আরবের বিরুদ্ধে ইউরোপের এক মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র ‘বিজ্ঞান’
জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈপরীত্যের পাশাপাশি আরব দুনিয়া ও খ্রীষ্টিয় ইউরোপের মধ্যে সম্পদের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পার্থক্য ছিল।তাই ক্রুসেড কে শুধুমাত্র উপাসনা-পদ্ধতিগত (Religious) সংগ্ৰাম বললে ভুল বলা হবে। নিঃসন্দেহে ক্রুসেড একটি বিশেষ উপাসনা পদ্ধতির সমর্থনে তৈরি হওয়া উন্মাদনা কিন্তু এর পেছনে যারা ছিলো তাদের লক্ষ্য কি শুধুই নিজস্ব উপাসনা-কেন্দ্রিক স্বার্থ ছিল ? আসলে , সেইসময়ে ইউরোপের দারিদ্র্য আর আরবের ঐশ্বর্য ক্রুসেডের একটা কারণ অবশ্যই ছিল।যে কোনো রাজনৈতিক ঘটনার ফল , তার উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে সঠিক দিশা দিতে পারে। ফল যাই হোক না কেনো , প্রত্যেক ক্রুসেডের পরে চার্চের সম্পত্তি বেড়ে যেতো। আরবীয় সাম্রাজ্যের সীমানায় খ্রীষ্টিয় ইউরোপ যেনো ধাক্বা দিচ্ছে সেসময়।
খিলাফত সাম্রাজ্য স্পেনের কর্ডোবাতে ধাক্বা পায়। ধীরে ধীরে কর্ডোবা খ্রীষ্টানদের নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে এবং আরবীয় সাম্রাজ্যে গড়ে ওঠা টলেডো লাইব্রেরী ১০৮৫ খ্রীষ্টাব্দে খ্রীষ্টানদের অধিকারভুক্ত হয়। ততদিনে খ্রীষ্টিয় ইউরোপ বুঝতে পেরেছে সমৃদ্ধির জন্য বাইবেলের বাইরের জ্ঞান তাদের প্রয়োজন। এমনকি মুসলিম ছাত্রের ছদ্মবেশে একজন খ্রীষ্টান গুপ্তচর(Adelard of Bath) জ্যামিতির সুপরিচিত গ্ৰন্থ Elements কে আরবী থেকে ল্যাটিনে অনুবাদ করে।যদি বলা হয় আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী পুড়িয়ে খ্রীষ্টিয় দুনিয়ায় অন্ধকার যুগ শুরু হয়েছিল তাহলে অন্ধকার যুগের অবসান শুরু হয় ১১২৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে টলেডো লাইব্রেরীর বইগুলোর ল্যাটিন ভাষায় ব্যাপক অনুবাদের মাধ্যমে।
খ্রীষ্টিয় ইউরোপের ‘অন্ধকার যুগ’ এর সময় যে ভুল হয়েছিল এবার আর তা করলো না ইউরোপ। ইসলামীয় আরব কে দেখে খ্রীষ্টিয় ইউরোপ উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে উপাসনা পদ্ধতির সঙ্কীর্ণতার বাইরে যে জ্ঞান-সমুদ্র সেখানে তরী ভাসালেই সম্পদের উৎস পাওয়া যায় ।
তাই আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর মতো টলেডোর লাইব্রেরী কে পুড়তে হলো না।
শুধুমাত্র পার্থিব সমৃদ্ধির জন্যই চার্চ বাইবেল-বহির্ভূত জ্ঞানের খোঁজ করছিল না , চার্চের জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল অন্য আর একটি কারণে।গ্ৰীক-রোমান সাম্রাজ্যে মূর্তি পূজকদের(Pagans) যেভাবে শক্তি প্রয়োগে উপাসনা পদ্ধতির পরিবর্তন করানো গেছে , এখন শক্তিশালী আরবদের ক্ষেত্রে সেই একই পন্থায় কাজ হবে না। ইসলামীয় আরবের উপাসনা পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্যে দরকার বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে নিজেদের উৎকৃষ্টতা প্রমাণ করা। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে চার্চের লড়াই সেই ইসলামীয় দুনিয়ার আরবীতে লিখিত বইগুলোর জ্ঞান , চার্চ কেমন করে আপন করবে ? এতে করে বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে আরবীয়দের উৎকৃষ্টতাকেই স্বীকৃতি দিতে হয়।
তাই শুরু হলো ইতিহাস কে বা বলা ভালো বিজ্ঞানের ইতিহাস কে নিজেদের সুবিধামতো বিকৃত করা।
কনস্ট্যানটাইন এর খ্রীষ্টের উপাসনা-পদ্ধতি গ্ৰহণের মাধ্যমে চার্চ আর স্টেটের (রাজশক্তি) মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।এই সময়েই চার্চের ঐতিহাসিক ইউসিবিয়াস(Eusebius) চার্চের স্বার্থে ইতিহাস বিকৃত করার কাজ শুরু করে ।এর পরে ওরোসিয়াস(Orosius) নিজের লেখা ‘History Against the Pagans’ বা বলা ভালো বিকৃত ইতিহাসের মাধ্যমে , ইতিহাস কে চার্চের নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। বর্তমানেও আমরা দেখি সংবাদপত্র , নিউজ চ্যানেল কে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের পক্ষে জনমত তৈরিতে সক্রিয় হতে ।সঠিক ইতিহাস লুকিয়ে রাখা বা ইতিহাস কে বিকৃত করার ঘটনাও আমাদের কাছে নতুন নয়। কিন্তু এটা ভেবে অবাক হতে হয় যে এই অস্ত্রের সফল এবং সুদূরপ্রসারী প্রয়োগ হাজার বছর আগেই শুরু হয়ে থাকলে ; বিগত ২০০০ বছরে কোনো একটি সভ্যতা-সংস্কৃতি , কোনো একটি মতাদর্শের বিলুপ্তি বা জাগরণ প্রকৃতিগত বা মানবসভ্যতার স্বাভাবিক প্রয়োজনে হয় নি , হয়েছে মানবনির্মিত এক অস্ত্রের প্রয়োগে যার নাম – ইতিহাস বিকৃতকরণ। পারমাণবিক বোমার মতো প্রচন্ড শব্দ-তাপে এই অস্ত্রের বিস্ফোরণ হয় না , এই অস্ত্র প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিঃশব্দে কাজ করে যায়।
বিজ্ঞানের ইতিহাস কে বিকৃত করা শুরু হলো বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে নিজেদের উৎকৃষ্ট প্রমাণ করে খ্রীষ্টিয় উপাসনা পদ্ধতির প্রসার করার জন্য।বলা হলো , ইউরোপের ৬০০ বছরের অন্ধকার যুগের সময় আরব শুধুমাত্র গ্ৰীকদের বিজ্ঞান কে সংরক্ষণ করেছে এবং সেই বিজ্ঞানের একমাত্র উত্তরাধিকারী খ্রীষ্টিয় ইউরোপ।
যে জ্ঞান কে ইউরোপ নিজের বলে দাবি করলো তার আসল উৎস ; সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মদাতা শিক্ষা ও সংস্কৃতি , সেই সমাজের জীবন পদ্ধতি জানার প্রয়োজনীয়তা ইউরোপ উপলব্ধি করে নি। সংকীর্ণতা ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বইয়ের অনুবাদ যেনো ইউরোপের ঘুম ভাঙ্গালো ।
[তথ্যসূত্র অন্তিম পর্বে দেওয়া হবে]
পিন্টু সান্যাল (Pintu Sanyal)