নোয়াখালির সেই বিভীষিকাময় কালো রাতঃ…

দিকে উঠে আসছে। ছাদ ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। এদিকে শিশুদের আকুল ক্রন্দন আমাদের দিশেহারা করে দিচ্ছিল। তখন আমি ও বাড়ির কয়েকজন বধূ এবং মেয়েরা একত্রে হাত জোড় করে উঠে দাঁড়ালাম। এবং বলতে লাগলামঃ “এই শিশুগুলিকে রক্ষা কর। তোমাদেরও ছেলেমেয়ে আছে বাড়িতে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে এই নিরাপরাধ শিশুগুলিকে বাঁচাও। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করবেন”।
তখন বয়োজেষ্ঠ্যদের মন একটু নরম হল। কিন্তু যুবকরা থামতে চায় না। তখন বড়রা তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদের একটু থামালো। কিন্তু আগুন নেভাবে কি করে? আমরাই তখন লঙ্কা-গোলা জল ঢেলে ফেলে, গামলা, বালতি, ঘড়া সব নিচে ফেলে দিলাম। দালানের সামনেই একটা বড় পুকুর ছিল। তারা পুকুর থেকে জল তুলে তুলে এনে আগুন নেভাতে লাগল।(পাঠকবৃন্দ, এই আগুন নেভানোর ব্যাপারটাকে যেন আক্রমণকারীদের ঔদার্য্য ভেবে ভুল না করেন, কারন এই আগুন নেভানোর পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল বাড়ির মেয়ে-বৌ’দের জ্যান্ত ধরে নিয়ে গিয়ে নিকা করা, অরক্ষিত মূল্যবান দ্রব্য লুঠ আর পুরুষদের কোতল করা) আগুন একটু নিভলে ওরা ওদের তৈরি করা মই দিয়ে ছাদের উপরে উঠতে লাগল। এবং সবাই কে নাবাতে লাগল। আমরা তখন ছোটদের ওদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। ওদের ধর্মের দোহাই দিয়ে ওদিকে আরেকদল লোক লুঠপাঠ করতে লাগল। এমনকি মেয়েদের নাকের নাকছাবি, কানের দুল সব নিজেরাই খুলে খুলে কেড়ে নিতে লাগল।
আরেক দল ছেলেদের নিচে নামিয়েই ওদের পরনের বস্ত্র দিয়ে ওদের হাত-পা কষে কষে বেঁধে ফেলতে লাগল। আমি নিচে নেবে ছোট আর সেজছেলেকে দেখতে পেলাম না। ছোটর বয়স চার আর, আর সেজোর আট। মেয়ের বয়েস ছয়। মেয়ে তখন মাটিতে বসে পড়ে কাঁদছে। একমাত্র মেয়েকে ওখানে অর্থাৎ পুকুর পাড়ে দেখতে পেলাম। মেয়েদের ওখানে একজায়গায় জড়ো করে বসিয়ে রেখে মুসলমানেরা ঘিরে রেখেছে যাতে কেহ কোথাও পালাতে না পারে। আমিও ওখানে বসে রইলাম। বড় দুই ছেলে তখনও ছাদ থেকে নামেনি। ছাদের সঙ্গে লাগোয়া একটা বড় নারকেল গাছ ছিল। গাছটা অনেক আগেই কেটে ফেলবে বলে ঠিক হয়েছিল, কারন ঐ গাছ বেয়ে মুসলমানরা ছাদের উপরে উঠতে পারে বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সময় ও ব্যস্ততার কারনে গাছটি আর কাটা হয়ে ওঠেনি। শেষমেশ সেই গাছটি-ই এখন কারো কারো রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়াল। সে রকম আমগাছ, পুকুরের কছুরিপানাও। এদিকে বাড়ীতে এক ভীষণ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। আমার বৃদ্ধ শ্বশুর এতক্ষণ নাতি-নাতনিদের নিরাপত্তায় ব্যস্ত ছিলেন; নিজের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। হঠাৎই ছাদের আগুনের মধ্যে পড়ে গেলেন। এক মুহূর্তেই ছটফট করতে করতে সব শেষ। এই ঘটনায় আমরা সবাই অসহায়ের মত দাঁড়িয়েই রইলাম। প্রতিকারের কিছুই করতে পারলাম না – হায়!
এদিকে রাজেন্দ্রলাল হাজার হাজার টাকা যাকে সামনে পেলেন বিলোতে লাগলেন সবার প্রানের বিনিময়ে। তার স্ত্রী নিজের গায়ের গহনা একে একে খুলে খুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল। ওরাও একদল নিয়ে গিয়ে আরেকদলকে পাঠিয়ে দিল। মনে হল ওরা এতে খুবই মজা পেয়েছে। ওরা হর্ষোল্লাস করছে। অবশেষে ঘরের এককোনে একা ‘রায়সাহেব’ রাজেন্দ্রলাল। নরপশুরা তখন তার মাথা কেটে নিয়ে লাথি মেরে ফুটবলের মত খেলতে লাগল মহা আনন্দে। আবার সেই মাথা নিয়ে রান্না বাড়ীতে রক্ত ছড়িয়ে দিতে লাগল। রক্তে রক্তে সব লালে-লাল একাকার হয়ে গেল। তারপর, নিজেদের পরনের বস্ত্র দিয়ে হাত-পা বাঁধা বেটাছেলেদের রাম-দা দিয়ে এলোপাথাড়িভাবে কোপাতে শুরু করল। সে কি বীভৎস দৃশ্য! চিৎকার, আর্তনাদ, কান্না – এক বীভৎস অবস্থা! একেবারে কেটে না ফেলে কষ্ট দিয়ে মারাই যেন উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র। অনেকক্ষণ পরে আর আওয়াজ নয়, এবারে শোনা যেতে লাগল কেবল গোঙানি।
ভগবানের কি অসীম করুণা! এতসব বিসদৃশ্য দৃশ্য দেখেও মাথা আমার ঠিকই রইল, বিকৃত হয়নি। আমার মেয়ের পাশে একটা মুসলমান ছেলে দাড়িয়্যে ছিল। “আপনারা আমাদের নিয়ে কি করবেন”?- আমি কোন কিছু না দেখেই জিজ্ঞাসা করলাম। ছেলেটি বলল – “আপনাদের নিয়ে গিয়ে নিকা করব”। আমি বললাম – “চুপ চুপ”! মেয়ে তো এই শুনে কেঁদেই উঠল। আমি তখন মেয়ের কথা ভেবে পাগল প্রায়। তবু মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম। আমার মেয়ের তখনও বিয়ে হয় নি। আঁতকে উঠলাম। আমাকে মরতেই হবে। মুসলমানের ঘর! তাঁর চেয়ে মৃত্যুই অনেক ভালো। ভাবলাম সামনের পুকুরেই ডুব দিয়ে জল খেয়ে মরবো। এই ভেবেই আমি এক লাফ দিয়ে পুকুরের জলে ঝাঁপ দিলাম। অমনি মুসলমানরা হই হই করে উঠল। ও নারকেলের ডাল জলে ডুবিয়ে খুঁজতে লাগল। পুকুরটা পানায় ভর্তি ছিল। আমি পুকুরে ডুব দিয়ে মরবার জন্য প্রথমে অনেক জল খেয়েছিলাম। কিন্তু ভালো সাঁতার জানার জন্য একেবারে ডুবে গেলাম না। বরং ডুব সাঁতার দিয়ে মাঝখানে চলে এলাম। এবং নাকটা পানার মধ্য দিয়ে জলের উপরে রেখে পানার তলায় ডুবে রইলাম। ওরা মশালের আগুনে পুকুরের চারধারটা খুঁজে-টুঁজে না পেয়ে চলে গেল। আমাকে খুঁজে পেল না। কিছুক্ষন পরে একটা বাঁশির শব্দ শোনা গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে তারা লুঠের মাল ও মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমিও আস্তে আস্তে জল থেকে উপরে উঠলাম। কোথাও কেহ নেই। মাঝে মাঝে মুমূর্ষ মানুষগুলির আর্তনাদ। আর গোঙ্গানি শোনা যাচ্ছিল। আর বাড়ির গৃহপালিত পশু, পাখিগুলোও আগুন দেখে ছোটাছুটি, চিৎকার শুরু করছিল।
গরুগুলি হাম্বা হাম্বা, হাঁসগুলি কট কট, কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ-সে কি বিকট শব্দ। এই বিশাল প্রেতপুরীর মধ্যে আমি রুদ্ধশ্বাস দাঁড়িয়ে। আমি জীবন্ত না কি মৃত এই প্রেতপুরীতে? আমি নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ইচ্ছা হল প্রাণপন চিৎকার করি, কিন্তু আমার চিৎকার শুনবে কে? তবে প্রানপনে ছুটে পালাবো। কিন্তু কোথায় পালাবো ? দেশের পথঘাট কিছুই জানা নাই। ভয়-আতঙ্ক যেন আমার গলা টিপে ধরেছে।
না, এবারে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরব। আগুনের অভাব নাই। স্থানে স্থানে দালান কোটা জ্বলছে পুড়ছে। প্রচন্ডভাবে আগুন জ্বলছে এমন একস্থলে গিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়ালাম; ঠাকুরের কাছে বিদায় নিলাম। মনে মনে ভাবলাম- আমার একপিঠ ভিজা চুল, পরনে ভিজা শাড়ি, জামা গায়ে আগুনে ঝাঁপ দিলে আগুন নিভে যাবে না তো! এ রকম সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যেই এমন সময় পিছন থেকে পরিচিত গলা শোনা গেল, কাকিমা নাকি? আমি অবাক হয়ে পিছন ফিরে বললামঃ ননি তোরা কোথা থেকে এলি? কি করে বাঁচলি?
“ও সে পরে বলব। এখন শীঘ্রি করে আমাদের সঙ্গে আসুন”।আমার এক ভাসুর পো ও তাঁর নব বিবাহিত বউকে নিয়ে আমরা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে জল জঙ্গল পার করে এগিয়ে চললাম। সদর রাস্তা দিয়ে যেতে পারছি না। ভয়, ওরা যদি আবার দেখে ফেলে। যেতে যেতে ভাসুর পো বললঃ কাকিমা টগর গোলাপ প্রভৃতি বেঁচে আছে। ওরা গাছে থেকে নেমে এ পথেই গেছে। আমি জঙ্গল থেকে দেখতে পেয়েছি। আমরা কিছুক্ষন পথ হাঁটার পর এক বারুই বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ওরা আমাদের দেখে অবাক; কারন ওরা ধারনাই করতে পারে নি যে, ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির কেহ ওদের বাড়িতে আসতে পারে। তাছাড়া ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির গণহত্যার খবর ইতিমধ্যে চাউর হওয়াতে ওরাও জেনে গিয়েছিল। তাই কিছুটা অবাক, কিছুটা ভয়-সংকোচ, কিছুটা ইতস্ততের মধ্যেই আমাদের নিয়ে কি করবে, কোথায় নিয়ে বসাবে, – সেই নিয়েই অস্থির হয়ে উঠল। পাটি পেতে দিয়ে ঘরের এক আড়ালে বসতে দিল। তারপর রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করতে শুকনো গাছের ডাল, পাতা জোগাড় করতে লাগল। ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির দাঙ্গার খবর ইতিমধ্যেই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ায় ওরা সবাই আমাদের কাছে দেখে তটস্থ হয়ে পড়েছিল।
গ্রামের অনেক বাড়িত ছেলেরাই দলে দলে দাঙ্গাবিধ্বস্ত বিখ্যাত ‘রায়চৌধুরী’ জমিদার বাড়ি দেখতে যাচ্ছে বলে শুনলাম। আমাদের গ্রামে বেশ কিছু বারুই বাড়ি ছিল। তাদের সকলেরই প্রায় পানের বরজ ছিল; অবস্থাও প্রায় স্বচ্ছল ছিল। ধন-মান, শিক্ষাদীক্ষায় সম্মানিত ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির লোকেদের ওরা খুব সমীহ করত। সারাদিন আমাদের খুব যত্ন করে রাখল। ভালো ভালো রান্না করে খেতেও দিল। তারপর বলল, “আপনাদের বাড়ির দুটি ছেলে আমাদের পাশের বাড়িতে রয়েছে।দেখলে নিশ্চই চিনবেন”। আমি ওদের ডেকে আনতে বললাম। ওদের ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ছুটে এল। এই যে আমার টগর ও গোলাপ। ওরাও আমাকে দেখেই মা মা করে ছুটে আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর প্রচন্ড কাঁদতে লাগল। আমিও কেঁদে উঠলাম। কারন বাড়ির এত এত ছেলেমেয়ে, স্বামী ইত্যাদি কে কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে, কিছুই জানি না। তাঁরা কেউই আদৌ বেঁচে আছে কিনা, তাও জানা নেই। ওদের ঠাকুরদাদা ছাদেই আগুনে পড়েছিল- ওরা দেখেছিল। ওদের বাবা দাঙ্গার আগেই ছাদ থেকে নেমে পড়েছিল। অন্যান্যদের অবস্থাও কি তাঁর সবটা দেখাও হয় নি। তাই নানান ভাবনা আশঙ্কা মনের মধ্যে বারে বারেই উঁকি দিচ্ছিল। এইওরকম সমস্ত বিষয় আলোচনা করতে করতে একই বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদে কেটে একত্রে পড়ে রইলাম। এইভাবে রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়ে আসল।

ভোর হতেই দেখি দলে দলে মুসলমানরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখতে লাগল, ‘রায়চৌধুরী বাড়ির লোকজনরা কোন কোন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের তারা খুঁজতে লাগল। ফলে আমরা আরো ভয় পেয়ে গেলাম। শিটিয়ে রইলাম, “তবে ওরা কি আমাদের ’রায়চৌধুরী’ বাড়ির কাউকেই ছাড়বে না? তবে কি যাদের কোন খোঁজখবর পাচ্ছি না, তাদের কি ওরা ছাড়েনি? ওদের হাত থেকে মুক্তি পায়নি তারা?” এরকম শত শত চিন্তায় মাথা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।দেখলাম বারুই বাড়ির লোকজনও আমাদের নিয়ে’ দুশ্চিন্তায় পড়েছে। যদিও দাঙ্গায় ওদের কোন ক্ষতি, হয়নি; কেননা দাঙ্গার কেন্দ্ৰবিন্দু ছিল আমাদের ‘রায়সাহেব’ রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর জমিদারি, তাই আমরাও ঠিক করলাম বাড়ির ভিতর লুকিয়ে থাকাটাই শ্রেয়। আমাদের জন্যই এখন ওদের বিপদ। এমনিতেই তারা হিন্দু, তার উপর আবার ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির লোকজন উপস্থিত। তাই, কখন কি হয় কিছুই বলা যায় না। তাই, আমরা ঠিক করলাম যে, তাদের বাড়ির একটু দূরে যে প্রকান্ড একটা জঙ্গল ছিল-ভীষণ জঙ্গল বাইরে থেকে ভিতরে কিছুই দেখা যায় না, —তাতেই লুকিয়ে থাকবো। সেই মত আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন ভোরের আলো ফোটার আগেই অন্ধকার থাকতে থাকতেই জঙ্গলে চলে আসলাম। ওরা কিছু মুড়ি, গুড়, বড় একটা জলের জগ, একটা বড় পাটি দিয়েছিল। তাই নিয়ে আমরা সারা দিন ভয়ে ভয়ে বসে কান্নাকাটি করেই কাটালাম। মাঝ মাঝে বৃষ্টিও হতে লাগল। ভয় হত খুব- সাপটাপ না কামড়িয়ে দেয় আবার। সে যে কি কষ্ট! জমিদার বাড়ির মেয়ে-বৌ আমরা, কোনদিন কষ্ট কি বুঝিনি- এখন তা বুঝতে পারছি । এই ভাবে সারাদিন জঙ্গলে কাটানোর পর একটু অন্ধকার হলে ওরা আমাদের বাড়ি নিয়ে যেত। বাড়িতে আমাদের জন্য ওরা আগে থেকেই রান্নাবান্না করে রাখত। গেটের মুখে আমাদের জন্য হাতমুখ ধোয়ার জল, একপ্রস্থ কাপড়, জামা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে রাখত।তারপর আবার একখানা করে কাপড় দিয়ে বিছানা করে আমাদের শুইয়ে দিয়ে তবে তারা খেতে বসত। তাঁদের আন্তরিকতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের মন ভরে গিয়েছিল। কৃতজ্ঞতায় – আমাদের হৃদয় পরিপুর্ন হয়েছিল। এই বিপদে ওরাই যেন আমাদের একমাত্র ভরসা। নিজেদের বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে আমাদের সেবা ও রক্ষা করে যাচ্ছে।
তারপরেই জানতে পারলাম যে, ঐ পাড়াতেই তিন-চার বাড়ির পর একবাড়িতে আমার স্বামী আছেন। দাঙ্গার পরে গ্রামের ছেলেরা দল বেঁধে ছোট ছোট নৌকা করে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ী দেখতে যাচ্ছিল। যেন তারা তীর্থযাত্রায় যাচ্ছে! যেতে যেতে তারা দেখতে পেল, খালের মধ্যে একটি দেহ ভেসে যাচ্ছে। একবার ডুবছে, একবার উঠছে। ওরা তাড়াতাড়ি নৌকা বেয়ে কাছে গিয়ে তাকে নৌকাতে তুলে বাড়ী নিয়ে গেল। ভিজে জামা কাপড় ছাড়িয়ে, শুকনো জামাকাপড় পরিয়ে, হাত-পা সেঁক দিয়ে গরম করে, গরম দুধ খাওয়ালো। অনেকক্ষণ জলে থাকায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাকশক্তি প্রায় ছিলই না। তবে ওদের যত্নে কিছুক্ষণের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন।

আমার জ্যেঠতুতো দুই ভাসুর দেশে থেকেই উপার্জন করতেন। একজন স্কুলের হেডমাস্টার, ও অপরজন অফিসে কাজ করতেন। তাদের সঙ্গে দেশের কিছু বিশিষ্ট মুসলমানদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত ভাবে পরিচয় ছিল। তারাও আমাদের খুব আপন মনে করত। এবার, তারা এগিয়ে এলেন; আমার ভাসুরও ফিরলেন। তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন যে, আপনারা সব বাড়ীতে নিজস্থলে আসুন; আমরা আপনাদের রক্ষা করব। সেইমত আমার ভাসুরও এখানে সেখানে লুকিয়ে থাকা বাড়ির কিছু লোকজনকে খুঁজে বাড়ীতে নিয়ে গেলেন।
আমাদের পূর্বপুরুষদের মহাপুন্যের ফলে আমাদের বাড়ির কাউকে মুসলমান করতে পারে নাই, যদিও আমাদের পুরোহিত বাড়ীতে সবার পৈতে ছিঁড়ে নাকি মুসলমান করে দিয়েছে। সেই বাড়িতে সব মেয়েদের রেখে দিয়েছিল। তবু একটা বৌ এবং অপর একজনের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল পুকুরে। শুনেছি কোথাও কোথাও মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। আমার ভাসুর মেয়েদের সব বাড়ি নিয়ে গেলেন। তাদের সঙ্গে আমার ছেলে ও মেয়েও ছিল। তারপর, তিনি আমাদের খোঁজ করতে লাগলেন। বেলা তখন ৮টা ৯টা হবে। আমরা তখনও জঙ্গলে। তিনি জঙ্গলের অদূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন—“তোরা বেরিয়ে আয়।”
আমরা কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। দেখলাম পাশের বাড়ি থেকে আমার স্বামী বেরিয়ে এলেন। উসকো-খুসকো চুল, রোগা চেহারা, -দেখলে চেনা যায় না। দেখি রাস্তায় আমার ভাসুর দাঁড়িয়ে। তার পাশে দাঁড়িয়ে সোনা মিঞা। সে আমাদের বাড়ীতে যারা সবসময় কাজকর্ম করত এবং নারকোল, সুপারি প্রভৃতির বাগান দেখাশোনা করত। বহু পুরাতন কর্মচারীদের মধ্যে সেও ছিল একজন। তার মাথায় একধামা মুড়ি। তার পাশে বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্যবান গুণ্ডাষণ্ডা চেহারার মুসলমান ছেলে। আমার ছেলেদের দেখতে পেয়েই তারা ছুটে এসে তাদের হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল। আর বললঃ “শালা, তোদের আর রক্ষে নাই; তোদের হাতেও বন্দুক ছিল; আমরা দেখেছি; আমাদের দলের অনেক লোকেদের মেরেছিস; আমাদের কাজে বাঁধা দিয়েছিস; তোদের অনেক খুঁজেছি; এবার আর রক্ষে নেই তোদের”।
দুই পক্ষেই প্রচন্ড টানাটানি চলছে। আমার ছেলেদের স্বাস্থ্যও ওদের থেকে খুব ভালো ছিল; তাই কিছুতেই ছেলেদের টেনে নিয়ে যেতে পারছে না। তখন ওরা কাহিল হয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “দাঁড়া শালা, আরও লোক ডেকে আনছি, তারপর দেখাচ্ছি মজা”। – এই বলে ওরা লোক ডাকতে গেল। আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের ভাসুরকেও যেন আর বিশ্বাস করতে পারছি না। মনে হচ্ছিল, সবই যেন একটা মস্ত বড় ষড়যন্ত্র!
ছেলেরা বললঃ “মা, আপনারা বাড়ী চলে যান; আমাদের আর রক্ষা নেই”। আমিও তৎক্ষণাৎ বললামঃ “তোরা ছুটে পালিয়ে যা। ওরা এক্ষুনি ফিরে আসবে। শিঘ্রী করে পালা”। ওরা আমাদের প্রনাম করে দিল ছুট। সেবার গ্রামে খুব বর্ষা হয়েছিল। ওরা ছুটছে; একবার পড়ছে আর উঠছে; আর ছুটছে। আমরা চোখের জলে সব ঝাপসা দেখছি। আমার স্বামী বললেনঃ “ওরা এখন জানতে পেরছে যে, ওরা আমাদের ছেলে। তাই ওরা এক্ষুনি এসে আমাদের ধরবে; জিজ্ঞাসা করবে, ছেলে কোথায় গেল? আর রক্ষে থাকবে না” আমি বললামঃ “তবে আমরাও দেই ছুট”। উনি পায়ের খড়ম জোড়া ছেড়ে লাগালেন ছুট। আমিও এই প্রথম কোমরে কাপড় বেঁধে দিলাম ছুট। আমার ভাসুর তখন হতভম্বের মত চেয়ে রইলেন। আমিও তখন কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। ততক্ষণে আমরা ছুটতে ছুটতে অনেক দূর চলে গেলাম। এমন সময় এক বাড়ির সামনে আমার স্বামীকে একজন লোক বললঃ “আপনার আর দৌড়াবেন না। থামুন,থামুন। আমাদের এখানে কোন গণ্ডগোল নাই”। এই বলে আমাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল; আর বললঃ “একটু আগে দুটি ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে আমাদের পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল। ছেলে দুটিকে আমরা বেশ বুঝতে, চিনতে পেরেছি। আপনারা আসুন”। আমরা তাদের ঘরে ঢুকেই মই বেয়ে তরতর করে পাটাতনের উপর উঠে লুকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছিল- ওরা যেন এখনও আমাদের পিছনে পিছনে ছুটে আসছে। কেননা, আমরা যখন ছুটছিলাম, তখন আর কখনো পিছনে তাকাইনি। বাড়িটা হিন্দুদের। ঐ বাড়ির লোকেরা বলল। “আপনারা নেবে আসুন; কোন ভয় নেই। এখানকার মুসলমানরা বলছে – আমরা এখানে কোন গণ্ডগোল হতে দেব না। ওরা ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে”। বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমরা যে বিখ্যাত ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির লোক। তবু একপ্রকার নিরুপায় হয়েই আমরা উপর থেকে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম—একটু পরে কয়েকজন মুসলমান ছেলে বাড়িতে এলো এবং ওদের মধ্যে থেকে একজন-দিদি বলে ডাকতে লাগল। বাড়ির গিন্নি বেরিয়ে আমাকে বললঃ “দিদি আমাদের জান থাকতে আপনাদের কোন ভয় নাই।” আমরা ওদের সামনে করুণ হয়েছিলাম।
কয়েকদিন পর ওনার খুব জ্বর হল। ঐ বাড়ির লোকেরা জল তুলে তুলে মাথা ধুইয়ে দিত। কাপড় কেচে দিত। আমাদের খুব যত্ন করতে লাগল। একদিন সেই মুসলমান ছেলেটি এসে জিজ্ঞাসা করল ‘দিদি কার জ্বর হয়েছে, মাথা ধোয়াচ্ছেন?” বাড়ির গিন্নিটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, “আমাদের এখানে গণ্ডগোল হচ্ছে না—তাই আমার জামাই, মেয়ে এসেছে।” আমাদের পরিচয় একেবারে গোপন করে দিল। আমার চোখে জল এল। এরা আমাদের কে নিজেদের সন্তান বলে পরিচয় দিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে। জন্মজন্মান্তরেও ওদের ঋণ শোধ করতে পারবো না। আমি আমাদের গ্রামের ’বারুই’ পরিবারের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
মুসলমানদের সংকল্প ছিল—উঁচু মাথাগুলি কেটে ফেললে, ছোটরা এমনিই আমাদের হয়ে যাবে। ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির প্রতি ওদের এত আক্রোশ। এদিকে যে ছেলেগুলির হাত থেকে আমাদের ছেলেরা পালিয়ে গিয়েছিল তারা দলবল নিয়ে হন্যে হয়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে ছেলেদের খুঁজতে লাগল। জঙ্গল পিটিয়ে পিটিয়ে ছেলেদের খুঁজতে লাগল। ছেলে দুটিকে একটা নৌকার মধ্যে রেখে দিত। নিঝুমরাতে দুই ভাই জড়োসড়ো হয়ে কেঁদে কেটে কাটাত। তবে আমাদের কাছেও কিছু শুভানুধ্যায়ীরা যথাযথ খবর গোপনে পৌঁছে দিয়ে যেত। আমরাও ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছি।
না, এভাবে আর বাঁচা যায় না। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে। কপালে যা থাকে, তাই হবে। এমন সময় হঠাৎ শোনা গেল—দাঙ্গা থামাতে শিখ সৈন্য আসছে। তাই, মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেল। (আসলে এই সময় চৌমুনি স্টেশনে এক ওয়াগন ভর্তি লোহার রড আসে। লোহার রড’কে সেখানে সবাই ‘শিক’ বলত। সেটি-ই অপভ্রংশ হয়ে ‘শিখ’ রূপে প্রচারিত হয়। তবে শুধু সে’দিন নয়, মুসলমানেরা আজও শিখেদের ভীষণ ভয় পায়) ফলে যে যে মুসলমান ছেলেরা মেয়েদের লুঠ করেছে—কেউ কেউ তাদের ফেরত দিতে চাইল, কেউ কেউ আবার তাদের কেটে ফেলতে চাইল, কারণ মুসলমান বাড়িতে হিন্দুর ছেলেমেয়ে ওরা দেখতে পেলে ওদের উপর চাপ বাড়বে, তাই। অতয়েব, ওরা আগেই নিয়ম করেছিল যে, দশ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের ওরা কাটবে না। তাদের মুসলমান করে নেবে। আমার সেজ ছেলেকেও কাটতে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় অন্য একটি ছেলে ছুটে এসে বললঃ “এই ছেলেটাকে কাটতে পারবি না। এ যে আমাদের বাবুর ছেলে! বাবু কোনদিনও আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন নি। আমি কোন হিন্দু বাড়িতে ছেলেটাকে রেখে আসব”। ছোট ও সেজ ছেলেকে আমিই ছাদ থেকে নাবিয়ে মুসলমানেদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। দু-জন মুসলমান ওদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। আমার চার বছরের ছোট ছেলে খুব সুন্দর দেখতে, মুখখানাও খুব মিষ্টি ছিল। একজন বুড়ো মুসলমান ওকে খুব ভালোবেসেছিল। কাঁদলে শান্ত করে দিত, খাইয়ে দিত, রাত্রে কাছে শুয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। আর, ছেলেদের বলত, “তোরা এই ফুলের মত ছেলেটাকে নষ্ট করিস না, ওর মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দে”।
দাঙ্গার সময় আমার চোখের ভুরুর কাছে কেটে গিয়েছিল। আমার ভাসুর নৌকা করে বাড়ির লোকজন খুঁজতে খুঁজতে সেই বাড়ির কাছে উপস্থিত হলেন। তারা তার মাথায় একটা টুপি পরিয়ে ভাসুরের হাতে তুলে দিলেন। দুষ্টু ছেলে, নৌকায় উঠেই তাদের দেওয়া মাথার টুপি খালের জলে ভাসিয়ে দিল। সে আমাদের কাছে এসে আমাকে দেখে মা মা করে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। কোলে তুলে নিয়ে আমিও চুমু খেলাম। এই মিল ভগবানের আশীষ বলেই মনে করলাম। এবার দুই ভাইয়ে অনেক কথা হল। ভাসুর ঠাকুর বললেনঃ পুনুকেও পেয়েছি। বাড়িতে আছে। এখন তোরা বাড়ি চল। পুনু মানে আমার মেজ ছেলে। সেদিন পাওয়া যায়নি।
আমার ছোট ছেলের খুব দুঃখ। খেলতে খেলতে আমার কাছে এসে বলতঃ “মা আমি মুসলমান হয়ে গেছি”। “তা কি করে মুসলমান হলি?” “আমি ওদের উড়ুম(নোয়াখালী ভাষায়- মুড়ি) খেয়েছি, আমি মুসলমান হয়ে গেছি”। “না, না, উড়ুম খেলে কেউ মুসলমান হয় না। তুমিও মুসলমান হওনি।” তখনকার মত ও একটু শান্ত হল। আবার কিছুক্ষণ পরেই ছুটে এসে বলত। “মা, আমি উড়ুম খেয়েছি, আমি মুসলমান হয়ে গেছি।” “কার কাছে?” “ওই দাদুর কাছে।” বুড়ো মানুষ মানেই ওর কাছে দাদু। এরকম আরো কত কথা যে হত ! বাড়ির লোকেরাও হাসতে হাসতে বলছে— ভাইরে এতদিন এতদিন কারোর মুখে কোন হাঁসি ছিল না, তোমার জন্য সবাই একটু হাঁসল।
পরের দিন আমরা বাড়ি যাবার জন্য তৈরী হলাম। ওদের (বারুই পরিবার) চোখে জল। আমরা কিসে শোব, আমাদের তো কিছুই আর নেই! কালকের জমিদার রাতারাতি আজ রাস্তার ভিখিরী! তাই ওরা দু’খানা বড় কাঁথা, দুটো বালিশ আমাদের সঙ্গে দিল। আমরা বিদায় নিয়ে বাড়িতে এলাম। আমাদের বাড়িতে দেখে সকলেই খুব আনন্দিত। ছেলে, মেয়ে সব ছুটে এল। হারিয়ে যাওয়া সেজ ছেলেও আমাকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। তার মুখে তার এ ক’দিনের জীবন বৃত্যান্ত শুনলামঃ প্রথম দিন তাকে মাটির থালায় ভাত, তরকারি খেতে দিয়েছিল। এক গ্রাস মুখে দিয়েই সে থালার মধ্যে বমি করে ফেলেছিল। তারপর, আর ভাত দিত না। মুড়ি খেতে দিত ওরা। রাত্রে আর ঘুমাতে পারত না। ওদের নেকড়া বিছানা, আর তাতে বিদঘুটে গন্ধ। বিছানার কোনায় বসে বসে শুধুই কাঁদত। এইভাবে দিন কাটাত।
বাড়িতে যে ক’টা ঘর পোড়েনি, সে কয়খানা ঘরে আমরা সবাই মিলে থাকতে লাগলাম। কেবল ঘরই ছিল, কিন্তু ঘরে কোন আসবাবপত্র, মূল্যবান সামগ্রী, এমন কি বিছানাপত্র কিছুই ছিল না। – সব লুঠ করে নিয়েছে। তাই গ্রামের কোন কোন বাড়ি থেকে আমাদের কাঁথা, বালিশ দিয়ে গেল। তাতেই কোন প্রকারে র কাটাতে লাগলাম। একটা কোথা বলে রাখি, দেশ থেকে পরে যে যেখানেই গিয়েছিলাম নতুন ইহুদী জীবনের সন্ধানে, এ কাঁথাগুলি সবাই দু’তিনখানা করে নিয়ে গিয়েছিলাম। এর পরে যখন অবস্থা ফিরেছে – লেপ, তোষক, বিছানা চাদর ইত্যাদি হয়েছে, তখনও ওই কাঁথাগুলো যত্ন সহকারে স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ রেখে দিয়েছিলাম। কত কথা তারা বলেছিল, মনে পড়ছিল!
আমাদের বহুদিনের পুরানো কাজের লোকের একজন সোনা মিঞা গাছ থেকে নারকেল সুপারি প্রভৃতি পেড়ে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে চাল, ডাল এনে দিত। আমাদের সব বাড়ির লোকজন একসঙ্গে তাই দিয়ে রান্না করে খেতাম।
আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কয়েক ঘর খুব গরীব মুসলমান ছিল। তারা ভিক্ষা সিক্কা করে দিন কাটাত। আমাদের বাড়িতেও আসত ভিক্ষা করতে। দরকারে বাড়ির কিছু কাজকর্ম করে দিত ও খেয়ে, সাহায্য নিয়ে যেত। এখন তারাও সবাই মজা করে আমাদের দেখতে এল এবং ভিন্ন গ্রামের লোকেরাও সঙ্গে আসত। আমাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেও লাগল। আর বলতে থাকলঃ “আমরা এই বাড়ি থেকে যত মরদেহ সরিয়েছিলাম, তার আর কি বলব! তবে বাইরে থেকে লোকজন এসেই এ সব করেছে। আর, বৌমনি আপনার বড় দুই ছেলে কোথায়?” আমি বললামঃ “আমরা কিছুই জানি না।” বুঝতে পারতাম সবই—যে ওরা এসেছে ভালো মানুষের ভান করে ছেলেদের খবর নিতে। ওদের উপর ওরকমই নির্দেশ ছিল-হয়তো।
ওদের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তনও দেখলাম। যারা কোনদিন আমাদের ঘরে ঢুকতে পেত না, দূর থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলত, তারা এখন ঘরে ঢুকে বিছানার উপর উঠে বসে পড়ত। মনে মনে খুব বিরক্ত হতাম। অবাকও! কিন্তু কিছুই প্রকাশ করতাম না। সবি অদৃষ্টের পরিহাস। দিন কয়েক পরে একদিন শুনলাম মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত নেহেরু, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, কংগ্রেসের নেতারা দাঙ্গা বিধ্বস্ত নোয়াখালির অঞ্চল পরিদর্শনে কলকাতা থেকে আসছেন। দাঙ্গার আগে আমাদের বাড়িতে অনেক নেতাদেরই আনাগোনা ছিল। রাজনীতির বাতাবরণ, চর্চাও ছিল! যা হোক, পরেরদিন তারা এলেন। অনেকে আমাদের বাড়ির কাছেই মাঠে তাঁবু ফেলে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করলেন। খবর পেয়ে গ্রামের হিন্দুরা সব দেখা করতে গেলেন। আমাদের বাড়ির লোকেরাও গেলেন। আমার বড় দুই ছেলেও এবার বাড়িতে এল এবং অন্যদের সঙ্গে তাদের কাছে গিয়ে বাড়ির সেই ভয়াবহ দাঙ্গার বিবরণ দিল। সব শুনে তারা সকলে আমাদের বাড়িতে এলেন; ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন। অবশেষে, সেই বধ্যভূমির পুকুর পাড়ে তাদের নিয়ে গেল। যেখানে ছাদ থেকে বেটা ছেলেদের সব নামিয়ে হাত-পা বেঁধে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, পুকুরপাড়ের সেই দগ্ধ ভগ্নাংশের বিশাল প্রাসাদ তুল্য ‘রায়সাহেব’ রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর অট্টালিকা। আমার শ্বশুর এই ছাদেই আগুনে পড়ে মারা গেছিলেন। আমরা বাড়িতে গেলেও ঐ দিকে কেউ যেতাম না। গা ছম ছম করত। তাই আমরা অন্য পুকুর ব্যবহার করতাম। আমাদের দেশের বাড়ির প্রত্যেকেরই দু’তিনটি করে পুকুর ও একটি দীঘি ছিল। ঐ গুলিতে জাল ফেলে অনেক কঙ্কাল তোলা হয়। তার মধ্যে সেমিজ পড়া কঙ্কালও উঠেছিল। তারা আমাদের বাড়িতে দুদিন ছিলেন। তারা যাবার সময় আমাদের অনেক আশ্বাস দিয়ে গেলেন ।
ইতিমধ্যে রাজেন্দ্রলালের পূর্ব পরিচিত বন্ধু স্থানীয় বাংলার সরকারের এক মন্ত্রী—আমার নাম মনে নেই—আমাদের এই ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির লোকেদের উদ্ধার করার জন্য সেনা সহ নৌকা পাঠিয়েছিলেন। আমার স্বামীও এই সুযোগে আরো একখানি নৌকা করে তাদের নৌকার সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনে এসে গাড়িতে করে নোয়াখালি শহরে নিজ বাসায় এলেন এবং সেখানে দুদিন থেকে তার এক খ্রীষ্টান বন্ধু এস.ডি.ও’র সঙ্গে দেখা করে আরও নৌকা আর সৈন্যের ব্যবস্থা করে নিজ বাড়িতে এলেন। আমরা পরের দিন ৫/৬ খানা নৌকায় বাড়ির সমস্ত লোকজন উঠলাম। আর, আমাদের সামনে ও পিছনে ক’টি নৌকায় সশস্ত্র সৈন্য রইল। আমরা চোখের জলে আমাদের দেশ নোয়াখালিকে চিরদিনের মত পিছনে ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
সৈন্যবাহিনীর নৌকাগুলি মাঝে মাঝে এগিয়ে ও পিছিয়ে পড়ত। আর, আমনি নদীর পাড়ে টুপি পরা মুসলমানদের অসংখ্য মাথা দেখা যেত—ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আবার সেনা নৌকা দেখলেই কোথায় সব লুকিয়ে পড়ত। এইভাবে সেনা পাহারায় আমরা দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমরা শুনতে পেরেছি। আমাদের পূর্বে বাড়ির অন্য যারা নৌকা করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে গিয়েছিল, তাদের অনেক নৌকাই পাষণ্ড মুসলমানেরা নদীর মাঝখানে ডুবিয়ে দিয়েছিল, সেই জন্যই আমাদের জন্য এই রকম সেনা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এইভাবে আমরা সকলে কলকাতা চলে এলাম।
আমাদের সেই একান্নবর্তী পরিবারের প্রত্যেকেই নিজ নিজ সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী “সতীর একান্ন পীঠে”র মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলাম। কোন পরিবার দিল্লি, কোন পরিবার বোম্বে, কোন পরিবার আগরতলা, কোন পরিবার আসাম, কেহ কেহ কলকাতা ইত্যাদি স্থানে চলে যায় নতুনভাবে জীবন সংগ্রাম ও ভাগ্যের অন্বেষণ করতে। শুধু একটা কথা বলে রাখি—আমার সে ভাসুর যাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও অবিশ্বাস করেছিলাম। পরে বুঝেছিলাম যে তিনি সেদিন এক পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলেন সরল বিশ্বাসে।
জীবনে অনেক কিছুই দেখেছি, শুনেছি। ১৯৪৬ সালের সেই নোয়াখালির ‘রায়চৌধুরী’ বাড়ির গৃহবধু আজ ৮৩ বছরের এক শোক সস্তপ্ত বৃদ্ধা, সেই আমি তার দিনলিপি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পারিবারিক ধারা মত লিখে রাখলাম …।।

……… সমাপ্ত ……….

++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

১৯৪৬’এর ১০ই অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন নোয়াখালির বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারে অর্থাৎ ‘রায়সাহেব’ রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর জমিদারীতে ঘটে যাওয়া ‘গণহত্যা’র ঝড় অন্যান্যদের মত সেই পরিবারের গৃহবধূ কিরণপ্রভা রায় চৌধুরীর জীবনের উপর দিয়েও বয়ে যায়। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কলকাতার ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের’ (১৬ই আগষ্ট, ১৯৪৬) প্রতিক্রিয়া নিজ পরিবারে কি বীভৎস আকার নিয়েছিল তার একটুকরো জ্বলন্ত দলিল এই “ডাইরীর কটা খোলা পাতা”।….
যা রয়ে গেছে তার মানসকন্যা ‘সায়াহ্নের প্রচেষ্টা’য় স্মৃতি-কথা রূপে — এবং সেটিই পরবর্তীকালে উক্ত বংশেরই পরবর্তী বংশধর শ্রী শিবাশীষ রায়চৌধুরী (পৌত্র), ধর্মব্রত রায়চৌধুরী(পুত্র) এবং শুভঙ্কর রায়চৌধুরী(প্রপৌত্র) কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

লেখিকা পরিচয়:
নোয়াখালি জেলার ফেনী’র বিখ্যাত আইনজীবী স্বর্গতঃ শ্রীশচন্দ্র মজুমদার ও প্রয়াতা সরলা সুন্দরী দেবীর একমাত্র কন্যা কিরণপ্রভা রায় চৌধুরী। জন্ম- ১৯০৮ সাল। স্কুল শিক্ষা কুমিল্লা মিশনারী বালিকা বিদ্যালয়ে।
মাত্র বারো বছর বয়েসে ১৯২০ সালে নোয়াখালি জেলার বিখ্যাত ‘রায়বাহাদুর’ মহীমচন্দ্র রায়চৌধুরী (আইনজীবী) ও তেজস্বিনী বসন্তকুমারী রায়চৌধুরানী’র পরিবারে বধূরূপে প্রবেশ। স্বামী পরিবারের আইনজীবী স্বর্গত দেবেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরী।

স্মৃতি-কথায় তিনি উল্লেখ করেছেন, —
“এই যে প্রাসাদ, অট্টালিকা হয়েছে নির্মাণ
তোমার পূর্বপুরুষগণ কত দেহ করে গেছে দান
তুমি কম কিসে ভাই”—মনের কথা:
“যাহা মনে আসে, তাই লিখে যাই
কেহ পড়ুক, না পডুক কোন ক্ষোভ নাই।
আমি জানি – যখন থাকব না আমি
আমার এই তুচ্ছ লেখা
কারো কারো কাছে
হবে তখন অনেক অনেক দামী।”

ভূমিকা ও সঙ্কলক পরিচিতি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইংল্যান্ডের নব নির্বাচিত শ্রমিক সরকার, ভারতে ক্যাবিনেট মিশন, অন্তর্বর্তী সরকারে নেহেরু জিন্না তথা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দড়ি টানাটানি, লীগের ভারতের মধ্যে মুসলমান স্থান পাকিস্তানের জন্য হিন্দু বিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরীক্ষা, কলকাতা-নোয়াখালি-বিহার প্রভৃতি স্থানে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সব শেষে ১৫ই অগাষ্ট ১৯৪৭ সালের মধ্য রাত্রে with destiny যাত্রা – এই সকল ঘটনাবলী তৎকালীন ভারতবর্ষের সমস্ত পরিবারের উপর দিয়ে ঝড়ের মত বয়ে গেল। ভারতের নেতৃবৃন্দও দেশভাগের মধ্য দিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করল। শুধু যে যে পরিবারের ভাঙন-ক্ষত স্থায়ী হয়ে গেল। যার কোন প্রলেপ হয় না, শুধু নিরবে সেই ক্ষত বয়ে নিয়েই সময়ের সাথে সাথেই পথ চলা।
এরকমই একটি পরিবার। নোয়াখালির বিখ্যাত আইনজীবি ‘রায়সাহেব’ রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী তথা ‘রায়বাহাদুর’ মহিমচন্দ্র রায়চৌধুরীর একান্নবর্তী জমিদার পরিবার। সেই পরিবারের উপর দিয়ে প্রথম ঘটে যাওয়া নব-তান্ডব লীলার পরবর্তীকালের ঘাত-প্রতিঘাতে ভারতবর্ষে জাতীয় নেতৃবৃন্দ এক প্রকার অসহায় হয়ে একমাত্র ভারত-পাকিস্তানের বিভাজনের মধ্যেই সমাধান খুঁজে পান। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী অস্থির হয়ে নোয়াখালির ভয়াবহতা পরিদর্শনে আসেন শান্তিবারি নিয়ে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়ীক সমস্যার সমাধান কল্পে। তার এই একক প্রচেষ্টার সফলতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ণ লুকিয়ে রয়েছে মুসলীম লীগ, নেতা জিন্নার দ্বি-জাতী তত্ত্বের মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান, পূর্ব পাঞ্জাব – পশ্চিম পাক-পাঞ্জাব, পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব পাক-বাংলা প্রভৃতি সহ ভারতবর্ষের এক ব্যাপক ভাঙা-গড়ার মধ্যেই।

নোয়াখালির এক বড় রাজনৈতিক শিক্ষা, যেখানে তৎকালীন ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন ধারায় রাজনীতির অস্তিত্বের পরিপক্কতা থাকা সত্ত্বেও সে সবেরই পরাজয় ঘটে সংখ্যা গরিষ্ঠের “পাকিস্তানের আদর্শগত কারণে। সেই জন্য নোয়াখালি আজও এক বিরাট রাজনৈতিক গবেষণার বিষয়। এই নোয়াখালির মাটিতেই লালিত-পালিত ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমেদ, কমিউনিষ্ট-সাহিত্যিক গোপাল হালদার, সুভাষচন্দ্র বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকের নগেন্দ্ৰ গুহরায়, আর.এস.পি.’র মাখন পাল, গান্ধী কংগ্রেসের হারানচন্দ্ৰ ঘোষ চৌধুরী ইত্যাদি প্রমুখের নেতৃত্বে ভারতের ভিন্ন ধারার রাজনীতির চর্চাসহ ব্রিটিশ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে চরম ও নরম পন্থী ধারায় আন্দোলনের বাতাবরণের মধ্যেই ১৯৪৬ সালের নোয়াখালিতে কি ভাবে সে সবের পরাজয় ঘটে গোটা সমাজটাই হিন্দু মহাসভার ও নোয়াখালি বার এর সভাপতি ‘রায়সাহেব’ রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী ও মুসলিম লীগের গোলাম সরোয়ারের মধ্যে বিভাজিত হয়ে গিয়ে ভারতভাগের অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান গঠনের মধ্য দিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশান্তরী করল – সেই নোয়াখালি আজও এক বড় রাজনৈতিক শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়।
মুসলিম লীগের এই কলকাতা – নোয়াখালীর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ও তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত ছিল বাঙ্গালীর ধর্ম ও সংস্কৃতির আবাসভূমী ‘পশ্চিম বাংলা’র জন্য বাংলা ভাগ পাঞ্জাবের মতই, যদিও জন ও সম্পত্তির বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান প্রধানমন্ত্রী নেহেরু করলেন না, যা তিনি পাঞ্জাবে করেছিলেন। হিন্দু-বাঙ্গালীদের জন্য বাংলাভাগের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ‘বাংলার বাঘ’ ডঃ আশুতোষ মুখার্জীর ‘বাচ্চা’ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, ও তাঁর বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট ‘রায়সাহেব’ রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর কনিষ্ট ভ্রাতা ঐতিহাসিক—অধ্যাপক ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী ওরফে ‘মৌলানা মাখনলাল’ সহ তৎকালীন বিশিষ্ট বাঙালীরা। উল্লেখ্য, নোয়াখালির দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাড়ি পরিদর্শন করে তৎকালীন ভারতের কংগ্রেস সভাপতি জে বি কৃপালনী মন্তব্য করেছিলেন: “যদিও আমি সম্পূর্ণ অহিংসায় বিশ্বাসী তা সত্ত্বেও আমি রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী’র প্রতি পূর্ণ শ্ৰদ্ধা জানাচ্ছি। প্রত্যেক বাঙালীর সামনে আমি রাজেন্দ্রলাল এবং তার পরিবারের কথা উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরতে চাই, যারা দু’দিন ধরে লড়াই করে আক্রমণকারী উন্মত্ত জনতাকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।”
সেদিনের এই ঘটনাবহুল ‘রায়চৌধুরী’ পরিবারে উপস্থিত ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া, বেঁচে ফেরা, জীবিত সকলের কাছেই সেই পরিবারের মহাকাব্যের কতকগুলি পাতা জমে, ছড়িয়ে আছে, যা এক জায়গায় একত্রিত করলেই তাঁর সম্পুর্ন চিত্রায়ন সম্ভব। জীবনটাকে সেদিন জীবিত সকলেই রক্তমাংসের শরীরে আটকে রাখতে ব্যস্ত থেকে অন্যের দিকে তাকাতেও পারেন নি। তাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতাই এক মস্ত বড় ট্যাজেডির টুকরো টুকরো অংশ।
“Yet shall some tribute of regret be paid
When her long life hath reached its final day;
Men are we and we must grieve when even the shade
of that which once was great is passed away.”
সে কারনেই নোয়াখালী গবেষণার অঙ্গ হিসাবে এই পরিবারের এক প্রত্যক্ষদর্শী ও ভূক্তভোগী সায়াহ্নের প্রচেষ্টা’র স্রষ্টা ‘শ্ৰীমতী কিরণপ্রভা, রায়চৌধুরী’র স্বহস্তে লিখিত কটি পাতা ‘ডাইরী’র ক’টা খোলা পাতা সংক্ষেপিত রূপে প্রকাশ করলেন এই বিখ্যাত ‘রায়চৌধুরী’ পরিবারের ঐ ১৯৪৬-উত্তর ঘটনার দ্বিতীয় প্রজন্ম-উত্তরপুরুষ। তাঁরা ডাইরী লেখিকার সম্পর্কে পৌত্র, পুত্র ও প্রপৌত্র…।


সঙ্কলক: শ্রী নিহারণ প্রহারণ..।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.