সাপের আতঙ্ক আমাদের কার না নেই! কিন্তু সাপ যে নিজেও কতটা বেচারি, তাকে যথার্থভাবে অনুধ্যান না করলে বোঝা যাবে না। শ্রীরামকৃষ্ণের লোকশিক্ষার চৈতন্যমূলক একটি গল্পে পাই, এক সাধু মাঠের এক বিষাক্ত সাপকে রাখালদের প্রাণীহিংসা থেকে বাঁচাতে বলেছিলেন, ‘দরকারে ফোঁস কোরো’, যে সাপটি আগে ছিল ভয়ংকর রকম আগ্রাসী। পরদিন রাখালেরা লাঠি হাতে ফের তাকে মারতে গেলে, গুরুর কথা মতো সাপটা এবার ফোঁস করে ফণা ধরে তেড়ে এলো। সেদিন থেকে সাপের কাছে কেউ আর ঘেঁষতো না। সাপও তাই নির্ভয়ে মাঠময় ঘুরে বেড়াত। প্রকৃতিতে সাপ, কচ্ছপ, কুমির, টিকটিকি, গিরগিটির মতো একই শ্রেণীভুক্ত জীব সাপ। জীবনধারার প্রয়োজনে হয়েছে আলাদা, ঘটেছে তার বিবর্তন। তাদের নেই তেমন ঘ্রাণশক্তি, নেই বহিঃকর্ণ, নেই চোখের পাতা। তবে পরিপাকতন্ত্র বেশ শক্তিশালী, তাদের চেরা জিভে ঘাটতি পূরিত হয় শোনার অক্ষমতার কিংবা ক্ষীণদৃষ্টির নঞর্থকতার। সাপ এক লম্বা বেলনাকার, উপাঙ্গহীন মেরুদণ্ডী প্রাণী, আঁশে ঢাকা দেহ।
সাপ প্রকৃতির ভয়ংকর-ভীতিপ্রদ সুন্দর। সুন্দর বলেই সাপের দেবী মনসা নানান সাপ দিয়েই নিজেকে সাজান। মনসামঙ্গল কাব্যগুলিতে সেই সর্পসজ্জার পরিচয় আছে। দেবী হাতের শাঁখা বানাচ্ছেন শঙ্খিনী সাপ দিয়ে। কালনাগিনী সাপ দিয়ে কেশের পারিপাট্য করছেন। সুতলিয়া নাগে তৈরি করছেন গলার হার। হৃদয়ের কাঁচুলি হল বিচিত্র নাগ। চুলের সিতের সিঁদুর হল সিন্দূরিয়া নাগের অনবদ্য অবস্থানে। চোখে কাজলের পরিবর্তে তিনি রাখলেন কাজুলিয়া সাপ। কানা হরিদত্তের মনসামঙ্গলে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে দেবীর অঙ্গসজ্জা। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য যে সমস্ত সাপের প্রসঙ্গ আছে, তার অনেকগুলোই হয়তো হারিয়ে গেছে বা বিরল প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। এই সাপগুলির নাম বেশ চমকপ্রদ।
কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’তে সাঁতালি গ্রামের বিষবেদেদের সর্প সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে বিবৃত হয়েছে সর্পকাহিনী, উপকাহিনী, সাপ সম্পর্কে নানান বিশ্বাস সংস্কার, লোকায়ত জীবনচর্যার কথা। রাণী চন্দ্রের ‘আমার মা’র বাপের বাড়ি’ গ্রন্থে সাপের কথা পাই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসে আফ্রিকান ‘ব্ল্যাক মাম্বা’-র আতঙ্ক পাঠকমনে ভয়ের পরিবেশ রচনা করে। রেভারেন্ড লালবিহারী দে’র ‘গ্রাম বাংলার উপকথা’ গ্রন্থে কেউটে সাপের ছোবলে কৃষক গয়ারামের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক মুহূর্ত সৃষ্টি করে।
পশ্চিমবঙ্গের ভয়ংকর সাপগুলির মধ্যে বিষধর কালাচ, কেউটে, গোখরো, চন্দ্রবোড়ার নাম করা যায়। ফণাহীন কালাচের বিষে নার্ভ বা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। কমন ক্রেইট বা কালাচ সাপটি কালোর উপর সাদা সাদা দাগ দেওয়া একটি প্রাণী। কালাচের কাছাকাছি দেখতে কালসাপ বা ব্ল্যাক ক্রেইট সাপে এই সাদা দাগগুলি নেই। ফণাধর কেউটের অপরনাম শামুকভাঙা। আলকেউটে সাপ কৃষিজমিতে আলের গর্তে থাকে। বর্ণে এরা কালো, মৃত্যু ঘনিয়ে আসে বলে এর নাম ‘কালকেউটে’। গোখরো সাপও ফণাধর। কেউটে এবং গোখরোর ফণার পিছনে যে চিহ্ন থাকে তার মধ্যে ভিন্নতা আছে। গোখরোতে এই চিহ্নটি ইংরেজি ‘U’ অক্ষর বা চশমার মতো। কেউটে সাপের ফণার পিছনে গোলাকার চিহ্ন। চন্দ্রবোড়া সাপটি ফণাহীন। এর চেহারা বাদামি, গায়ে চাকা চাকা দাগ। চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের পর চিকিৎসায় বিলম্ব হলে কিডনির সমস্যা দেখা দেয়। অত্যন্ত বিষাক্ত কিং কোবরা বা শঙ্খচূড় সাপটি বেশ বড়সড় এবং রাজকীয় চেহারা, গতিও তাদের বেশ দ্রুত। শাঁখামুটি সাপ আর একটি বিষধর প্রজাতি, তাদের চকচকে হলুদ দেহের উপর কালোর পটি বা ব্যান্ড থাকে। সমুদ্রে দৃশ্য সাপেরাও বেশ বিষধর।
রাজ্যের বিষহীন সাপের মধ্যে হেলে, জলঢোঁড়া, ঘরচিতি, দাঁড়াশ, লাউডগা, কালনাগিনী, তুতুর, বোড়া, মেটেলি, জল মেটেলি, বেত আছড়া, অজগর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাপের বিশেষত নির্বিষ বা স্বল্পবিষ সাপের দৃশ্যমানতা এবং বৈচিত্র্যের সংখ্যা দিয়ে বিচার হয়, পরিবেশের দূষণের মাত্রাটি ঠিক কেমন। বিষধর ও নির্বিষ সাপ চেনাটা ভীষণ দরকার। সাপের বাসস্থান সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
সর্পদংশন থেকে আমাদের বাঁচতে হলে বিশেষ করে কৃষিজীবী মানুষকে রেহাই পেতে গেলে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। যেমন গৃহ পরিবেশের চারপাশটি রাখতে হবে পরিচ্ছন্ন। অন্ধকারে হাঁটাচলা করা মোটেই সমীচীন নয়। হাতে টর্চ আর লাঠি ঠুকে চলার অভ্যাস থাকা দরকার। রাতের শয্যা ঝেড়ে, মশারি খাটিয়ে নিদ্রা যাওয়া উচিত। সর্পসঙ্কুল স্থানে মাটিতে শোওয়া মোটেই উচিত নয়। গৃহের দরজা জানালা ঠিকঠাক বন্ধ হয় কিনা এবং তাতে ফাঁক থাকে কিনা পরীক্ষা করা দরকার। গৃহের চারপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে সাপের আগমনে বাধা দিতে হবে। বাড়ির দেওয়ালে ফাটলগুলি মেরামত করার প্রয়োজন আছে। গৃহের কাছাকাছি কোনো আগাছা জমিয়ে রাখা চলবে না। যদি জানালার ধারে কোনো গাছ বেড়ে উঠে স্পর্শ করে, তা কেটে দিতে হবে। খড়ের চালাও নিয়মিত মেরামত করতে হবে৷ হঠাৎ সাপ ঘরে ঢুকলে যাতে তাড়া পেয়ে পালিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তথ্যসূত্র:
১. কৃষি বাস্তুতন্ত্রে সাপ, সর্পদংশন ও তার প্রতিকার — ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ডা. অমিত ভট্টাচার্য, ২০১৬ পঞ্চায়েতী রাজ, ৯(১১) নভেম্বর: পৃষ্ঠা ২০-৩০
২. বাংলার জৈববৈচিত্র্য ও লোকসংস্কৃতি — ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০২৪ (তৃতীয় সংস্করণ) কবিতিকা, মেদিনীপুর, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫৭
৩. Snakes in Bengal: বাংলায় সর্পবৈচিত্র্য ও সর্পদেবী মনসা, কল্যাণ চক্রবর্তী, Kolkata News Today, July 16, 2023.
শুভদীপ ঘোষাল এবং কল্যাণ চক্রবর্তী