বৈশাখের শুক্লপক্ষে চন্দন ষষ্ঠী — ব্রত পালিত হত সন্তানকে ধুলোবালি-মুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেবার কামনাতেই।

আজ চন্দন ষষ্ঠী (৭ ই মে, ২০২২)। বাংলার চন্দন-সংস্কৃতির এক অনবদ্য অধ্যায় ( Sandal-lore )। সে শ্বেতচন্দনের কথা, বিজ্ঞানসম্মত নাম Santalum album , Santalaceae পরিবারের গাছ, ইংরেজিতে Sandalwood tree । পেনিসিলিনের মত ওষুধ যখন ছিল না, তখন চন্দন তেল ও তার পাউডার দিয়েই দেহাভ্যন্তরের হরেক রোগের জ্বালাযন্ত্রণা সারাতেন লোক চিকিৎসক। বাংলার ফোক-হিলারও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। বলা হত “ডাবের জল মায়ের বল”, আর ছিল ‘চন্দন-স্নান’। এ দু’য়ের মিশ্রণ অর্থাৎ কচি ডাবের জলের মধ্যে আধ চামচ বাটা-চন্দন গুলিয়ে সেই সময় গ্রহণ করতেন রোদে পোড়া মানুষ, জুড়োতে দেহের সীমাহীন জ্বালা-যন্ত্রণা। চন্দন ষষ্ঠীতে তাই মাতৃদেবী, সন্তান রক্ষক-দেবী ষষ্ঠী আপামর সন্তানের রোগ-জ্বালা দূর করবেন, এটাই দিনটির মূলবার্তা। প্রকৃতির সামীপ্যে থাকার আরও একটি কৃত্য ও ব্রত, এক লোককৃষ্টি।

এ রাজ্যে চন্দন গাছের চাষ না হলেও তার সুগন্ধি কাঠ বাঙালি এক অপূর্ব দৈনন্দিনতায় মান্যতা দিয়ে এসেছে। তারই শিকড় শাস্ত্রীয় এবং লৌকিক — উভয় ধারার অনুষ্ঠানের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। বৈষ্ণব ভক্ত ও মহাজন সম্প্রদায়ের চন্দন-প্রীতি তো আছেই। এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে জ্যৈষ্ঠমাস জুড়ে বাঙালি মেয়েদের শিবের মতো বর লাভের কামনায় চাঁপা-চন্দন ব্রত উৎযাপন এবং নানান মন্দিরে বৈশাখের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে উৎযাপিত শ্রীজগন্নাথ দেবের চন্দন যাত্রার কথা। পুরীর মন্দিরে চন্দন যাত্রার এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। যে ২১ দিনে দৈনিক চন্দনচর্চিত হয়ে দেবতাদের প্রতিনিধি মূর্তি শোভাযাত্রায় রক্ষিত হয়ে পুরীর সিংহ দুয়ার থেকে নরেন্দ্রতীর্থ জলাধার অবধি পথ পরিক্রমা করেন, করেন নৌকাযোগে সান্ধ্য-জল-ভ্রমণ।

বাঙালি মায়েরা গ্রীষ্মের দিনগুলিতে আদরের সন্তানকে ধুলোবালি থেকে তুলে পরম মমতায় স্নান করিয়ে, পাটাতে শ্বেতচন্দন বেটে নিয়ে সারা গা-হাত-পা, মুখে আলতো করে মাখিয়ে দিতেন। তাতে গ্রীষ্মের খোস-পাঁচড়া দূর হত, ঘামাচি-রোদঠোঁট-জলগুটি-মাসিপিসি নানান রৌদ্র যন্ত্রণা দূর হত। এক শীতল আরামে গ্রীষ্মের দুপুর ও বিকেল অতিবাহিত করতে পারত সন্তান। তখন গাঁয়ে-গঞ্জে ইলেকট্রিক পাখা ছিল না, কুলার-রেফ্রিজারেটর ছিল না; শীতল পাটিতে শুয়ে তালপাখার বাতাসে মায়ের দেওয়া চন্দন-প্রলেপ যেত শুকিয়ে। তারপর দুপুরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা দেশী খাবার, বিকেলে মরশুমি ফল। এসব মিলিয়েই চন্দন ষষ্ঠীর আবহ।

আমার মায়ের আদরও ছোটোবেলায় এমনই ছিল। দৈনিক প্রসাধনী বলতে পাটায় চন্দন-বাটা। পুজোর ফুলচন্দনের পর তার অবশেষ আমাদের গায়ে-মুখে বুলিয়ে দিতেন মা। বৈশাখের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে বিশেষ করে উৎযাপিত হত চন্দন ষষ্ঠী। সকাল থেকে সন্তানবতী মায়েরা সেদিন উপবাস করেন, সারাদিন ঘর সংসারের আনাচ-কানাচ পরিস্কার রাখেন, ধুলোবালি সরান, তারপর স্নান সেরে এসে সন্তানকে স্নান করান, গায়ে মাখিয়ে দেন বাটা-চন্দন, আদরযত্ন করে খাওয়ান, সাঁঝের দখিনা বাতাস বইলে মনোরম চাঁদ উঠে এলে উপবাস ভঙ্গ করেন। তার আগে অনুষ্ঠিত হয় মা ষষ্ঠীর পূজা। দেবীকে চন্দন-চর্চিত ফুলমালা দেন ব্রতিনী। এই পুজোয় সুগন্ধি স্বর্ণচাঁপা, শ্বেতচাঁপা, গুলঞ্চ-চাঁপা ইত্যাদি ফুল দেবার নিয়ম। পূজা শেষে ব্রতকথা শোনান ব্রতিনী মা। সে এক প্রিয়ব্রত রাজার কথা। রাণীমার ষষ্ঠী পূজার গল্প। কাহিনীর প্রতিপাদ্য বিষয় — ব্রহ্মের ধ্যান করে রাজার পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন, যজ্ঞস্থল থেকে উৎসারিত চরুতে রক্ষিত খাদ্য রাণীকে প্রদান, রাণীর গর্ভসঞ্চার ও পুত্র-সন্তান প্রসব, রাজজ্যোতিষী কর্তৃক সন্তানের দীর্ঘজীবন ঘোষণা, তা সত্ত্বেও পুত্রের সংজ্ঞাহীনতা, দেবী ষষ্ঠীর আশীর্বাদে সেই সন্তানের সজ্ঞান হওয়ার কাহিনী এবং পরিশেষে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারে রাজার প্রচেষ্টা এবং দিনটির গ্রহণযোগ্যতা।


কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.