ড. বিজয় কুমার আঢ্য প্রখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘স্বস্তিকা’-র প্রাক্তন সম্পাদক। আলোচ্য গ্রন্থটি তাঁর পিএইচডি গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর একটি বিশিষ্ট অধ্যায় অবলম্বনে রচিত। প্রথম প্রকাশ ২০০৩; প্রিটোনিয়া পাবলিশার্স অ্যাণ্ড বুকসেলার্স সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। মুদ্রিত মূল্য ২৫০ টাকা।
বিজয় বাবুর গবেষণাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১৯৯৪ সালে স্বীকৃত হয় এবং তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। মূল শিরোনামটি ছিল ‘স্বদেশ ও সমাজ চিন্তায় ভূদেব মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’। তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ড. হরিপদ চক্রবর্তী। এই ডিগ্রি লাভের একশো বছর পূর্বে ১৮৯৪ সালে ভূদেব প্রয়াত হন। ফলে প্রয়াণ শতবার্ষিকীতে এটি ছিল গবেষক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ভূদেবের প্রতি সারস্বত-শ্রদ্ধা। ভূদেব-এর সংহত ব্যক্তিত্ব এবং সমাজতাত্ত্বিক অভিমতের পূর্ণাঙ্গ অবয়বের তন্বিষ্ট সমন্বয় ঘটানো হয়েছে প্রস্তুত গ্রন্থে। ভারতীয় হিন্দুসমাজের বৈশিষ্ট্য এবং সার্বিক মনোভাবের পরিচয়ও ফুটেছে দুই মলাটের মধ্যে।
লেখক কিন্তু ‘হিন্দু পুনরুত্থানবাদী’ বলে ভূদেবকে অভিহিত করেন নি। কারণ ‘পুনরুজ্জীবন’ কথাটি তখনই প্রয়োগ করে চলে, যদি হিন্দুধর্মের মৃত্যু ঘটে থাকে। তা হয় নি। “এমন কিছু ঘটলে ভারতবর্ষের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারত। তখন কারও সাধ্য ছিল না এই ধর্মটাতে আবার প্রাণসঞ্চার করে।” কিন্তু ভূদেব একজন ‘Balanced personality’, নিজস্ব সাধনায় তিনি হিন্দু, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং প্রাচ্য-চিত্তবৃত্তির অনুশীলনকারী। পাশাপাশি তিনি পশ্চিমী সভ্যতার বিচার বিশ্লেষক। অতএব এক বৃহত্তর মানদণ্ডে তিনি হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে গেছেন নিজের জীবনচর্যায় এবং মানসচর্চায়। এই বলিষ্ঠ বৈশিষ্ট্যের জন্যই কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে কাব্যিক সুষমা ব্যক্ত করে লিখেছেন, “ইংরিজি শিক্ষার ফুল বাঙালি শিকড়ে/স্বতেজে উঠেছে উচ্চ শিখরের চূড়ে।” দেশী-বিদেশী বহু মনীষীই তৎকালীন সময়ে তাঁর সম্পর্কে সপ্রশংস শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন। তাঁর ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর অনুভব আজ কোটি কোটি ভারতবাসীর দর্শন এবং আলোচ্য বিষয়। এই দিক থেকে তিনি এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনীষী। কিন্তু দেশের আজকের বৃহত্তম মনন সেই পথে চললেও মাঝেমাঝে আমরা মূলসূত্রটি থেকে বিস্মৃত হই। সেজন্যই আজকের আলোচনায়, ভারতবর্ষের সমস্যা-সঙ্কটে তাঁকে আরও বেশি করে জানা প্রয়োজন। যদি স্বদেশ ও সমাজ ভাবনার নবীন আলোকে ভূদেবের সমাজচিন্তা রোমন্থন করি, তবে আমাদের উজ্জ্বল উদ্ধার হবে।
ভূদেব মনে করতেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন এবং তা রক্ষার প্রচেষ্টা তখনই সার্থক হয় যখন দেশবাসী স্বদেশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল ও উন্নতির কাজগুলিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার চাইতে মূল্যবান বলে মনে করেন। স্বদেশকে না জেনে, না ভালোবেসে, শ্রদ্ধা না করে কীভাবে রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায়? অতএব কল্যাণ ভাবনাই স্বদেশচর্চার মূল আধার হওয়া উচিত। কারণ “মাতৃভূমি সাক্ষাৎ ঈশ্বরী দেহ”, “দেবী মাতৃভূমির প্রতিরূপ স্বরূপ”। স্বদেশ-ভাবনা ও চর্চাকে চারটি গ্রন্থ-স্তম্ভ স্থাপনা করে পরাধীন দেশবাসীর মনে গেঁথে দেবার জন্য লিখলেন তিনি। ঊনবিংশ পুরাণ (১৮৬৯), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৭৬), স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৯৫) এবং সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯২)। প্রথম দুটি গ্রন্থ পুরাণ কথার অবয়বে স্বদেশপ্রেমের চিত্র। ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসেরও পূর্বে স্বদেশবন্দনার গান যেন ‘পুষ্পাঞ্জলি’। তৃতীয় গ্রন্থটিতে তিনি স্বাধীন ভারতের কল্পনাকে সাহিত্য-বাসরে তুলে আনলেন। আর ‘সামাজিক প্রবন্ধ’-টি “আস্তিক্য, দেশভক্তি, সম্মিলন ও উদ্যমের মহামন্ত্রস্বরূপ”, এমন মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন বঙ্গসমাজের আর এক মনীষী রাজনারায়ণ বসু। ভূদেব রচনাসম্ভার পাঠ করেই যে ‘আনন্দমঠ’-এর সৃষ্টি, ব্যাখ্যা করেছেন সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী। ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে বঙ্কিম যখন বলেন, “সকল ধর্মের উপরে স্বদেশপ্রীতি, ইহা বিস্মৃত হইও না”, তারসঙ্গে ভূদেব-এর ‘সামাজিক প্রবন্ধ’-র প্রভূত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সমগ্র রচনাবলীর স্থায়ীভাবটি হচ্ছে দেশপ্রীতি বা ‘জাতীয়ভাব’-এর উদ্দীপন। তিনি বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ভারত সুপ্রাচীনকাল থেকেই সাংস্কৃতিক ঐক্যে বিধৃত। তিনি যখন হিন্দু কলেজে পড়তেন এক সাহেব শিক্ষক বলতেন, হিন্দু জাতির মধ্যে স্বদেশানুরাগ নেই। একথা যে সত্যি নয়, তা প্রমাণ করার তাড়না তাঁর মধ্যে ছিল। পরাধীন দেশের মানুষের মধ্যে থাকা এই হীনমন্যতা দূর করা, স্বদেশের গৌরব জাগিয়ে তোলা যে আগে প্রয়োজন সেই উপলব্ধি করে তার জন্য ব্রতী হলেন তিনি। বললেন, এক দেশজাত, এক দেশপালিত “জল-মাটির বন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়ভাব সকল ব্যক্তিরই হৃদয়ের অন্তস্থলে অক্ষুণ্ণ থাকে।” এই দেশবাসীকে পরস্পর সংসৃষ্ট থাকতে হবে। এই একরূপতাই স্বদেশের এবং স্বজাতির প্রতি ভালোবাসার কারণ। এই কারণ পুরুষ পরম্পরাক্রমে কার্যকরী। মানুষের অন্তরাত্মায় জাতীয় ভাব অতি গূঢ়তররূপে অধিকার করে থাকে। অতএব পরস্পর মিলব আমরা, না মিললে বাঁচবার যো নেই। এমনটি ভাবতে পারলে জাতীয়তা আমাদের মধ্যে সজীব হবে। এমনটা ভাবতে পারলে সেই জাতীয়তা বিনাশ করা সহজসাধ্য হবে না। জাতীয় ভাব পরিগ্রহের পথ কখনোই কোনো অবস্থাতে সংরুদ্ধ হতে পারে না। দরকার অনুশীলন ও সম্বর্ধনের চেষ্টা। হিন্দু সমাজকে আত্মপ্রকৃতি বুঝে চলতে পরামর্শ দিলেন ভূদেব। বললেন, হিন্দুকে সর্বতোভাবে স্বজাতি বিদ্বেষ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। স্বজাতীয় সহনাভূতিকেই পরম ধন মনে করতে হবে।
লেখক ড. বিজয় আঢ্য ১৮৪ পাতার এই বইটিকে পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। তৎকালীন যুগ-পরিবেশ বিবৃত করে রচিত হয়েছে প্রথম অধ্যায়। ভূদেবের ব্যক্তিত্ব ও মানস গঠনের বিস্তারিত বিবরণ পাই দ্বিতীয় অধ্যায়ে। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে ভূদেবের স্বদেশচিন্তা, জাতীয়তা, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং নেতৃপ্রতীক্ষা। চতুর্থ অধ্যায়টি বৃহত্তর। সেখানে ভূদেবের সমাজভাবনা, ধর্মভাবনা, ইতিহাস চিন্তা, অর্থনীতি-বোধ, শিক্ষাচিন্তা, ভাষা সংক্রান্ত মনোভাব ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ের উপসংহার, উল্লেখসূত্র এবং পরিশিষ্টের অন্তর্ভুক্ত ভূদেব লিখিত চিঠি সহ সমগ্র গ্রন্থটিই তথ্যবহুল ও সুখপাঠ্য। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।