পরবর্তীকালে তিনিই হলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি (১৯৫২-৬২)। একাদিক্রমে দুইবার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ [৩ রা ডিসেম্বর, ১৮৮৪ — ২৮ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৩; বি.এসসি (প্রথম শ্রেণি, কলকাতা), এম.এ (অর্থনীতিতে স্বর্ণপদক, কলকাতা), এলএলবি (স্বর্ণপদক, কলকাতা), পিএইচডি (এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়)] -এর কলেজজীবন শুরু কলকাতায়। ১৯০২ সালে তিনি ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই বৎসরই জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘ডন সোসাইটি’ (১৯০২-১৯০৬) প্রতিষ্ঠা হল। তার সক্রিয় সদস্য হলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। তখনও তিনি ছাত্র। প্রেসিডেন্সি থেকে তিনি ১৯০৪ সালে এফ.এ পাশ করলেন। ১৯০৫ সালে প্রথম বিভাগে বিজ্ঞানে স্নাতক হলেন। ১৯০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি অর্থনীতিতে এম.এ করলেন। পরে আইনী পাঠও নিয়েছেন কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ ল’ কলেজ)। বঙ্গভঙ্গের সময়ে যেহেতু তিনি কলকাতায় অবস্থান করছিলেন এবং বাংলা তখন উত্তাল, ১৯০৬ সালে এখনে থাকাকালেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিলেন। জাতীয় পরিষদ গঠিত হলে তার আদর্শে নিজেকে সম্পৃক্ত করালেন। এই পরিষদের পথিকৃৎ সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হল। এক পরম শ্রদ্ধার গুরু-শিষ্য সম্পর্ক।
আচার্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অপর এক ছাত্র ছিলেন সতীশচন্দ্র গুহ। তিনি দ্বারভাঙ্গা রাজার লাইব্রেরিয়ান হন। পরে বিহার বিদ্যাপীঠে যোগ দিয়েছিলেন। সতীশ গুহের কাছেই তাঁর গুরু অকৃতদার সতীশ মুখোপাধ্যায় দ্বারভাঙ্গায় তিন বছর ছিলেন। পরে পাটনাতেও আসেন এবং বসবাস করেন। আচার্য মুখোপাধ্যায়ের অপর শিষ্য রাজেন্দ্র প্রসাদেরও খুব ইচ্ছে ছিল আচার্যকে পাটনাতে এবার স্থায়ীভাবে রাখবেন। রাজেন্দ্র প্রসাদ তখন বিহারের অবিসংবাদিত কংগ্রেস নেতা এবং শিক্ষান্দোলনের পুরোধা। বিহার বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা হল ১৯২১ সালে। মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে ভারতব্যাপী জাতীয় শিক্ষা কেন্দ্রের যে চেইন তৈরি হল, তারই অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠল বিহার বিদ্যাপীঠ। পাটনায় ন্যাশানাল কলেজ প্রতিষ্ঠা তার এমনই এক উদ্যোগ। ১৯২১ সালে পাটনায় কলেজ প্রতিষ্ঠা হল গয়া রোডে একটি ভাড়া বাড়িতে। তা প্রমোট করার দায়িত্ব পেলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। রাজেন্দ্র আইন ব্যবসা ছেড়ে এখানে এলেন এবং অধ্যক্ষ হলেন। ১৯২৮ সালে নিবন্ধিকৃত হল এই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। মনোরম পরিবেশ, আম বাগানের পাশেই গঙ্গা। ১৯৪২ পর্যন্ত তার চেয়ারম্যান থাকলেন। এটাই ছিল রাজেন্দ্রর মূল কর্মভূমি। তারপর অসহযোগ আন্দোলন শুরু হল। ইংরেজ ভারত ছাড়ো। এই প্রাঙ্গন ইংরেজ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিল আন্দোলন ভাঙ্গতে। ১৯৪২ থেকে তিন বছরের জেল হল রাজেন্দ্র প্রসাদের৷ ১৯৪৫ সালে মুক্তি পেলেন তিনি। পরে ১৯৪৬ সালে অন্তর্বতী সরকার গঠিত হলে তার খাদ্য ও কৃষি বিভাগের দায়িত্ব পেলেন। ১৯৪২, ১৯৩৯-এর পর ১৯৪৭ সালে আবার জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হলেন৷। ১৯৪৬-৪৯ সালে সংবিধানের কমিটির সভাপতি হলেন। এরপর ১৯৫০ সালে ভারতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে মনোনীত হলেন তিনি৷ ১৯৬২ সালের মে মাস পর্যন্ত সেই দায়িত্বে থেকে ফের ফিরে এলেন এই বিহার বিদ্যাপীঠের কুঁড়েঘরে। বয়সের ভার তাঁর শরীরে লেগেছে। কুঁড়েঘরে থাকা চলতে পারে না। জয় প্রকাশ নারায়ণ অর্থ সংগ্রহ করিয়ে দিলেন। সেই আম বাগানেই একটি আবাস নির্মিত হল। ১৯৬৩ সালে তাঁর প্রয়াণ ঘটে। তারপর এখানে তৈরি হয় রাজেন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা।
এই রাজেন্দ্ররই প্রারম্ভিক গুরু আচার্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। রাজেন্দ্রর অনুরোধে তাঁর গ্রামের বাড়ি জেরাদইতে কিছুটা সময় অতিবাহিত করলেন সতীশচন্দ্র। পরে তিনি সতীশ গুহকে নিয়ে কাশীতে চলে গেলেন, আমৃত্যু কাশীতেই ছিলেন (১৯৪৮)। আর সতীশ গুহ শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে কিউরেটর হয়ে যান। আচার্য সতীশচন্দ্রকে বাঁধতে পারে নি কলকাতা, বাঁধতে পারে নি পাটনা।
অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং কল্যাণ চক্রবর্তী।