১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পি বি চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলী।১৯৪১ থেকে ৫১ পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এটলী ভারতের স্বাধীনতার সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেছিলেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পি বি চক্রবর্তীর প্রশ্নের উত্তরে এটলী জানিয়েছিলেন ভারতীয় সৈন্য ও নৌবাহিনীর ব্রিটেনের প্রতি আনুগত্যের অভাবের জন্যই ইংরেজদের তড়িঘড়ি ভারত ছাড়তে হয়েছিল আর এর পেছনে ছিল সুভাষচন্দ্রের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কার্যকলাপ। বিচারপতি চক্রবর্তী স্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছিলেন ইংরেজদের ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্তে গান্ধীজীর প্রভাব কতটা ছিল? উত্তর এসেছিল —- m-i-n-i-m-a-l । রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘History of Bengal’ এর প্রকাশককে চিঠিতে এই কথোপকথন সম্পর্কে জানান পি বি চক্রবর্তী (তথ্যসূত্র: Bose: An Indian Samurai. In this book General GD Bakshi )।
গান্ধীজীর থেকে নিজেকে আলাদা করেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু কিন্তু গান্ধীজীর সঙ্গে মতপার্থক্যের মূল্য সুভাষকে দিতে হয়েছে অনেক। পরপর দুবার সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েও নিজের পছন্দমতো ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করতে পারেন নি, কংগ্রেসের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েও নিজের মতো করে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্ৰহণ করতে পারেন নি।
কারণ, বিরোধীদের সঙ্গে লড়াইয়ের রাজনীতির থেকেও বেশি কঠিন দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে লড়াই করা বিশেষ করে সেখানে , যেখানে ‘কাজের মানুষের থেকে কাছের মানুষ বেশি প্রাধান্য পায়’ । এর মূল্য সুভাষকে যেমন দিতে হয়েছে ঠিক তেমনি এর খেসারত কয়েক লক্ষ গুণ বিবর্ধিত হয়ে ভারতকে দিতে হয়েছে ‘দেশ বিভাজন’ এর রূপে আর ভারতের প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখনো দিয়ে যাচ্ছে।
যিনি বলেছিলেন দেশ বিভাজন হলে তার লাশের উপর দিয়ে হবে, তার চোখের সামনেই লক্ষ লক্ষ লাশের পাহাড়ের চূড়ায় উঠেই দেশ বিভাজনকে স্বাধীনতার শর্ত হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল।
সেই সময় প্রয়োজন ছিল দ্বৈত চরিত্রবিহীন, আপোসহীন এক নেতার কিন্তু কোথায় তিনি?
তিনি তখন অন্তহীন রহস্যের মধ্যে হারিয়ে গেছেন।
অহিংসাই যদি আন্দোলনের মূলমন্ত্র হয় , তাহলে যে ইংরেজ বিশ্ববিজয়ী হতে চেয়ে ভারতীয়দের যুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে তার সহযোগীতা কি করে অহিংসা হয় ? এই প্রশ্নের কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর না পেয়েই নেতাজী নিজের পথ আলাদা করে নিয়েছিলেন।প্রশ্ন তারাই করতে পারেন যাদের ‘কাছের মানুষ হওয়ার প্রয়োজন থাকে না’ । কিন্তু যারা ‘কাছের মানুষ ‘ হতে চেয়েছিলেন তারাই নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন, ক্ষমতা ভোগ করতে পেরেছেন আর সুভাষ হয়েছেন কখনো ‘নির্বাসিত’ , কখনো ‘যুদ্ধ অপরাধী’ ।
সুভাষ চন্দ্র বসু আর মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর মতপার্থক্য প্রথম সাক্ষাৎকার থেকেই শুরু হয়ে যায়।দেশবন্ধুর ডাকে ইংরেজের চাকরি ত্যাগ করে বম্বেতে গান্ধীজীর সঙ্গে প্রথম আলাপেই যে প্রশ্নগুলো করেছিলেন সুভাষ সেই প্রশ্নগুলোর যুক্তিগ্ৰাহ্য উত্তর না পেলেও সেইসময় ছিল চিত্তরঞ্জন দাশ, বাল গঙ্গাধর তিলকের মতো নেতাদের প্রেরণা। কিন্তু প্রথমে বাল গঙ্গাধর তিলক আর পরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অকালপ্রয়াণের পর গান্ধীজীর সমতুল্য আর কেউ থাকলো না। সুভাষের কথায় “Inspite of the democratic constitution of the Indian National Congress, at Nagpur, Mr. Gandhi emerged as the virtual Dictator of the Congress.’ । সার্বজনীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বা সিদ্ধান্ত গ্ৰহণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে অহিংসার এক রূপ বলা যায় কিন্তু অহিংসার পূজারির এহেন ব্যবহার যে সুভাষের বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
অভিভাবকহীন সুভাষের মনের কথাগুলো ধীরে ধীরে বের হতে লাগলো।
সেসময় ইংরেজদের ত্রাস , ‘বোস’ ইউরোপে নির্বাসিত। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ইউরোপে একদিকে চলছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন জোগাড়ের কাজ আর অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমসাময়িক ইতিহাসকে বিশ্বের সামনে নিয়ে আসার কাজ।লন্ডনে ১৯৩৫ সালের ১৭ ই জানুয়ারি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই ব্রিটিশ সরকার তাঁর বইটিকে নিষিদ্ধ করতে সময় নষ্ট করে নি। সাধারণ ভারতীয় পাঠকদের হাতে বইটি এক দশকেরও বেশি সময় পরে পৌঁছায়। নোবেলজয়ী ফরাসি নাট্যকার রোমা রোলাঁ সুভাষ চন্দ্র বসুর লেখা ‘The Indian Struggle’ বইটির বিশেষত্ব সম্পর্কে বলেছেন…..
“What you say about the dualism in the part played by Gandhi and in his nature made a deep impression on me. Evidently this very dualism makes his personality so original…I am admiring your firm political sense.” ।
গান্ধীজীর অহিংস নীতি তাকে বহির্বিশ্বের মনে দেবতার আসনে বসিয়েছিল কিন্তু সুভাষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে গান্ধীজীর সঠিক মূল্যায়নের প্রশংসা করেছিলেন রোমা রোলাঁ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গেলে প্রতি পৃষ্ঠায় গান্ধীজীর নাম আসাই স্বাভাবিক যেমনটি এসেছে সুভাষচন্দ্রের কথায়।
কিন্তু এই স্মৃতিচারণ এসেছে এক সহকর্মী হিসেবে, এক অনুগত কর্মী হিসেবে ,ভবিষ্যতের কর্মপন্থার যৌক্তিকতা বুঝতে চাওয়া এক প্রশ্নকর্তা হিসেবে আর পরিকল্পনা ও প্রাপ্তির পার্থক্য মূল্যায়নকারী এক সাধারণ ভারতীয় হিসেবে।
বইটির রিভিউ লিখতে গিয়ে ‘The news Chronicle’ এ বেরিয়েছিল….
‘His picture of Gandhi is very interesting as an Indian view .It is firmly and convincingly drawn.He does full justice to the marvellous qualities of the saint without condoning in the least the ‘Himalayan blunders’ of the politician….
অর্থাৎ, সমালোচকদের কাছে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে বইটির মূল আকর্ষণ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গান্ধীজীর কর্মকান্ডের মূল্যায়ন। বইটির ‘The role of Mahatma Gandhi in Indian History’ অধ্যায়ে গান্ধীজীর বিভিন্ন গুণাবলীর প্রশংসা করে সুভাষের শেষ কথা ‘But India’s salvation will not be achieved under his leadership.’ ।
সুভাষ চন্দ্র অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন কংগ্রেস যদি গান্ধীজীর মতের বিপরীতে হাঁটতে
চায় তাহলে গান্ধীজী সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিতে পারেন যেমনটি নিয়েছিলেন ১৯২৪ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত যে সময় চিত্তরঞ্জন দাশ আর সুভাষ চন্দ্র বসুর যুগলবন্দী দেখছে ভারত।তার আগে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে গান্ধীজীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে গান্ধীজীর এক বছরে স্বরাজ এনে দেওয়ার দাবির মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে পান নি সুভাষ চন্দ্র বসু…..
But though I tried to persuade myself at the time that there must have been a lack of understanding on my part, my reason told me clearly, again and again, that there was a deplorable lack of clarity in the plan which the Mahatma had formulated and that he himself did not have a clear idea of the successive stages of the campaign which would bring India to her cherished goal of freedom.Depressed and disappointed as I was what was I to do? The Mahatma advised me to report myself to Desha- bandhu C. R. Das on reaching Calcutta. সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় চতুর্থ হওয়া মস্তিষ্কে গান্ধীজীর পরিকল্পনাকে বাস্তবসম্মত মনে হলো না, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার ভাবনায় ভরা বুক হতাশায় ভরে গেলো কিন্তু ভাগ্য ভালো চিত্তরঞ্জন দাশ কে পেয়েছিলেন পথপ্রদর্শক ও সমর্থক হিসেবে (By the time our conversation came to an end my mind was made up.I felt that I had found a leader and I meant to follow him.—- চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পর্কে )। কিন্তু কংগ্রেস থেকে নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার সময় এরকম কোনো ছায়া ছিল না সুভাষের।
কংগ্রেসে যে গান্ধীজীর বিপক্ষে বলা সম্ভব নয় এমনকি ভুল করলেও সম্ভব নয় তা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু……
Many of the blunders committed by the Mahatma as a political leader could have been avoided if they had been in a position to advise him. Since the death of these three giants, the leadership of the Congress has fallen to a low intellectual level. The Congress Working Committee today is undoubtedly composed of some of the finest men of India—men who have character and courage, patriotism and sacrifice. But most of them have been chosen pri¬ marily because of their ‘blind’ loyalty to the Mahatma— and there are few among them who have the capacity to think for themselves or the desire to speak out against the Mahatma when he is likely to take a wrong step. In the circumstances the Congress Cabinet of today is a one- man show.(page 67)।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে কংগ্রেসের ভেতরের অগণতান্ত্রিকতার সেই শুরুর কি শেষ কোনোদিনই হয় নি যার মাশুল দিতে হয়েছিল নেতাজীর সঙ্গে গোটা দেশকে?
সুভাষ কে কংগ্রেসে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য স্বয়ং কবিগুরু চিঠি লিখেছিলেন গান্ধীজীকে (২০ শে ডিসেম্বর, ১৯৩৯ )….”Owing gravely critical situation all over India and especially in Bengal would urge Congress Working Committee immediately remove ban against Subhas and invite his cordial co-operation in supreme interest national unity.’।
কিন্তু গান্ধীজীর মন গলে নি। সুভাষ চন্দ্র তখন তার কাছে বখাটে ছেলে। কিন্তু এই বখাটে ছেলেই রণাঙ্গন থেকে বেতার বার্তায় ‘জাতির জনক’ সম্বোধন করে গান্ধীজীর আশীর্বাদ চেয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন সুভাষ বোস কিন্তু গান্ধীজী বড়লাট লর্ড লিনলিথগোর সঙ্গে দেখা করার পরে স্পষ্ট জানান ‘ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথা এখন আমি মোটেই ভাবছি না।ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স যদি স্বাধীনতা হারায়, তা হলে কি হবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিয়ে?’।
সুভাষ স্তম্ভিত! বিশ্বাস করতে পারেন নি, এ গান্ধীজীর বিবৃতি।
পিন্টু সান্যাল