্য (Mrittika Bhattacharya)