‘শ্রী’ শব্দের অর্থে রয়েছে আশ্রয়, স্বনির্ভরতা। যাঁর দ্বারা সর্বজনের আশ্রয় তিনিই শ্রী; যাঁর দ্বারা আশ্রিত, তিনিই শ্রী। অর্থাৎ যিনি শ্রী হবেন তাঁর আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই, তিনি বরং অন্যকে আশ্রয় দেবেন, স্বনির্ভরতা দেবেন। আশ্রিতের দুর্গতি দূর করবেন। ‘শ্রী’ মানে সম্পদ; ‘শ্রী’ মানে শোভা; ‘শ্রী’ মানে জ্যোতি। দেবী লক্ষ্মীর যে অসংখ্য নাম রয়েছে, তারমধ্যে সবচাইতে প্রাচীন নাম ‘শ্রী’। ঋগ্বেদে ‘শ্রী’ শব্দের ব্যবহার আছে। একটি বার ছাড়া (সেখানে অর্থ ‘সমৃদ্ধি’) ‘পার্থিব সম্পদ’ অর্থে ‘শ্রী’ শব্দটি কখনোই ব্যবহার হয় নি, ‘সৌভাগ্যদেবী’ অর্থেও ব্যবহৃত হয় নি। তখন ‘শ্রী’ শব্দটি ব্যবহৃত হত সৌন্দর্যময় বা শোভাময় বোঝাতে।
এ থেকে মনে হয়, ‘শ্রী’ আর ‘লক্ষ্মী’ এক দেবী ছিলেন না। আলাদা আলাদা দুই দেবী কালের প্রয়োজনে মিশে গেলেন। শ্রী আর লক্ষ্মী দেবী মিলে আবির্ভূত হলেন আজকের দেবী লক্ষ্মী। এখন ‘লক্ষ্মী’ শব্দের অর্থ কি? যার দ্বারা লক্ষিত হয়, তিনিই লক্ষ্মী। জানা যায়, শ্রী ও লক্ষ্মী অভিন্ন দেবী ছিলেন না। দুই পৃথক দেবতা ক্রমে মিলিত হয়ে দেবীলক্ষ্মী হয়েছেন। সেইজন্য লক্ষ্মীকে বলা হয় অভিসৃত দেবী বা Convergent Goddess. শ্রী ও লক্ষ্মী এই দুই সমান্তরাল বা Parallel Goddess মিলে হয়েছেন লক্ষ্মী। আবার দেখা যায়, বিষ্ণুর দশাবতার হচ্ছেন তাঁর Divergent রূপ।
সামজিকভাবে কিংবা কৃষি পরিমণ্ডলে ‘লক্ষ্মী’ কাকে বলি? একটি প্রচল কথা হল, “জলে ভিজ্যা, রোদে পুইড়্যা আনছি ঘরে লক্ষ্মী।” তারমানে কৃষি উৎপাদন মানেই লক্ষ্মী লাভ। গ্রাম বাংলায় ‘ক্ষেত্রলক্ষ্মী’ বা ‘ধান্যলক্ষ্মী’-র নাম পাওয়া যায়। প্রবাদে আছে, “ধান ধন বড় ধন/ আর ধন গাই/ সোনারূপা কিছু কিছু/ আর সব ছাই।” বলা হয় “ধানের আবাদে ধন”। বাংলার কোনো কোনো জায়গায় লক্ষ্মীপুজো কোনো মূর্তি কিংবা পট রেখে হয় না। হয় একটি কুনকের মধ্যে নতুন ধান রেখে, তা লাল শালুতে মুড়ে, কুনকে-তে স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রা বা কড়ি রেখে। কোথাও কুনকের ধানের উপর কাঠের বা পিতলের পেঁচামূর্তি রেখে। এ থেকে বোঝা যায়, ধানই লক্ষ্মী।
যেহেতু ধানের ক্ষেতে ‘অলক্ষ্মী’ পদবাচ্য ইঁদুর মারাত্মক একটি আপদ, তাই ইঁদুর ভক্ষণকারী পেঁচা (শত্রুর শত্রু) সেখানে লক্ষ্মীর প্রতিনিধি। পেঁচা লক্ষ্মীর বাহন হয়েছে এক ধন্যবাদাত্মক চিন্তনের মধ্যে দিয়ে। কোথাও ‘প্যাঁচাই লক্ষ্মী’-র কাঠের মূর্তি ধানের সঙ্গে পূজিতা হন৷
বাংলার অনেক স্থানেই কৃষিজমির আগাছাকে ‘অলক্ষ্মী’ বলা হয়। কারণ আগাছা কৃষিতে অবাঞ্ছিত উদ্ভিদ। তারা মূল ফসলের থেকে সার-জল কেড়ে নেয়, জায়গা দখল করে। মূল ফসলকে ছাপিয়ে তার বিটপ, পত্র-পল্লব সূর্যালোক ভোগ করে, মূল ফসলকে আড়াল করে। কৃষক তাই ‘নিড়িয়ে অলক্ষ্মী’ দূর করেন। তা না হলে অলক্ষ্মীর দাপটে ‘লক্ষ্মীর দান’ বা ধান গোলায় আসবে না৷ ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, “One year seeding is seven year’s weeding.” একবার যদি কোনো আগাছা কৃষিজমিতে ফুল হয়ে ফল ও বীজের পরিপক্বতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়, তবে জমি থেকে সেই আগাছা দূর করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অনেকদিন ধরে জমিতে তার বীজ অঙ্কুরোদগমের ক্ষমতা ধরে রাখে, বারবার তা থেকে আগাছার চারা বের হয় এবং মূল ফসলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। এজন্যই বলা হয়, একবছরের জন্য আগাছা বীজ ঢাললে, সাত বছর নিড়িয়ে তুলতে হয়, তবে সেই আগাছা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অতএব কৃষিজীবী মানুষের কাছে কেবল ইঁদুর নয়, আগাছাও অলক্ষ্মী। এর বিপ্রতীপে কেবল ধানই যে লক্ষ্মী তা নয়, শাকসবজি-ফলমূলও লক্ষ্মী বলে মনে করেন বাংলার কৃষক। খনার একটি বচন আছে, “চাল ভরা কুমড়ো লতা/ লক্ষ্মী বলেন, আমি তথা।” এই বচন প্রমাণ করে খনার সময়ে গ্রাম বাংলা নানান উদ্যানফসলে সমৃদ্ধ ছিল এবং তার চাষ লক্ষ্মীলাভ রূপে গণ্য ছিল। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে সমসাময়িক সময়ে উদ্যানফসল চাষের এত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না, যা খনার বচনে দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলায় দেবী দুর্গার আরাধনায় ‘শাকম্ভরী’ দুর্গাকেও স্মরণ-মনন করা হয়৷ শাকম্ভরী দুর্গা হচ্ছেন দেবীর উদ্যান ফসল হয়ে ওঠার কাহিনী এবং মানুষকে পরিপুষ্টি দিয়ে তার দুর্গতি দূর করা। জীবনে খাদ্য সংগ্রহ ও উৎপাদনই সবচাইতে বড় লড়াই, বড় লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেবী লক্ষ্মীই ভরসা। কৃষি সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছে দেন দেবী। মানুষের মরাই বা গোলা ভরা থাকলে তার অশেষ দুর্গতি দূর হয়৷ দেবীর ‘অন্নপূর্ণা’ রূপ এবং ‘শাকম্ভরী’ রূপের পাশাপাশি তাঁর ধান্যরূপ পাওয়া যায় দেবী মহালক্ষ্মীর মধ্যে।
ভারতবর্ষ প্রাচীন কাল থেকে কৃষি সম্পদে সমৃদ্ধ। তার উদ্বৃত্ত উৎপাদন সে সামুদ্রিক জলযানে ভরে বিশ্বের নানান জায়গায় প্রেরণ করেছে৷ বিনিময়ে সংগ্রহ করেছে বিশ্বের অপরাপর অমূল্য সম্পদ। তাই বলা হয় “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী”। ” বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বাস।” ময়ূরপঙ্খী নৌকায় ভারতীয় পণ্য সমুদ্র পেরিয়ে ধন আহরণ করেছে বলেই ধান্যলক্ষ্মী হয়ে উঠলেন ‘ধনলক্ষ্মী’। কৃষি ও কৃষি-ভিত্তিক বাণিজ্য করেই হয়েছে ধনাগম। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তাঁর ‘নবান্ন’ কবিতায় লিখছেন, “লেপিয়া আঙিনা দ্যায়/আলপনা ভরা মরাই-এর পাশে,/লক্ষ্মী বোধহয় বাণিজ্য ত্যজি’/এবার নিবসে চাষে।” লক্ষ্মী বণিকদেরও দেবী, তিনি কৃষকেরও দেবী, তিনি ব্যবসায়ীদেরও দেবী। বাংলার কোনো কোনো স্থানে দেবীকে পুজো করা নৌকাবাহনা রূপে৷ কলাগাছের পাতার খোল বা মান্দাস থেকে তৈরি করা হয় নৌকা, তারমধ্যে নানান কৃষিপণ্য, অলংকার, মূল্যবান ছোটো ছোটো সামগ্রী, নৈবেদ্য থরে থরে সাজিয়ে দেবীকে আরাধনা করা হয়, যার মধ্যে ফুটে ওঠে বাংলার কৃষি সমৃদ্ধির চিরকালীন পরিচয়। ব্যবসায় প্রচণ্ড আর্থিক ঝুঁকি নিতে হয়, সজাগ থাকতে হয়। সেই থেকেই ব্যবসায়ীদের নিশি জাগরণ এবং অক্ষক্রীড়ার রীতি কিনা সে বিষয়ে আরও গবেষণা করা দরকার৷ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার মধ্যে জাগরণ বা সচেতন মনের প্রসঙ্গ হয়তো লুকিয়ে আছে৷ দীপান্বিতা লক্ষ্মী আরাধনার মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে ব্যবসায়িক অন্ধকার ছাপিয়ে আলোর দিকে যাবার সদর্থক উপাসনা৷ এই দুইয়ের মধ্যেই ধনলক্ষ্মীর আরাধনা সুস্পষ্ট।
এখন এই লক্ষ্মী আরাধনা কী কেবলই বাংলা তথা ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমায়িত? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলার ব্রত’ গ্রন্থে এই লক্ষ্মী উপাসনার বিশ্বরূপ পরিবেশন করেছেন। মেক্সিকোর ‘ছড়াম্মা’, গ্রীক শস্যদেবী ‘টাইকি’, ‘ডিমিটার’, জোরোয়াসস্ট্রিয়ান দেবী ‘আদির্সভঙ্গ’ দেবী লক্ষ্মীর সমতুল্য। হয়তো বাংলার এই লক্ষ্মীর পুজোর ইতিহাস বহু প্রাচীন। আলো-আঁধারি থেকে তার প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনতে হবে। তার সঙ্গে তুলে আনতে হবে সেই ইতিহাস, যেখানে বাংলার হিন্দুরা নানান কারণে যখন প্রতিবেশীর ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন, তখন হিন্দু রমণী কিন্তু গৃহলক্ষ্মীকে একেবারে ফেলতে পারেন নি। জানা যায়, একটি লক্ষ্মী স্মৃতি নীরবে লুকিয়ে কুলুঙ্গিতে তুলে রেখেছেন। আজও তা হিন্দু ঘরানার মিসিং লিঙ্ক রূপেই রয়ে গেছে গৃহ ও মনের হারানো অন্দরে।
পুরাণে দেখা যায়, সমুদ্র মন্থনে অলক্ষ্মীর উৎপত্তি লক্ষ্মীর পূর্বে৷ তাঁর নাম ‘নির্ঋতি’। তিনি কৃষ্ণবর্ণা, তিনি লৌহাভরণা। লোহার মূর্তি ব’লেই তিনি হয়তো লৌহযুগের সমসাময়িক। কিন্তু দেবী লক্ষ্মীর যে রূপ, তাতে তিনি ‘হিরণ্যবর্ণাং হরিণাং সুবর্ণরজাস্রজাম’। তাঁর রঙ টকটকে সোনার মতো, তিনি সোনা ও রূপার গহনা পরিহিতা৷ শ্রী ও লক্ষ্মী যেভাবে জুড়ে লক্ষ্মী হয়েছেন, একইভাবে হয়তো অলক্ষ্মী আর লক্ষ্মী জুড়ে গিয়ে লক্ষ্মী হলেন। একত্রীকরণ বা অভেদ কল্পনা। দ্বৈত থেকে অদ্বৈতর চেতনায় অবগাহন করে উপাসনা। বাস্তুতন্ত্রেও কোনো জীবকে একেবারেই নির্মূল করা যায় না। তাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং এভাবেই সমস্যাকে এড়িয়ে মূল ফসলকে নির্বিবাদে চয়ন করে নিতে হয়। ধানের জমির ইঁদুর যে একেবারেই নিঃশেষ করা যাবে না। কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অনেক কৌমগোষ্ঠীর আমিষ খাবার এই ইঁদুরের মাংস এবং তার গর্তে থরে থরে সঞ্চিত ধান। ধান কাটার পর শাবল-কোদাল নিয়ে মাটির সুরঙ্গ অনুসরণ করে এই ইঁদুর ধরেন কোনো কোনো বনবাসী মানুষ, সংগ্রহ করেন মূষিকে নিয়ে আসা ধান। এভাবেই ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য বজায় থাকে। বাংলা ও ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও ধানের জমির নানান তণ্ডুল জাতীয় আগাছার বীজ সংগ্রহ করে তার চাল খেয়ে বাঁচেন গরীব মানুষ। যেমন শ্যামাধান, কাউনধান, নানান মিলেট জাতীয় আগাছা। কোথাও জল ও সারের অভাবে সেই আগাছাই আংশিকভাবে চাষ করে দুর্ভিক্ষ দূর করে লোকসমাজ। তারাই হয়তো বহু প্রাচীনকাল থেকে মিলিয়ে দিয়েছেন লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর এই ধারণা। পৃথিবী অলক্ষ্মী বলে যা আছে, তা হল আমাদের সমাজের বিড়ম্বনা, আমাদের ধর্মীয় বিপ্রতীপের চিত্র। আজকের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা সমগ্র হিন্দুজাতির এক ভারসাম্যের প্রকৃতি পূজা, সামাজিক মেলবন্ধনের উপাসনা। এই পুজো দীর্ঘজীবী হবেই।
তথ্যসূত্র
বন্দ্যোপাধ্যায় ম. এবং চক্রবর্তী ক. ২০০৪, প্যাঁচাই লক্ষ্মী — ইঁদুর অলক্ষ্মী, লোকসংস্কৃতি গবেষণা ১৭(২): ৩২৪-৩৩৫
বন্দ্যোপাধ্যায় ম. ২০০৪, প্যাঁচা থেকে লক্ষ্মীর রূপান্তর: পূর্ব পাঠের সংকলন, লোকসংস্কৃতি গবেষণা ১৭(২): ২৭৯-২৮৫
অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।