[বনফুল/ Balai Chand Mukhopadhyay (19 July 1899 – 9 February 1979) ]
‘ডানা’ বনফুল বা বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি উপন্যাসের নাম। ‘ডানা’ ঐ উপন্যাসের একটি চরিত্রেরও নাম। যে কোনো লেখকের জীবনাভিজ্ঞতা থেকে পাখি বার বার আসে তাঁর সাহিত্যে, বনফুলের ‘ডানা’ উপন্যাস তার ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্রনাথ মানব জীবনের গতিকে ডানার গতির মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাই হংসবলাকার ডানায় দেখেছিলেন অনন্তকালের বেগের আবেগ। জীবনের এই গতিকে ডানার বলাকা-মনের চিত্রণের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন বনফুল। তিনি বনদেবী ডায়নাকে আনলেন ডানা রূপে। ডানার গতি সঞ্চারিত হল বনে বনান্তরে। বন্ধন না থাকলে মুক্তির আনন্দ কোথায়? একটানা উড়ে যাওয়ার মাঝেও যে বিশ্রাম চাই! মন উড়ে গেলেও চাই প্রকৃতির ভিত্তি, মৃত্তিকার পয়োধী। বন্ধনের মধ্যেকার মুক্তিই হল ‘মুক্তি’, ভিতের স্থিতি থেকে সুদুরের অভিযানই হল ‘গতি’। এই গতিজাড্য জীবনে ধরে রাখাই ‘ডানা’র মূল কথা। শেখালেন বনফুল।
‘ডানা’ উপন্যাসে ডানা এসেছে গতির প্রতীক হয়ে। কিন্তু উপন্যাসের কাহিনীতে এক বাস্তব ভিত্তিভূমি চাই ডানার। সেই জন্য অজস্র ডানার অবতারণা করতে গিয়ে বনফুল আনলেন অজস্র পাখির প্রসঙ্গ। কবি, বৈজ্ঞানিক, রূপচাঁদ মল্লিক – সকলেই পক্ষী পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু সকলের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা। কবির কাছে পাখিরা অনন্ত, সুদূর অভিযানের প্রতীক। বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টি ভঙ্গী নিখুঁত পর্যবেক্ষকের। বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে পক্ষী জগতকে নিজ জ্ঞান- সাম্রাজ্যে ধরে রাখা তার কাজ। পাখিদের যাবতীয় খবর – তাদের স্বভাব, চেহারা, খাদ্যগ্রহণের স্বভাব, জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠে যে বিষয়টি, তা হল পক্ষীতত্ত্ববিদ্যা (Ornithology)।
বনফুল এই উপন্যাসে প্রায় ১৬৪ টি পাখির নাম বলেছেন। অনেকসময় কোনো কোনো পাখি দেখে কবি তার নিজস্ব একটি নামকরণ করেছেন। আবার কখনো পাখিদের বৈজ্ঞানিক নাম উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে। শুধু পাখিদের নাম নয়, রূপ স্বভাব প্রভৃতি সম্পর্কেও বিভিন্ন তথ্য ডানা উপন্যাসে রয়েছে। পক্ষীবিদ্যা বা অরনিথোলজি সম্পর্কে বনফুলের গভীর জ্ঞানের দ্যোতক এই উপন্যাসটি। ডানা উপন্যাসে বর্ণিত পাখিদের সম্পর্কে অনেকানেক তথ্য আলোচ্য প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে উপন্যাসে নেই অথচ সংশ্লিষ্ট এমন অনেক পাখিদের বৈজ্ঞানিক নাম তুলে ধরা হয়েছে। এই ভাবে ডানা উপন্যাসে পাখি – বৈচিত্রের সারণীটি সম্পূর্ণ।
পাখির স্থানীয় নাম, বৈজ্ঞানিক নাম, তার রূপ, তার ডাকার শব্দ – এসব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায় ডানা উপন্যাসে, যেমন ‘‘ইংরেজীতে বলে বারবেট। অনেক রকম বারবেট আছে। এ অঞ্চলে আর এক বারবেট আছে, তার ইংরেজি নাম কপারস্মিথ । বৈজ্ঞানিক নাম Xantholaema heamacephala বাংলা নাম বসন্ত বউড়ি। সবুজ রঙ, তার উপর হালকা সাদার ডোরাকাটা বুকের কাছটায়। ছোটো পাখিটার মাথায় আর বুকে লাল। বড়টার মাথার রঙ তামাটে। ছোটো পাখিটার অনেক গুলো দেশী নাম আছে- গয়লা বুড়ি, ভগীরথ, কলাপাখি, জোকারে পাখি। ওই শুনুন, ছোটো পাখিটা মানে গয়লাবুড়ি ডাকছে।”
রবীন্দ্রনাথ বহু বিদেশী ফুলের বাংলা নাম দিয়েছিলেন। বনফুলও ডানা উপন্যাসে বহু পাখির বাংলা নামকরণ করেছেন। যেমন মিনিভেট বা সাতসয়ালীর নাম দিয়েছেন ‘আলতাপরী’
পাখিদের স্বভাব গুলি চিত্রিত করেছেন বাস্তব অদ্ভুত একটি বুদ্ধিদীপ্ত ঢঙ্গে । যেমন নীলকণ্ঠ পাখির কথা । অনেক সময় পাখির বর্ণনায় এসেছে লেখকের নিজস্ব দর্শন, আর্থ সামাজিক চেতনা । পাখির সন্তান পালন সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য সরাসরি উল্লেখ এসেছে, যেমন শকুনের কথা। পাখির বাসা নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। যেমন বাবুই পাখি , দর্জি পাখিদের বাসা এবং ধনেশ পাখির বাসা সম্পর্কে। পাখির মল বা dropping নিয়েও আলোচনা আছে। যেমন ধনেশ পাখির মল দিয়ে বাসার গর্তের মুখ বোজানোর কথা ।
বনফুলের ছেলেবেলা কেটেছিল কুকুর ছানা, বেজি, খরগোশ, পায়রা, শালিখ, টিয়া, ইঁদুর, – এসবের মধ্যে। প্রভৃতি ও মনুষ্যেতরর মধ্যে বড় হয়ে ওঠা বনফুল চিরকালই পাখি সম্পর্কে ছিলেন আগ্রহী। এই আগ্রহের গভীরতা মেপে নেওয়া যায় ‘ডানা’ উপন্যাসটিতে।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার এম. বন্দ্যোপাধ্যায়)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী