কল্পতরু অর্থাৎ কিংবদন্তীর সেই গাছ যার কাছে যা চাওয়া হয় তাইই পাওয়া যায়। অর্থাৎ যিনি তার প্রার্থীদের সমস্ত চাহিদা পূরণ করেন তিনিই কল্পতরু। কল্পতরু উৎসবের ইতিহাস ভারতের সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। এটি আমাদের দেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটি উৎসব। জানা যায় যে গৌতম বুদ্ধের সংসার ত্যাগের ঘটনা স্মরণ করে বৌদ্ধ রাজারা বছরে একবার করে কল্পতরু হতেন। সেই সময় তাঁর কাছে যে যা চাইতো তিনি তাই দিয়েই সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করতেন। পরবর্তীতে স্বাধীন হিন্দু রাজারাও কল্পতরু উৎসব শুরু করেন। ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী শেষ কল্পতরু রাজা হয়েছিলেন যশোহর রাজ প্রতাপ আদিত্য। যার বীরত্বের স্মৃতিতে পরবর্তীতে বাঙ্গালী কবি লিখবেন –
এক হাতে মোরা মগেরে রুখেছি‚ মোগলেরে আর হাতে।
চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লি নাথে।
প্রসঙ্গত এই প্রতাপ হলেন মহারাজা প্রতাপাদিত্য এবং দিল্লি নাথ হলো মুঘল শাসক আকবর।
তবে আজকের কল্পতরু উৎসব সেই কল্পতরু উৎসবের থেকে অনেকটাই আলাদা। এটি মূলত ঊনবিংশ শতকে বাঙ্গালী হিন্দুর নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রামকৃষ্ণদেবের স্মৃতি বিজড়িত আধ্যাত্মিক উৎসব। কথিত আছে যে এই দিনেই অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি রামকৃষ্ণদেব নিজের অবতারত্বের কথা শিষ্যদের কাছে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এছাড়াও সেদিন তিনি শিষ্যদের আধ্যাত্মিক অনুভূতির অভিজ্ঞতাও দান করেন। সেই ঘটনাকে স্মরণে রেখেই প্রতি বছর এই দিনে কল্পতরু উৎসব পালন করা হয়। প্রধানত রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের অনুগামীদের উৎসব হলেও বর্তমানে এই উৎসব আপামর বাঙ্গালীদের উৎসবে পরিণত হতে চলেছে।
১৮৮৫ সালের প্রারম্ভেই রামকৃষ্ণ আক্রান্ত হন ক্লার্জিম্যান’স থ্রোট রোগে। ক্রমে এই রোগ বাড়তে বাড়তে গলার ক্যানসারের আকার ধারণ করে। ফলে চিকিৎসার জন্যে রামকৃষ্ণকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে। সেখানে বিশিষ্ট চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁর চিকিৎসায় নিযুক্ত হন। অবস্থা সংকটজনক হলে ১৮৮৫ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় কাশীপুরের এক বিরাট বাগানবাড়িতে।
এখানেই এই দিনেই শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেকে কল্পতরু হিসেবে ঘোষণা করেন। জানা যায় যে কাশীপুর বাগানবাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে ১ জানুয়ারি সকালবেলা গিরিশচন্দ্র ঘোষকে নিজের অবতারত্ব বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন তিনি!
গিরিশ ঘোষ প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, – ‘‘ব্যাস-বাল্মিকী যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেনি, এই অধম গিরিশ তাঁর কি বলবে।’’
রামকৃষ্ণ প্রায় সমাধিস্থ অবস্থায় বলেন
— ‘‘তোমাদের কি আর বলবো, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হউক।’’
এই সময়েই তিনি উপস্থিত গৃহী ভক্তদের বুক পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। সেই স্পর্শে প্রত্যেকেই অভূতপূর্ব অলৌকিক অনুভূতি লাভ করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন উপস্থিত গৃহী ভক্ত ও অন্যান্য ঠাকুর-ঘনিষ্ঠরা।
এই দিনটি তাই ভক্তদের কাছে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে অসীমের সাথে নিজেকে একাত্ম করে নেওয়ার অনুষ্ঠানে। এই দিনটিকে তাই ‘কল্পতরু দিবস’ হিসেবে জানেন সবাই। কিন্তু মনে রাখা উচিৎ যে এই প্রাপ্তি কোনও জাগতিক চাওয়া পাওয়ায় আবদ্ধ নয়। এই প্রাপ্তি একান্তই আধ্যাত্মিক!
যা নিহিত আছে রামকৃষ্ণদেবের এই বিখ্যাত আশীর্বাদে – “চিন্ময় চৈতন্য সত্তার জাগরণের আশিস”!