ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজ বলবো মাতৃশক্তি সারদা মা-কে নিয়ে। প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে, মাতৃশক্তি বলতে কী বুঝি?
মা তাঁর শরীরের সকল সারবস্তু দিয়ে নিজ গর্ভে সন্তানকে ধারণ করে অসহ্য যন্ত্রণা অতিক্রম করে শিশুর জন্ম দেন এবং জন্মের পরেও সদ্যোজাতকে স্তনপান করিয়ে বাল্যে উপনীত করেন। এ কাজটি মনুষ্য হতে মানুষ্যেতর সকল মাতারই এক জৈব-কর্তব্য। কিন্তু মনুষ্য-মাতা এর অতিরিক্ত কিছু করে থাকেন। তিনি নিজ সংস্কার, ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা ও জীবনাচরণ দিয়ে শিশুর জন্য একটি জগৎ তৈরি করে দেন। এই জায়গাটি তৈরি করতে গিয়ে মা তাঁর প্রভাব সন্তানের উপর ফেলেন। নিজেকে আড়ালে রেখে, নিজের সমস্তটা উজাড় করে দেন মা তাঁর সন্তানের ভালোর জন্য। মাতার ব্যক্তিত্ব যদি শক্তিশালী হয়, শিক্ষা যদি নৈতিক হয়, তবে সন্তান দৃঢ়চেতা ও নীতিবাদী হতেই হবে।
তাহলে মাতৃশক্তি হল এমন এক শক্তিশালী, দৃঢ়চেতা অথচ স্নেহপ্রবণ নারী-ব্যক্তিত্ব, যিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শ-মাতার অনুপ্রেরণা ও দৃষ্টান্ত নিয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হন।
এবারে বলি, কেন মা সারদাকে মনে করি, মাতৃশক্তি?
এক।। স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ বলছেন, পৃথিবীর সকলের প্রতি ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের মাতৃভাব। কিন্তু তাঁর পুরুষ-শরীরে সেই ভাবের বাঞ্ছিত বিকাশ সম্ভব ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন ছিল সমতুল শক্তিসম্পন্ন আরেকটি বিগ্রহের। সেই বিগ্রহ সারদাদেবী। তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মাতৃভাব বিকাশের জন্য রেখে গেলেন।” এক সাধারণ গ্রামের বধূ; যিনি সকলের সামনে চাদরের আড়ালে থাকতেন, ভালো করে কথাও বলতে পারতেন না, তিনি কী আদৌ মাতৃশক্তি হতে পারেন? স্নেহময়ী মাতার নীরব উপস্থিতি যে কত অজস্র সন্তানের অন্তরে প্রসারিত ছিল, তার বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া সম্ভব। শুধু একটিই উদ্ধৃতি দেবো। দার্শনিক ড. আর. বি. রিবাকভ স্বামী লোকেশ্বরানন্দজীকে একটি চিঠিতে লেখেন, “She was an ordinary Indian village girl and He made her into an absolutely outstanding personality which for me is a symbol of India herself. Divine, yet human, a real woman, but saintly, the Mother has an irresistible appeal to me.”
দুই।। নিজেকে সাবলাইম করেছেন তিনি, বিলীন করেছেন মা সারদা, প্রতিটি মুহূর্তে। কখনও কোনো শিষ্যা বা ভক্ত যদি বলতেন, মা, তোমার কৃপায় ভালই আছি। মা রেগে বলতেন, আমার আবার কৃপা কি? বলো, ঠাকুরের কৃপায় ভালো আছো। নিজেকে নেপথ্যে রেখে এভাবেই তিনি সন্তানের মধ্যে প্রসারিত করতেন শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন।
আমরা আজ তাঁকে কতটা মাতৃশক্তি হিসাবে নিতে পেরেছি জানি না। তবে সত্যিই যদি নিতে পারতাম, তাহলে প্রতিদিনের জীবনচর্যায় ছুঁচো-ইঁদুরের দৌড়ে হয়তো নিজের ঢাক নিজে পেটানোর কৃত্য থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারতাম।