অখিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংস্কার ভারতী আসমুদ্র হিমাচল ভারতের সনাতন সংস্কৃতি রক্ষায় কাজ করে চলেছে। সংস্কার ভারতী ঐতিহ্য ও প্রথা অনুসারে ভাব-সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়।
“সাধয়তি সংস্কার ভারতী ভারতে নবজীবনম। “
এরপর আমরা শুনি নববর্ষের গান। ভাবসঙ্গীত পরিবেশন করেন ছায়া মজুমদার, অন্নপূর্ণা ভট্টাচার্য, রীতা ঘোষাল, অঞ্জনা মল্লিক, সীমা দে, জয়া সিনহা রায়, কৃষ্ণা ব্যানার্জি, কৃষ্ণা বসু, পাপিয়া দত্ত, তনুশ্রী দাস, সান্ত্বনা চক্রবর্তী, সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য, জয়দীপ চক্রবর্তী, রীণা ব্যানার্জী, সোনালী ভট্টাচার্য, মৌসুমী মুখোপাধ্যায়, সীমা জানা, সুতপা কর্মকার ও গর্বিত দাস।
অতীতের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার ধারাবাহিকতা নিয়েই বর্ষ-বরণ! মন মানে না, অতীত দিনের ভুলের ফর্দ যে আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়! এখনও যদি অতীতচারী না হই; নিজের, সমাজের, রাষ্ট্রের কৃতকর্মের অন্যায় সংশোধন না করি তবে আগামীর নববর্ষ আমাদের ক্ষমা করবে না।
এই সকল বার্তা নিয়েই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা প্রারম্ভ করলেন তিলক সেনগুপ্ত মহাশয়।
সমৃদ্ধ ভারত, কুশল-রাজ্য যদি নির্মাণ করতে হয় তবে অতীত-চারণ করতেই হবে। নববর্ষের আনন্দবার্তার মাঝে তাই ফেলে আসা দিনগুলির ত্রুটি স্বীকার করে সজাগ হতে হবে। এর মাঝেই অবশ্য পূর্বের সদর্থক আনন্দ-রসও যেন ঢেলে নিতে পারি নতুন পাত্রে – এই মন্ত্রে দেওয়ালপঞ্জীর লোকার্পণ ও নববর্ষ আবাহন অনুষ্ঠান পালন করে সংস্কার ভারতী, দক্ষিণবঙ্গ। প্রকাশিত হয় সাংস্কৃতিক দেওয়ালপঞ্জী (বঙ্গাব্দ ১৪৩০) যার মূল ভাবনা / থিম হল “বাংলার আলপনা (Alponas of Bengal)” প্রকাশনা সহায়তা : পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র । পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহ, ভারতীয়ম, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, সল্টলেক, কলকাতায় ৩০ চৈত্র ১৪২৯ (ইং ১৪ এপ্রিল ২০২৩) শুক্রবার, বিকেল ৫:৩০ ঘটিকায় এই অনুষ্ঠান শুরু হয়। আয়োজক ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি ন্যাস।
সংস্কৃতির আদি গুরু নটরাজ মূর্তির সম্মুখে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। দীপমন্ত্রে শ্রীমতী সোমা চক্রবর্তী সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন।
অতিথিদের চন্দন পরিয়ে বরণ করেন মেহেন্দি চক্রবর্তী। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শ্ৰী জয়ন্ত পাল (সম্পর্ক অধিকারী।), শ্রী রুদ্রনীল ঘোষ (স্বনামধন্য অভিনেতা), শ্রী অজয় নন্দী। (বিশিষ্ট আইনজীবী), ড: সায়ন ভট্টাচার্য (শিক্ষা আধিকারিক, ভারতীয় সংগ্রহালয়), পণ্ডিত জয়দীপ ঘোষ, ডা: নির্মাল্য রায়চৌধুরী (বিশিষ্ট চিকিৎসক), শ্রীমতী নীলাঞ্জনা রায় (সংস্কার ভারতীর কেন্দ্রীয় সম্পাদিকা) ও শ্রী সুভাষ ভট্টাচার্য। (সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য)।
অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন সংস্কার ভারতীর প্রান্ত কোষাধ্যক্ষ- গোপাল কুণ্ডু ও সহ সাধারণ সম্পাদক অমিত দে।
পাশাপাশি সর্বসমক্ষে ভাস্কর্য নির্মাণ করতে দেখা যায় শ্রীমান শীর্ষ আচার্যকে।
এরপর অতিথিদের চারা গাছ তুলে দেন ডঃ স্বপন মুখোপাধ্যায় ও শ্রীমতি রীনা ব্যানার্জি।
“এবার আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,
শুরু হয় দেওয়ালপঞ্জীর লোকার্পণ।”
সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তের গত ১২ বছর ধরে প্রকাশ করে চলেছে সাংস্কৃতিক দেওয়ালপঞ্জী। এই গর্ব কে পাথেয় করে এবারের দেওয়ালপঞ্জীর বিষয়– “বাংলার আলপনা”। দেওয়ালপঞ্জী নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিগণ।
তথ্য ঋণ : অধ্যাপক ড: কল্যাণ চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ কথা ও আলপনা : অধ্যাপক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন
চিত্রাঙ্কন : অধ্যাপক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, জয়দেব বণিক, দীপক দাস, অরিত্র ঘোষ দস্তিদার, কনাদ দাস, জয়দীপ ভকত, অরূপ দাস, ঋদ্ধি বণিক, সোমা হাজরা ও দেবপর্ণা চক্রবর্তী।
আলপনা পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন চিত্রকলার বিবর্তিত রূপ; আদিম গুহাচিত্রের এক উজ্জ্বল ভৌমাঙ্কন। সংস্কৃত ‘আলিম্পন’ শব্দ থেকে ‘আলপনা’ কথাটি এসেছে; এর অর্থ দেবস্থান লেপন। নামের উৎস সন্ধানের মধ্যেই হিন্দু সনাতনী সংস্কৃতির পরত। কথাটি ‘তদ্ভবীকরণ’ করে ব্রজবুলিতে হয়েছে ‘আলিম্পন’ আর বাংলায় হল ‘আলপনা’।
প্রাককথনে মঞ্চ পরিচালিকা, শ্রীমতী মহাশ্বেতা চক্রবর্তী জানান কিভাবে এই দেওয়ালপঞ্জী নির্মাণ হয়, সকলের সমবেত প্রচেষ্টায়।
এই অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল “নটরাজ সম্মান” প্রদান। দীর্ঘ দিন আগে এই পর্বটি শুরু হয়েছিল। এর আগে সংস্কার ভারতী অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে এই সম্মান প্রদান করে। এবার থেকে প্রতিবছর নববর্ষ আবাহন উৎসবে বাংলার শিল্প ক্ষেত্রে অনন্য আবদানের জন্য এই সন্মান প্রদান করা হবে বলে জানা যায়।
‘নটরাজ সম্মান’ প্রাপক ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সরোদবাদক পণ্ডিত জয়দীপ ঘোষ।
“অমৃত এনে দিয়েছো প্রাণে পরাণ শোষি দুঃখ
গৌণ যাহা না গনি তাহে চিনিয়ে দিলে মুখ্য- “
শ্রীমতী লিপিকা চৌধুরী আবৃত্তি করেন অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর লেখা কবিতা “জয় শশাঙ্ক”। কবিতাটি ছিল এমনতর-
“অপরাজিত বঙ্গাধিপতি
শশাঙ্ক মহারাজ
কানসোনাতে রাজধানী হতে
হর্ষে দিয়েছে বাজ।
মগধ, গৌড়, রাঢ় দেশ গাঁথে
উড়িষ্যা ভুবনেশ্বর
রাজনৈতিক সম্প্রসারে
কেঁপে ওঠে স্থানেশ্বর।
একদিকে তিনি রক্ষা করেন
হিন্দুত্বের ওই মতি
পরমতসহিষ্ণু তবু
মহাবিহারেরও স্থিতি।
জলকষ্টে দীঘির জল
‘শরশঙ্ক’ খোঁড়েন
নালন্দাতে বাড়ান হাত
ঐতিহ্যতে মোড়েন।
কৃষি শিল্প জ্ঞানচর্চা
বাণিজ্যে অগ্রগতি
এমন রাজ্য শাসন করেন
গৌড়ের অধিপতি।
বঙ্গাব্দের সূচনা খানা
হয়ে যায় তাঁর হস্তে
পাঁচশত তিরানব্বই সাল
বিয়োগ করার ন্যস্তে।
বাদ দাও যদি অঙ্কটা ওই
দু’হাজার পার তে’শ
চৌদ্দোশ ত্রিশ এলো
এলো বাঙালির বেশ।
এরপর “বঙ্গাব্দের প্রবর্তক মহারাজা শশাঙ্ক” বিষয় আলোচনা করেন শ্রীমতী নীলাঞ্জনা রায়।
“সত্যিকারের বাঙালিকে, বীর বাঙালিকে ভুলে যাওয়া, বা ভুলতে চাওয়া বাঙালির অভ্যাস। এমনই এক বীর বাঙালি ছিলেন শশাঙ্ক ছিলেন সার্বভৌম এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। অথচ তিনি, গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। হিন্দু বীর বলেই কী!
প্রায় সোওয়া চৌদ্দশো বছর আগে ভারতবর্ষের পূর্বাংশে শুরু হয়েছিল তাঁর বিজয়যাত্রা। তিনি বর্তমান মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি গুপ্ত বংশীয় এক নরপতি, নরেন্দ্রগুপ্ত বা নরেন্দ্রাদিতা তাঁর প্রকৃত নাম।” বাংলা নববর্ষে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ককে যেন মনে রাখি। কারণ তার হাত ধরেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়। এই সকল বিষয়ে আলোচনা করেন শ্রীমতী নীলাঞ্জনা রায়। তাঁর বক্তব্যে নানান তথ্য ও হিসাব পাই আমরা, যা বারে বারে বুঝিয়ে দেয় এই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক মহারাজা শশাঙ্ক।
এরপর অতিথিদের বক্তব্যের পর সরোদবাদন পরিবেশনা করেন পণ্ডিত জয়দীপ ঘোষ।
একই সাথে সম্পন্ন হল ভাষ্কর্য নির্মাণের কাজ। শ্রীমান শীর্ষ আচার্যকে এই অসামান্য কীর্তির জন্য সংবর্ধনা জানানো হল।
যেমন সুন্দর সেই মহারাজ শশাঙ্ক -এর ভাস্কর্য, তেমনই সুন্দর ছিল মঞ্চ সজ্জা। জানা যায় এই মঞ্চ সজ্জার দায়িত্ব পালন করেছিলেন সুশ্রী মেহেন্দি চক্রবর্তী।এছাড়াও প্রেক্ষাগৃহ ভূ-অলংকরণ এর দায়িত্বভার সামলান জয়দেব বণিক, ঋত্বিক দেবনাথ, অরূপ দাস, প্রবীর তালুকদার, স্পন্দন মাহাতো, সোমা হাজরা, অন্বেষা দেবনাথ ও রিম্পা পাল।
অবশেষে শ্রী ভরত কুণ্ডু মহাশয়ের কণ্ঠে রাষ্ট্রগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এই কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।
অরিত্র ঘোষ দস্তিদার।