ফলন কেবল বাড়ালেই চলে না। ফলনের গুণগত মান বৃদ্ধি করাটাও এক কৃষিকৃত্য এবং অর্থকরী উদ্যোগ, যাতে কৃষি পণ্য বিক্রি করে বাজারে দাম বেশি পাওয়া যায়। বাংলার উদ্যানে, জমি জিরেতে আমরা অনেকসময়ই দেখেছি নিখুঁত, নিষ্কলুষ, সুপুষ্ট ফল পাবার জন্য কৃষেকরা সাদা ন্যাকড়া জড়িয়ে, সুতো দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন। দেবতার ভোগে উৎকৃষ্ট ফল দেবার জন্য, বিশেষ অতিথির জন্য উপহারের ডালি সাজাতে অথবা বীজ সংরক্ষণের জন্য কীটদষ্ট ফল এড়াতে এমন প্রচেষ্টা অনেক চাষী বহুদিন ধরেই করে আসছেন। অর্থাৎ এ ছিল অনেকটা কৃষকের দেশীয় জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক কৃষিকৃত্য। লিচুর ক্ষেত্রে এমন প্রচেষ্টার উন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ হয়েছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে বিহারে অবস্থিত জাতীয় লিচু গবেষণা কেন্দ্র, মুজফফরপুরে (NRC, Litchi, Mushahari, Muzaffarpur). তারই গবেষণালব্ধ সদর্থক ফলাফল ভারতের নানান জায়গায় প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহনপুর ফল গবেষণা কেন্দ্র (BCKV, Mohanpur)-এও করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এটি সর্ব ভারতীয় সমন্বিত ফল গবেষণা প্রকল্পের একটি শাখা কেন্দ্র (ICAR-AICRP on Fruits)। পরীক্ষায় সার্বিকভাবে দেখা গেছে ঢাকা ব্যবহার না করার চাইতে ব্যাগিং করলে বা ঢাকা ব্যবহার করলেই বরং ফলের ওজন বাড়ে, ফলন বাড়ে এবং সেই সঙ্গে গুণগত মান তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
পরীক্ষাটি করবার জন্য মোট সাতটি ট্রিটমেন্ট বা প্রয়োগ-ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। মোট পঁয়ত্রিশটি গাছ বরাদ্দ ছিল একটি লিচু বাগানে। প্রতিটি ট্রিটমেন্টের জন্য পাঁচটি করে বোম্বাই জাতের লিচুগাছ ছিল বরাদ্দ। গাছের বয়স সবক্ষেত্রেই ১২ বছর। একাদিক্রমে চার বছর ধরে এই পরীক্ষা গাঙ্গেয় নবগঠিত পলিমাটি এলাকায় নদীয়া জেলার গয়েশপুরের গবেষণা ফার্মে সম্পন্ন করা হয়। ট্রিটমেন্ট গুলি ছিল এইরকম —
১. গুটি ধরার ১৫ দিন পর সাদা পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ দিয়ে ফলের গুচ্ছগুলি আলাদাভাবে ঢাকা।
২. গুটি ধরার ২৫ দিন পর সাদা পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ দিয়ে ফলের গুচ্ছগুলি আলাদাভাবে ঢাকা।
৩. গুটি ধরার ৩০ দিন পর সাদা পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ দিয়ে ফলের গুচ্ছগুলি আলাদাভাবে ঢাকা।
৪. গুটি ধরার ১৫ দিন পর গোলাপি পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ দিয়ে ফলের গুচ্ছগুলি আলাদাভাবে ঢাকা।
৫. গুটি ধরার ২৫ দিন পর গোলাপি পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ দিয়ে ফলের গুচ্ছগুলি আলাদাভাবে ঢাকা।
৬. গুটি ধরার ৩০ দিন পর গোলাপি পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ দিয়ে ফলের গুচ্ছগুলি আলাদাভাবে ঢাকা। এবং
৭. ফলের গুচ্ছ না ঢেকে উন্মুক্ত রাখা।
পরীক্ষার সিদ্ধান্ত মোটামুটি এইরকম — লিচুর গুণগত মান বাড়ানোর জন্য ফলের গোছা বিশেষ ধরনের ব্যাগে ঢাকতে হবে। যদি গোলাপি রঙের পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ দিয়ে গুটি ধরার ২৫ দিন পর লিচুর ফলগুচ্ছকে ঢেকে দেওয়া হয়, তবে সবচেয়ে গুণমানে উৎকর্ষ ফল পাওয়া যাবে। এতে ফলের আকার (Fruit size) কিছুটা বাড়বে, শাঁসের অম্লভাব (Acidity) কিছুটা কমবে, শাঁসের মোট দ্রবণীয় কঠিনের পরিমাণ (TSS) বাড়বে। সেইসঙ্গে লিচুর ফল ফেটে যাওয়া (less fruit cracking), সানবার্ণ বা রোদে ঝলসে যাওয়া (less Sunburn) এবং ফলছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ (less borer infestation) সম্ভাবনাও কমবে। যেহেতু বোম্বাই (Bombai) জাতের লিচুর অর্থকরী চাষ করা হয় পশ্চিমবঙ্গে, তাই এই জাতটিকেই পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছিল। এই জাতের আকর্ষণীয় কার্মিন রেড (Carmine red) বা গাঢ় লালবর্ণের ফল হয়। এই ব্যাগিং-এর ফলশ্রুতিতে সেই আকর্ষণীয় রঙ পাওয়া গিয়েছিল। সাদা রঙের পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ গুটি ধরার ২৫ দিন পর ব্যবহার করলেও কাছাকাছি ফললাভ হয়।
অতএব লিচুর গুণমানে উন্নত ফল পাবার জন্য, সেই ফল বিক্রি করে বেশি আয় করবার জন্য উপযুক্ত সময়ে গুটি ধরার পর ব্যাগিং করতে হবে বা ফলের গুচ্ছ ঢেকে দিতে হবে। এ রাজ্যের ফলচাষীদের জন্য এই সুপারিশ করা হচ্ছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা কেন্দ্র থেকে। অধিক জানবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা প্রকল্পের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। Fruit Research Station, ICAR-AICRP on Fruits, BCKV, Mondouri (Mohanpur), Nadia, West Bengal.
ড. দেবলীনা মাঝি এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।