শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারমশাই (শ্রীম)-কে বলছেন, “জগদ্ধাত্রীরূপের মানে জানো? যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন। তিনি না ধরলে, তিনি না পালন করলে জগৎ পড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। মনকরীকে যে বশ করতে পারে, তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।” পাশে রাখালও ছিলেন, তিনি কথার সূত্র ধরে বললেন, “মন-মত্ত-করী!” শ্রীরামকৃষ্ণ এবার বললেন, “সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রয়েছে।” (২২ শে জুলাই, ১৮৮৩)
জানা যায়, ১৮৮২ সালের ১৯ শে নভেম্বর, রবিবার শ্রীরামকৃষ্ণ জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষ্যে ঠাকুরের গৃহীভক্ত ও রসদদার সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের (১৮৫০-১৮৯০) নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাঁর সিমুলিয়ার বাড়ি গিয়েছিলেন। মাস্টার মশাইও গিয়েছিলেন। সুরেনের মেজোভাই ছিলেন জজ। তাঁকে সেদিন যা বললেন তা তাৎপর্যপূর্ণ, “লোকে মনে করে আমরা বড়লোক; ছাদের জল সিংহের মুখওলা নল দিয়ে পড়ে, মনে হয় সিংহটা মুখ দিয়ে জল বার কচ্ছে। কিন্তু দেখ কোথাকার জল। কোথা আকাশে মেঘ হয়, সেই জল ছাদে পড়েছে, তারপর গড়িয়ে নলে যাচ্ছে; তারপর সিংহের মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে।”
মা সারদার মা শ্যামাসুন্দরীদেবী জয়রামবাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেছিলেন। তার একটি ইতিহাস আছে। কালীপূজায় গ্রাম্য-কোন্দলের আবহে শ্যামাসুন্দরীদেবীর সংগ্রহ করা চাল, ডাল, আলু প্রভৃতি পূজার জন্য গ্রহণ করলেন না পূজাকর্তা নব মুখার্জি। কিন্তু ভক্তিমতী শ্যামাসুন্দরী সারাবছর ধরে সঞ্চয় করেছেন তা, দেবীকে ভোগ দেবেন। সেই নৈবেদ্য বাতিল হল। নীরবে চোখের জল ফেললেন শ্যামাসুন্দরী, “কালীর জন্য চাল করেছি, আমার চাল নিলে না! এ চাল আমার কে খাবে! এ কালীর চাল। এ চাল তো কেউ খেতে পারবে না।” অতি সাত্ত্বিকভাবে, পবিত্র নিয়মে ধান সেদ্ধ করে, শুকিয়ে, ঢেঁকিতে ভেঙে তৈরি হয়েছে এই চাল। শ্যামাসুন্দরী রাতে স্বপ্ন দেখেন টকটকে লাল এক দেবী তাঁর কাছে এসেছেন, “ওরা চাল নেয়নি তো কি হয়েছে? কালীর চাল আমি খাব।…. আমি জগদম্বা, জগদ্ধাত্রীরূপে তোমার পূজা নেবো।” শ্যামাসুন্দরী তবুও বুঝতে পারেন না, কন্যা সারদাকে জিজ্ঞেস করেন, “লাল রং, পায়ে পা ঠেসান দিয়ে ও কী ঠাকুর?” সারদা বলেন, ও জগদ্ধাত্রী। শ্যামাসুন্দরী সেই বছরই জগদ্ধাত্রী পূজায় ব্রতী হলেন। মাত্র ক’দিন; কালীপূজা শেষ হয়েছে, মা জগদ্ধাত্রী আসবেন৷ কিন্তু প্রকৃতিতে নিম্নচাপের ভ্রুকুটি, শুরু হল অবিশ্রান্ত বর্ষণ, কীভাবে পূজা হবে! ধানই তো শুকোনো হল না! এদিকে প্রতিমা, পুজোর জিনিসপত্রও সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু তারই মধ্যে রোদ উঠলো, চাটাইয়ে ধান শুকোচ্ছে। আগুন জ্বালিয়ে প্রতিমা শুকাবার কাজ চললো। শ্যামাসুন্দরী পুত্রকে দিয়ে জামাইয়ের কাছে খবর পাঠালেন। শ্রীরামকৃষ্ণ খুশি হলেন, “মা আসবেন? মা আসবেন? বেশ বেশ।” শ্যালক প্রসন্ন জামাইবাবুকে নিতে এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। তবে শ্রীরামকৃষ্ণ যেতে পারেন নি সেবার। বললেন, “এই আমার যাওয়া হলো। যা বেশ, পূজা করগে। বেশ বেশ তোদের ভাল হবে।” শ্যামাসুন্দরীর আয়োজনে জগদ্ধাত্রীপূজা সাড়ম্বরে সম্পন্ন হল।
মা সারদা জয়রামবাটিতে জগদ্ধাত্রীপূজার আয়োজন করতেন। মায়ের মা শ্যামাদেবীও জগদ্ধাত্রীপূজার আয়োজন করেছেন। প্রথম চার বছর সঙ্কল্প হয়েছিল মা শ্যামাসুন্দরীর নামে। দ্বিতীয় চার বছর মা সারদার নামে সঙ্কল্প হয়। তৃতীয় চার বছর মায়ের খুল্লতাত নীলমাধবের নামে সঙ্কল্প হয়। এরপর মা চাইলেন পুজোর আয়োজন এখানেই বরং সমাপ্ত করা যাক! কিন্তু রাতে মা স্বপ্ন দেখলেন। দেবী এসে বলছেন, “মধু মুখুজ্যের পিসিমা আমার পুজো করতে চাইছে সারদা। তবে আমি যাই?” তিনবার একই প্রশ্ন। শ্রীমা বুঝলেন, ‘তিন সত্য’ দেবী চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে যাবেন। মা দেবীর পা এবার জড়িয়ে ধরলেন, কিছুতেই দেবীকে ছাড়বেন না। দেবী জগদ্ধাত্রী জয়রামবাটিতে তাঁরই পূজার আয়োজনে যুগযুগান্তর ধরে বিরাজ করবেন। বছর বছর আগমন ঘটবে মায়ের ভিটেয়। শরৎ মহারাজ অনুরোধ করলেন মাস্টারমশাইকে। তিনি ৩২০ টাকা দান করলেন। পূজার সার্বিক আয়োজনে জমি কেনা হল, প্রায় সাড়ে দশবিঘা চাষের জমি৷
মা সারদা তিনদিন জগদ্ধাত্রী প্রতিমা রাখতেন। মায়ের পূজা আয়োজন সম্পর্কে তিনি বলতেন, কত সন্তর্পণে সব জোগাড় করতেন মা, কালীপূজার দিন থেকে সলতে পাকাতেন তিনি। শ্রীমাকেও দেখা যেত, পঞ্চপ্রদীপের সলতে তৈরি করছেন। চালের জন্য ধান কিনিয়ে রাখছেন, ভাণ্ডার সাজিয়ে ভরে রাখছেন। ভক্তমণ্ডলীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
স্বামী ঈশানানন্দের (বরদা) ‘মাতৃসান্নিধ্যে’ গ্রন্থে (উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত) উল্লেখ আছে, ১৩১৬ বঙ্গাব্দ (১৯০৯) পূজার আগেই তিনি কার্তিক মাসের শেষের দিকে এক সকালে কলকাতা থেকে জয়রামবাটির পথে গরুর গাড়িতে রাধু ও অন্যান্যদের নিয়ে কোয়ালপাড়া পৌঁছেছেন। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে (১৯১১) জগদ্ধাত্রীপূজার দিন সকালে যখন কেদারবাবু ও রাজেনদার সঙ্গে লেখক জয়রামবাটিতে মায়ের বাড়ি যান, বাড়ি থেকে ক্ষেতের কিছু শাকসবজি পূজাপোলক্ষ্যে নিয়ে গেছিলেন। মা তা দেখে খুব আনন্দিত হলেন, বললেন, “এখানে তরকারিপাতি সবসময় মেলে না, মাঝে মাঝে বড় মুশকিলে পড়তে হয়, তা ঠাকুরই তোমাদের দিয়ে সব জোগাবেন দেখছি।” এই বছর শরৎ মহারাজ কলকাতা থেকে পূজার জিনিসপত্র ব্রহ্মচারী প্রকাশ মহারাজকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিলংবাসী ভক্ত দেবেনবাবু এবং অন্যান্যরা মা-কে ঠাকুরের শতনাম-লীলাকীর্তন শুনিয়েছিলেন। লেখকের কথায় পূজার পরদিন সন্ধ্যায় তিনি ও সঙ্গীসাথীরা যখন কোয়ালপাড়া ফিরছেন, মা তাদের জন্য জগদ্ধাত্রীদেবীর প্রসাদ মুড়কি, নাড়ু প্রভৃতি কাপড়ে বেঁধে দিলেন। পূজা শেষে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকে শ্রীমা, রাধু ও অন্যান্যদের নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন৷
১৩১৯ বঙ্গাব্দে জগদ্ধাত্রীপূজার জন্য যে চাল প্রয়োজন তা যোগান দিতে কলকাতা থেকে ফেরার সময় কেদারবাবুকে কিছু টাকা দিয়ে বলেন, “জগদ্ধাত্রীপূজার জন্য ধান কিনে কিছু চাল করিয়ে রাখবে।” স্বামী ঈশানানন্দজী (বরদা)-র কথায় ১৩২২ সালে (১৯১৫) ভাদ্রমাসে কোয়ালপাড়ায় সবান্ধবে পনেরো দিন অবস্থান করে যখন জয়রামবাটিতে চলে গেলেন, যাবার আগে কোয়ালপাড়া আশ্রমের সকলকে জগদ্ধাত্রীপূজায় যোগদান করবার জন্য বিশেষভাবে বলে গেলেন। সে বছর কোয়ালপাড়া থেকে যাঁর ভাণ্ডারী হয়ে যাবার কথা ছিল, সে হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় লেখক ঐ কাজের ভার নিয়ে পূজার আগের দিন জয়রামবাটিতে উপস্থিত হলেন।ভাণ্ডার হয়েছিল মায়ের ভাই কালীমামার বাড়ির পূর্বদ্বারী ঘরে। পূজার দিন সকাল থেকে মা ভাণ্ডারে মাঝে মাঝে এসে একটি বস্তার উপর পা ঝুলিয়ে বসে বরদাকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথম পূজা শেষ হলে পুষ্পাঞ্জলি দিতে এলেন। স্নান করে মামীদের সঙ্গে নিয়ে মণ্ডপে এলেন। তিনবার দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি হল। তিনি গলবস্ত্রে জোড়হাত করে একধারে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তিন পর্বে পূজা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলে বিকেলে জয়রামবাটি গ্রামের বহু মানুষ বসে প্রসাদ পেলেন। সেবার পূজার সময় সারাদিন অল্প অল্প বৃষ্টি হয়। বরদার ঠাণ্ডা লেগে সেই রাত্রে সামান্য জ্বর হয়। পরদিন তাই সকাল থেকে ভাণ্ডার ঘরেরই একধারে শুয়ে রইলেন। সেদিন তাই ভাণ্ডারের সবকাজ সামলে নিলেন মা নিজে। বরদা সারাদিন উপবাসী, বিকেলে দেবীর প্রসাদী ফল ও সাগু এনে বরদাকে খেতে দিলেন মা। সেদিন রাতে জ্বর আর এলো না। পূজাপোলক্ষ্যে অনেক সাধু-ব্রহ্মচারী ও ভক্তরা দূরদেশ থেকে এসেছিলেন। সন্ধ্যারতির পর সাধুভক্তেরা মায়ের বড়ভাইয়ের বৈঠকখানায় বসে ভজন গান আরম্ভ করলেন — “মাকে দেখব বলে ভাবনা কেউ করো নাকো আর,/ সে যে তোমার আমার মা শুধু নয়,/ জগতের মা সবাকার।”
মায়ের বাড়ি জগদ্ধাত্রীর নামে অর্পণনামা করা হয়েছিল। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে (১৯১৬) জয়রামবাটিতে জ্যৈষ্ঠমাসে মায়ের এই নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়। নূতন বাড়ি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল শরৎ মহারাজের, যদিও তিনি গৃহপ্রবেশের সময় উপস্থিত থাকতে পারেন নি। রামকৃষ্ণ মিশনের বিশেষ কাজে তাঁকে বৃন্দাবনে যেতে হয়। প্রায় মাসখানেক পরে তিনি জয়রামবাটি এলেন এই নূতন বাড়ি, পাশে পুণ্যপুকুর, কিছু জমি শ্রীশ্রীমা জগদ্ধাত্রীর নামে অর্পণনামা লিখে বেলুড়মঠের ট্রাস্টিদের উপর সেবা ও পরিচালনার ভার দিয়ে যাবেন। নূতন বাড়ি দেখে বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করলেন মহারাজ৷ আষাঢ়মাস, সদলবলে শ্রীমাকে নিয়ে কলকাতা ফেরার আগে কোয়ালপাড়া আশ্রমে (মায়ের বৈঠকখানা) একদিন বাস করে রেজিস্ট্রির কাজটি সম্পাদন করলেন। কোতলপুর থেকে রেজিস্ট্রারকে কোয়ালপাড়ায় আনা হল। আগেই ঠিক করা ছিল — সন্ধ্যায় সাব-রেজিস্ট্রার পালকি করে আসবেন এবং জমিটি রেজিস্ট্রি করে যাবেন। স্বামী ঈশানানন্দজীর কলমে আছে, “রেজিস্ট্রার সাহেব আসিয়া পালকি হইতে নামিলেন। তিনি জাতিতে মুসলমান, বয়স কম, ২৭-২৮ হইবে। শরৎ মহারাজ স্থূলকায়, বয়স প্রায় ৫০-এর উপর। রেজিস্ট্রার সাহেব পালকি হইতে নামিলে তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং বিশেষ সম্মানের সহিত ‘আসুন আসুন’ বলিয়া রেজিস্ট্রারকে অভ্যর্থনা জানাইলেন। রেজিস্ট্রার আসন গ্রহণ করিলে মহারাজ বসিলেন এবং নিজেই পাখা লইয়া তাঁহাকে বাতাস করিতে লাগিলেন।” শ্রীমা বাড়ির মধ্যে সকলের সঙ্গে বারান্দায় বসে রেজিস্ট্রারের দুই একটি প্রশ্নের জবাব দিলেন এবং টিপসই দিয়ে কাজ শেষ করলেন। ১৯১৬ সালের ৭ ই জুলাই শরৎ মহারাজের গুরুদায়িত্বে মা সারদার অর্পণনামা রেজিস্ট্রি এইভাবে সম্পন্ন হল এবং সেখানে মা জগদ্ধাত্রী পূজার পাকাপাকি ব্যবস্থা হল।
১৩২৪ বঙ্গাব্দে (১৯১৭) জয়রামবাটিতে নূতন বাড়িতে জগদ্ধাত্রীপূজা অনুষ্ঠিত হয়৷ সেবার মায়ের অধীর আগ্রহ। দুর্গাপূজার পরদিন থেকেই গণনা করে চলেছেন, আর এই কয়দিন আছে। সে বছর পূজার আগেরদিন রাজেন দা এবং বরদা জয়রামবাটিতে এলেন। পূজার দিন সকাল থেকে মা গলবস্ত্র হয়ে মাঝেমধ্যে প্রতিমার কাছে প্রণাম করে প্রার্থনা করছেন, যেন নির্বিঘ্নে পূজা সম্পন্ন হয়ে যায়। সেই বছর পৌরোহিত্য করলেন পুকুরিয়া গ্রামের হৃষীকেশ ভট্টাচার্য। তন্ত্রধারক হলেন মায়ের বাপের বাড়ির কুলগুরু। প্রতিমায় তিন পুজো সম্পন্ন হল। প্রথম পূজায় নিবেদন করা হল খিচুড়ি ভোগ, দ্বিতীয় পূজায় লুচি আর নানান রকম ভাজা, তৃতীয় পূজায় নিবেদিত হল অন্নভোগ। আরতি ও হোম সম্পন্ন হল। দেবীকে প্রণাম করলেন মা; কুলগুরুকেও প্রণাম করে পদধূলি নিলেন। পূজককেও প্রণাম করতে গেলে, পূজক বাঁধা দিয়ে সরে গেলেন, “মা, আপনি আমাদের প্রণাম করছেন কি! আশীর্বাদ করুন।”
১৩২৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস। যোগেন মহারাজ কলকাতা থেকে একটি কাঠের সিন্দুক বরদা এবং তাঁর সঙ্গীদের হাতে মায়ের জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বরদা তা দিতে ভুলে গেছেন, মা’ও ভুলে গেছেন। সিন্দুকটি কোয়ালপাড়াতেই পড়ে রয়েছে। মা তখন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন, বলছেন, “জগদ্ধাত্রীর জিনিস তাতে রাখবার কথা, আমি তো ভুলেই গেছি। তোমারও ভুল হলো? সেটা কোয়ালপাড়ায় পড়ে রইল? কাল সকালে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে নিয়ে এসো। ভোরে চলে যেও, কালই একটা ব্যবস্থা করে এসো।” পরদিন সকালে বরদা কোয়ালপাড়া গিয়ে, কোতলপুর থেকে বার্নিশ আনিয়ে সিন্দুকটি নিজে ঘষে বার্নিশ লাগালেন। বার্নিশ শুকালে তার পরের দিন মুটের দ্বারা জয়রামবাটিতে আনাবার বন্দোবস্ত করলেন। এবং আগের রাতেই নদীতে সাঁতার কেটে মায়ের কাছে ফিরে এলেন। অধিক রাতে নদীতে ডোঙার লোক ছিল না। সিন্দুকটি পরদিন যথাসময়ে এসে পৌঁছাল। ১৩২৭ সালের (১৯২০) জগদ্ধাত্রী পূজার সময় মা আর পার্থিব শরীরে ছিলেন না৷
শ্রীমায়ের একান্ত সেবক তথা জয়রামবাটি মাতৃমন্দিরের প্রাক্তন প্রয়াত অধ্যক্ষ স্বামী পরমেশ্বরানন্দজী লিখছেন, “শ্রীশ্রীজগদ্ধাত্রীপূজার সময় প্রায় প্রতি বৎসরই আমাকে জয়রামবাটিতে উপস্থিত থাকিতে হইত। তখন পূজার জোগাড় দিবার এবং ভোগাদির ব্যবস্থার জন্য বিশেষ করিয়া আমাকেই নিযুক্ত হইতে হইত। শ্রীশ্রীমা নিজে সব দেখাইয়া দিতেন।” পরমেশ্বরানন্দজী মায়ের শেষবারের জগদ্ধাত্রীপূজার কথা লিখেছেন। মা তখন বারংবার ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, শরীর শীর্ণ হয়ে যায়। উদ্বোধন থেকে শরৎ মহারাজের বার্তা জিনিসপত্র নিয়ে পরমেশ্বরানন্দজী কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুর স্টেশনে পৌঁছালেন। বিকেলে সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে একটি গরুরগাড়িতে যাত্রা শুরু করলেন৷ সমস্ত রাত পেরিয়ে পরের দিন পৌঁছালেন জয়রামবাটি। মায়ের শরীর অত্যন্ত খারাপ থাকা সত্ত্বেও মায়ের আদেশে পূজার ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রতিমা গড়া, বাজার করা, নানান জিনিস সংগ্রহ সব কিছুই চলছে, মা কাজগুলি দেখিয়ে দিচ্ছেন।
কোন পাত্রে ভোগ, কোন পাত্রে সরবৎ, কীরকম নৈবেদ্য প্রভৃতি। তবুও মা রয়েছেন অন্তর্মুখী। কালীমামার গৃহে যে সমস্ত পূজার জিনিস অন্যান্য বার থাকে, তা এবার আনার ব্যবস্থা করাচ্ছেন তিনি; যেন সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আনছেন। মামীরা নন, এবার মায়ের ভক্ত ও ব্রহ্মচারীরাই আলপনা দিলেন, মায়ের নির্দেশে। পরমেশ্বরানন্দজীর আলপনা দেখে মা আনন্দ পেলেন৷ মা বলে দিলেন, কোন পূজার নৈবেদ্য কারা পাবেন। প্রথম পূজার নৈবেদ্য পাবেন মায়ের বাবার গুরুবংশের তন্ত্রধারক, দ্বিতীয় নৈবেদ্য পাবেন মায়ের বাবার পুরোহিত বংশ, তৃতীয় পূজার নৈবেদ্য পাবেন মায়ের ভিক্ষাভাইদের বংশধর। কামার, কুমার, ঢাকী, বাঁড়ুয্যে, নাপিতের ভাগও বলে দিলেন।
আজও মায়ের নির্দেশে ঐশ্বর্যশালিনী, রাজরাজেশ্বরী দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা তিন দিন ধরে হয়, প্রথম দিন ষোড়শোপচারে, পরের দুই দিন সাধারণভাবে। দেবীর দুইপাশে জয়া-বিজয়ার পূজাও হয়।
শ্রীমা কে? তিনিই কী শ্রীরামকৃষ্ণের সারদা ‘সরস্বতী’? জ্ঞান দিতে এসেছেন, রূপ গোপন করেছেন? তিনিই কি ষোড়শী ত্রিপুরাসুন্দরী, ঠাকুর যাকে পূজা করেছেন? তিনিই কী স্বামী বিবেকানন্দের ‘জ্যান্ত দুর্গা’? তিনিই কী সারদা-জগদ্ধাত্রী হয়ে বসে পূজা পাচ্ছেন? কোনো ঐশ্বর্য নেই, অথচ মহাশক্তি! তিনি ধীরে ধীরে অসংখ্য মানুষের কাছে এখনও মা হয়ে উঠছেন।
শ্রীমায়ের গ্রামে জগদ্ধাত্রী পূজা হচ্ছে। মা তখন ছোট্ট বালিকা। জয়রামবাটির হলদেপুকুরে রামহৃদয় ঘোষালের পূজামণ্ডপ। গ্রামের রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা, ছোট্ট মেয়ে নিবিষ্টমনে ধ্যান করছে। রামহৃদয় বাবু দেখছেন, জগদ্ধাত্রীর সম্মুখে যেন আর এক জগদ্ধাত্রী! দেবীর সম্মুখ যেন মানবী নয়, দুজনেই দেবী! তিনি আচমকা বলে উঠলেন, “ও সাধারণ নয়। ও জগদ্ধাত্রী! একদিন মানুষ ওর পূজা করবে।”
১৩২৬ বঙ্গাব্দের (১৯১৯) দুর্গাপূজায় জয়রামবাটিতে রয়েছেন মা। অনেক পদ্মফুল তুলে এনেছেন মায়ের ভক্তেরা। মা কতকগুলি ফুল থালাতে সাজিয়ে চন্দন, ধূপ দিয়ে, আর একটি থালায় ফল-মিষ্টি-সিঁদূর সাজিয়ে প্রিয় ভক্তদ্বয়কে (বরদা ও হরি) পাঠালেন সিংহবাহিনীর পূজা দিয়ে আসতে। মা নিজের ট্রাঙ্ক নামিয়ে দুইখানা নতুন লাল নরুন-পাড় ধুতি বের করে দিয়েছেন তাদের। সন্ধিপূজার সময় তক্তাপোশে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। ভক্তরা তাঁর পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিচ্ছেন। মা বললেন, আরও ফুল এনে রাখাল, তারক, শরৎ, খোকা, যোগেন, গোলাপ প্রমুখের নাম করে ফুল দিতে; জানা-অজানা সব ছেলেদের হয়ে, সকলের হয়ে ফুল দিতে বললেন বরদাকে। শ্রীমা জোড়হাতে ঠাকুরের ছবির দিকে চেয়ে আছেন, আর বলছেন, “সকলের ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল হোক। ঠাকুর, তুমি সকলকে দেখো।
তথ্যসূত্র:
১. শ্রীম কথিত শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত (অখণ্ড), উদ্বোধন।
২. শিবের শক্তি জীবের জননী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, উদ্বোধন।
৩. মাতৃসান্নিধ্যে, স্বামী ঈশানানন্দ, উদ্বোধন।
৪. শ্রীশ্রীমা ও জয়রামবাটি, স্বামী পরমেশ্বরানন্দ, শ্রীশ্রীমাতৃমন্দির, জয়রামবাটি।
মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কল্যাণ চক্রবর্তী