*দেশে দেশে ‘লাল সন্ত্রাস’

দ্বিতীয় পর্ব

দি গ্ৰেট ‘পার্জ’

বিশ্বের সবথেকে বড় গণহত্যার খলনায়ক ‘স্তালিন’। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর বিভিন্ন আর্কাইভ, ক্রুশ্চেভের ‘Secret Speech ‘ আর ভুক্তভোগীদের বিবরণ থেকে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে এই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
অবাক হতে হয়, এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্তালিনের ছবিকে সামনে রেখে মার্ক্সবাদকে প্রচার ও প্রসার করা হয় এবং মার্ক্সবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকার্তাদের সমালোচনা করা হয়। স্তালিনের ছবিকে সামনে রেখে যারা রাজনীতি করেন তাদের নৈতিকতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে।
কিন্তু সেই প্রশ্ন তাদের কে যে বিচলিত করে না, তার কারণ সমাজে এই কুখ্যাত স্বৈরাচারী শাসকের কুকীর্তি নিয়ে অজ্ঞতা ও কমিউনিস্ট ইকোসিস্টেমের সাহায্যে কমিউনিজমের নামে বিশ্ব ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলিকে সচতুরভাবে আড়াল করা ও রাজনৈতিক আলোচনা থেকে দূরে রাখা।

স্তালিনের শাসনকালে ‘গুলাগ’ , ‘পার্জ’ এই শব্দগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম ইতিহাস আর সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে সেই সময়কালের কুকীর্তিকে ঢেকে এই খলনায়ককে ‘নায়ক’ বানানোর অসাধ্য সাধন করতে পারা ‘কমিউনিস্ট ইকোসিস্টেম’ এর দক্ষতা !

গণতন্ত্রের মাধ্যমে যে দেশে সমাজ নির্মাণের তথা রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে সেই দেশে স্তালিনের ছবিকে সামনে রেখে রাজনীতি হতে পারে তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের বিষয়।
এই বিস্ময়কর ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে, ‘ দেশে দেশে কমিউনিজমের সন্ত্রাসের’ ইতিহাসের অজ্ঞতাকেই মূল কারণ হিসেবে পাওয়া যায়।
সেই অজ্ঞতার চাদর সরাতে আর রাজনীতিতে নৈতিকতা ও যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে, সমাজ নির্মাণের সঠিক পথ খুঁজে পেতে সমাজের সামনে কমিউনিস্ট স্বৈরাচারী স্তালিনের ইতিহাস রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯২৪ সালে লেনিনের শবযাত্রা। ব্যবস্থার দায়িত্বে আছে স্তালিন। তখনো পার্টিতে লেনিনের উত্তরসূরী হিসেবে গণ্য নয়। যারা সেদিন স্তালিনের সঙ্গে লেনিনের শব বহন করেছে , যারা বলশেভিক পার্টি ও বিপ্লবে লেনিনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে তাদের বেশিরভাগই কয়েক দশকে স্তালিনের আদেশে নিহত হতে চলেছে বা স্তালিনের কারণে আত্মহত্যা করবে !
১৯২৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পলিটব্যুরোর ৭ সদস্যের ( জোসেফ স্তালিন, নিকোলাই বুখারিন, মিখাইল টমস্কি, গ্ৰিগরি জিনোভিভ, লিওন ট্রটস্কি , লেভ কেমনেভ আর আলেক্সেই রেকভ) মধ্যে ১৯৪০ সাল আসতে আসতে একমাত্র বেঁচে থাকবে স্তালিন !
১৯৩৪ এর ডিসেম্বরে সার্গেই কিরভ লেনিনগ্ৰাদে এক আততায়ীর হাতে প্রাণ হারায়। অনেকে বলেন এই হত্যাকাণ্ডের পিছনেও স্তালিনের হাত ছিল।স্তালিনের কাছে সুযোগ এসে গেল বিরোধী কন্ঠস্বরকে বিলুপ্ত করার। ‘The Great Purge’ নামের বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে প্রায় সাত লক্ষ মানুষ কে নিকেশ করে স্তালিন। কিন্তু বিশ্বমঞ্চে স্তালিনের পাশবিক রূপ ঢাকতে অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের খামতি ছিল না।
মস্কোয় ১৯৩৫ সালের কংগ্রেসে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মরিস থোরেজ ব্যাখ্যা করে কিভাবে স্তালিন শ্রমিকদের গর্বিত করেছেন।
১৯২৬ সাল থেকেই‌ বিরোধীদের ‘জিনোভিভাইটস’ অথবা ‘ট্রটস্কাইটস’ তকমা দিয়ে পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ শুরু করে স্তালিন।গুপ্ত পুলিশকে শুধু প্রতিবিপ্লবীদের শায়েস্তা করতে ব্যবহার করা হয় নি বরং পার্টির অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যকে দমন করতেও ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘শ্রেণী সংগ্ৰাম’ তত্ত্ব দিয়ে শুধু সমাজকেই ভাগ করা হয় নি, যে কোনো মতপার্থক্য কে দমন করতে পার্টির অভ্যন্তরেই প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত সংগ্ৰাম চলছিল। গুপ্ত পুলিশ একসময় লেনিনগ্ৰাদে জিনোভিভের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করেছিল আর এখন জিনোভিভের সমর্থকদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার পালা। ১৯২৭ সালেই সমস্ত প্রধান নেতা ট্রটস্কি, জিনোভিভ, কেমনেভ, রাডেক, রাকোভস্কি পার্টি থেকে বহিষ্কৃত ও গ্ৰেফতার হয়েছিল।
১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত NKVD এর প্রধান হিসেবে নিকোলাই ইয়েজহভের সময় সাধারণ মানুষ থেকে পলিটব্যুরো পর্যন্ত অত্যাচারের শিকার হয়েছিল। লেনিনের খ্যাতিমান সঙ্গীদের প্রত্যেকেই সোভিয়েত সরকার বিরোধী কাজকর্ম , অন্তর্ঘাত, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙার চক্রান্তে জড়িত থাকা , সোভিয়েতের নেতাদের হত্যার চক্রান্তে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দেয়। মস্কোতে প্রথম সারির নেতাদের বিচারের নাটক, সোভিয়েত রাশিয়ায় ঘটে চলা সামাজিক উৎপীড়ন থেকে নজর ঘোরাতে সহায়ক হয়েছিল।
স্তালিনের একসময়ের বন্ধু বুখারিন।
কয়েকবার স্তালিনের নীতির বিরোধিতা করেছে।
এই অপরাধ করে স্তালিনের জীবনকালে কেউই বেঁচে থাকে নি! বুখারিন ব্যতিক্রম হবেন কেমন করে? স্তালিনের বিরোধী মানেই ‘Enemy of the People ‘ অর্থাৎ জনগণের শত্রু।
বুখারিন যৌথ খামার ব্যবস্থার সমালোচনা করে বলেছিল যে কুলাকদের ( তুলনামূলকভাবে বেশি জমির মালিক) অধিক ফলনের জন্য উৎসাহিত করা উচিত।
১৯২৯ সালে পলিটব্যুরো থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই বুখারিন নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিল। স্তালিনকে সন্তুষ্ট করার দিকেও ঝুঁকেছিল , ১৯৩৪ এর পার্টি কংগ্রেসে স্তালিনের স্তুতি গেয়ে বলে– “The members of the Communist Party ought to stand together to make the ideals of Comrade Stalin come true.”।
গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার লুবিয়াঙ্কায় বুখারিনকে অত্যাচার করা হয়।
এর মধ্যেই ১৯৩৬ সালে বুখারিনের পলিটব্যুরোর সাথি কেমনেভ ও জিনোভিভ কে লোকদেখানো বিচারের (Show trial) মাধ্যমে হত্যা করা হয় । তাদের ‘কুকুরের মতো হত্যা’ করায় বুখারিন খুশি প্রকাশ করে। জিনোভিভ, সেই ব্যক্তি যে বুখারিনের আগে ‘প্রাভদা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিল।
১৯৩৭ সালে গ্ৰেফতারি হলে প্রথমে অনশন শুরু করে বুখারিন। কিন্তু , কমিউনিজম অনশনের ভাষা কবে বুঝেছে? বুখারিন হয়তো ভুলে গিয়েছিল লেনিনের সময়ের সেই ইতিহাস যখন লক্ষ লক্ষ কৃষকের উৎপাদিত শস্য উৎপাদনকারীকেই অভুক্ত রেখে জোর করে বাজেয়াপ্ত করতো ‘Food Army’ । সেই ‘লাল’ শাসনের চোখে বুখারিনের অনশন কতটা গুরুত্ব আশা করতে পারে? বুখারিন ‘Pravda’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক থাকাকালীন ১৯২০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ‘Pravda’ তে লেখা হয় – “The best place for strikers, those noxious yellow parasites , is the concentration camp !”। বুখারিনের মতবাদ , তার নিজের ক্ষেত্রে অসহনীয় হয়ে গেল।
২ মার্চ , ১৯৩৮ এ বুখারিনের ট্রায়াল শুরু হয়।
‘ABC of communism’ এর লেখক ‘D’ for ‘Death’ এর আশঙ্কায় ১৪০০ পাতা ও ২০০ কবিতার ‘How it all Began’ তার শেষ লেখা হয়।
বুখারিন, লেনিনের কুখ্যাত ‘War communism’ এর সমর্থক ছিল।১৯২১ সালে ‘New economic policy’ র পক্ষে বললেও অনেক দেরি হয়েছে।
১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রধান ছিল বুখারিন।
একময় স্তালিনের ‘Socialism in one country’ মতবাদের সমর্থক আর ব্যাখাকর্তা বুখারিনের শেষ চিঠিতে কাতর জিজ্ঞাসা “Koba, why do you need me to die?” , ‘Koba’ — স্তালিনের ছদ্মনাম।
তার প্রতি স্তালিনের এই আচরণ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না বুখারিন — My heart boils over when I think that you might believe that I am guilty of these crimes … Standing on the edge of a precipice, from which there is no return, I tell you on my word of honour, as I await my death, that I am innocent of those crimes to which I admitted.‌’ ।
স্তালিনের কাছে মৃত্যুর উপকরণ হিসেবে বুলেটের পরিবর্তে বিষ চেয়েছিল বুখারিন — কিন্তু সে ইচ্ছাও যে পূরণ হয় নি তা বলাই বাহুল্য।
বিচারের অভিনয়ের পরিচালক এ্যান্ড্রে ভিসিন্সকি বিচারের শেষে বুখারিনকে তিরস্কার করে বলে ‘hybrid: half fox, half pig’। অন্যান্য ‘Show Trial ‘ এর মতো সোভিয়েত রাশিয়ার দীর্ঘ সময়ের মার্ক্সবাদের পথপ্রদর্শককে শুনতে হয় ”Death to the enemies ‘ , ‘Death to the parasites’ ।
বুখারিনের পরিবারকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও, তার তিন স্ত্রীকেই গুলাগ শ্রমিক শিবিরে পাঠায় স্তালিন। তৃতীয় স্ত্রী আনা ল্যারিনাকে বিপদের সম্পর্কে সাবধান করে বুখারিন লিখেছিল ‘A great ordeal awaits you. I beg you, my dearest, muster all your strength, tighten all the strings of your heart, but don’t allow them to break.’ । সেই চিঠি আনা ১৯৯২ সালে হাতে পেয়েছিলেন। আনা তার স্বামীর হত্যার খবর গুলাগের ক্যাম্পে বন্দী থাকার সময় পাশের সেলের অন্য বন্দীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। ১৯৯৩ সালে বুখারিন আর তার জীবন নিয়ে লিখেছিলেন ‘This I can not forget ‘। সোভিয়েতের পতনের চারবছর পর শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন আনা ল্যারিনা।
কমিউনিজমের বিভিন্ন তত্ত্বের প্রয়োগের কুফলের পরিণাম কোটি কোটি জীবন। এমনকি যারা সামান্যতম সংশোধন করতে চেয়ে তাদের সহ-কমরেডদের বিরোধিতা করেছে তাদেরও প্রাণ হারাতে হয়েছে।
যে তত্ত্বের মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য একজন নিরপরাধ মানুষকেও প্রাণ দিতে হয় তা কি মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিকৃত ও পাশবিক মতবাদ হিসেবে প্রমাণিত হয় না ? আর যেখানে কমিউনিজমের নামে কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষের প্রাণ গিয়েছে সেখানে কমিউনিজম আর হিউম্যানিজম যে পরস্পরের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতেই পারে না।
রাজনৈতিক বিরোধীদের এই হত্যাকাণ্ড অর্থাৎ ‘পার্জ’ শুধুমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছড়িয়ে থাকলো না, পার্জ ছড়িয়ে পড়ল সাধারণ মানুষের মধ্যেও। প্রতিবেশী, প্রতিবেশীকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলো , স্তালিনের গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এমনভাবে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল যে কলেজের ক্যান্টিনে, পাড়ার মোড়ের গল্পে বা নিজেদের পারিবারিক অনুষ্ঠানেও স্তালিনের ক্রিয়াকলাপের বিরোধিতা, কখন যে গুলাগ ক্যাম্পের শ্রমশিবিরে নিয়ে চলে যাবে টের পাওয়া যাবে না। বিপ্লব বিরোধী গতিবিধি, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, দেশের অগ্ৰগতির পক্ষে বিপজ্জনক সন্দেহে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ডাক্তার , অধ্যাপক , বিজ্ঞানী , ইঞ্জিনিয়ারদের হয় মৃত্যু নয়তো গুলাগের শ্রমশিবিরের দাসত্ব ভবিতব্য ছিল। বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনো সম্পর্কের মূল্য , জীবনের মূল্য তুচ্ছ ছিল। ‘সর্বহারাদের একনায়ক’ স্তালিন সমাজতন্ত্রের যে রোডম্যাপ তৈরি করেছিল তার জন্য যে কারো ‘সর্বহারা’ , এমনকি ‘জীবনহারা’ হয়ে যাওয়া ছিল সামান্য ঘটনা।
সিলোরভ নামের এক ব্যক্তির অপরাধ ছিল সোভিয়েত শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্বষপূর্ণ ব্যবহার। সে শুধু বলেছিল স্তালিন প্রচুর মানুষ কে মেরে ফেললেও সে নিয়ে কথা বলা যায় না আর বললে ২৫ বছর শ্রমশিবিরে কাটাতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশে যারা স্তালিনের ছবিকে সামনে রেখে বাকস্বাধীনতার কথা বলে, তাদের কপটতা লক্ষ লক্ষ সিলোরভ নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছে।
৮ বর্গমিটারের কাঠের বাড়ি, ১ টা গরু, ৪ টি ভেড়া ও ২টি শুকর ছিল সিলোরভের সম্পত্তি। এইরকম ‘বিত্তশালী’ মানুষ সোভিয়েত রাশিয়ার বিপদ হয়ে গিয়েছিল ! বিচার হল — সিলোরভকে গুলি করে হত্যা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
নিকোলাই ইয়েজহভ — স্তালিনের ডানহাত বলা চলে। কিন্তু এই ‘ডানহাত’ ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই দুই বছরে স্তালিনের নির্দেশে গণহারে গ্রেফতার, অত্যাচার ও হত্যা করে ইয়েজহভ।১৯৩৭ থেকে ইয়েজহভ এর নেতৃত্বে দৈনিক গড়ে ১০০০ মানুষ কে গুলি করে মারা হয়।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সোৎসাহে সোভিয়েত বিরোধী কাজের জন্য সাধারণ মানুষকে অভিযুক্ত করতো কারণ তাদেরকে নির্দিষ্ট সংখ্যক অভিযুক্ত পাঠানোর ‘কোটা’ পূরণ করতে হতো আর সেই লক্ষ্য পূরণ না হলে তাদের পুরনো সহকর্মীদের মতো তাদেরও ‘পার্জ’ বা শুদ্ধীকরণের নামে শ্রমশিবিরে যাওয়ার পথ খুলে যেতে পারে ! তাই সোভিয়েত সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে অভিযুক্তদের সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ তারা নিজেরাই করতো আর পলিটব্যুরো সেই অনুরোধ পূরণ করতেও দেরি করতো না।
এই সমস্ত পার্টির নেতাদের ‘মস্কো ট্রায়াল’ , ‘পার্জ’ এর মাধ্যমে সন্দেহভাজন রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মীদের শ্রমশিবিরে পাঠানো ও হত্যার কান্ডারী স্বয়ং স্তালিন। নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য ইয়াগোদার থেকে ইয়েজহভ যে উপযুক্ত লোক তা ‘সোচি’ থেকে পলিটব্যুরোকে লেখা একটি চিঠি থেকে স্পষ্ট হয় (২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬) —- ‘It is absolutely necessary and extremely urgent that Comrade Ezhov be nominated to the post of People’s Commissar of Internal Affairs. Yagoda is plainly not up to the task of unmasking the Trotskyite and Zinovievite coalition. The GPU is now four years behind in this business.’ ।
বিদেশমন্ত্রক , শিল্পমন্ত্রকের পুরনো মন্ত্রীদের প্রায় সবাইকে শুদ্ধীকরণের ( পার্জ) বলি হতে হয়। ভারী শিল্প, পরিবহণ মন্ত্রক, প্রযুক্তি ক্ষেত্রের প্রায় সব বড় কর্মকর্তাকেই গুপ্তচরবৃত্তি, সোভিয়েতের লক্ষ্যপূরণের পথে ইচ্ছাকৃত অন্তর্ঘাতের অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের বদলে সমস্ত জায়গায় নতুন পদাধিকারী আনা হয় যারা স্তালিনের যে কোনো লক্ষ্যপূর্তির জন্য নির্দ্বিধায় কাজ করবে।
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নেতারা অর্থাৎ জার্মানি , ইতালি, হাঙ্গেরি , পোল্যান্ড , যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট নেতারাও পার্জের সন্ত্রাসের সম্মুখীন হয়। পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির ১২ জন সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।১৯৪০ ফেব্রুয়ারিতে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির ৫৭০ জন নেতাকে জার্মান-সোভিয়েত চুক্তির ফলে গেস্টাপোর হাতে তুলে দেওয়া হয়। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের রাশিয়ান সদস্যদের রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রতি অসতর্ক হওয়ার অপরাধে বেশিরভাগই শাস্তি পায়।সমস্ত কিছুই হয় স্তালিনের অঙ্গুলি হেলনে ইয়েজহভের নেতৃত্বে। অর্থনীতি, ইতিহাস , স্ট্যাটিসটিক্স, সাহিত্য, ভাষাতত্ত্বের মার্ক্সবাদ বিরোধী সামান্যতম বিচ্যুতির জন্য শিক্ষাবিদদের গ্ৰেফতার ছিল মামুলি ঘটনা।পাল্কোভো মানমন্দিরের ২৯ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে ২৭ জনকেই গ্ৰেফতার করা হয়। লেখকদের সংগঠনের প্রায় ২০০০ জনকে শ্রমশিবিরে পাঠানো হয় নয়তো হত্যা করা হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার শিল্পবিরুদ্ধ বলে থিয়েটারের নির্দেশকদর হত্যা করা হয়। চার্চের হাজার হাজার বিশপকে গুলাগের ক্যাম্পে পাঠানো হয় বা হত্যা করা হয়।এই হত্যালীলার উদ্দেশ্য একটাই — সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা । আর এই ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে সমাজকে যদি নরকেও পরিণত করতে হয় তাহলেও কোনো সমস্যা নেই , এখানে মানবাধিকারের সামান্যতম মূল্য নেই —– একেই কি ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বলে ? স্তালিনের নির্দেশে ইয়েজহভের এই হত্যাকাণ্ড সোভিয়েত রাশিয়ায় ‘Ezhovshchina’ নামে পরিচিত।
তারপর ১৯৪০ সালে সোভিয়েত বিরোধী কাজের অপরাধে ইয়েজহভকেও প্রাণ হারাতে হয়।
ইয়েজহভ কোনো দুর্ভাগ্যের শিকার হয় নি ।পতঙ্গ যেমন আগুনের দিকে ধাবিত হয়ে নিজের প্রাণ হারায় , স্তালিনের সুনজরে থেকে অসীম ক্ষমতাভোগের আশায় তার পূর্বসূরিদের পরিণতি ভুলে যাওয়া NKVD প্রধানদের বৈশিষ্ট্য হয়ে গিয়েছিল । ইয়েজহভ এর পূর্বে জেনরিখ ইয়াগোদা ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত স্তালিনের কসাইখানা NKVD এর প্রধান ছিল।পদ থেকে অপসারণের পরে তাকে গ্ৰেফত্যার ও পরে হত্যা করা হয়, অপরাধ হিসেবে বলা হয় ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ ,
স্তালিনের সহযোগী কেমনেভ ও জিনোভিভের গ্ৰেফতার ও বিচারে মুখ্য ভূমিকায় ছিল ইয়াগোদা।
শ্বেত সাগর থেকে বাল্টিক সমুদ্র পর্যন্ত খাল খননের কাজ পরিচালনার সময় গুলাগের ১২০০০ – ২৫০০০ বন্দীর মৃত্যু হয়। বলসই থিয়েটারে ব্যালে নৃত্য দেখে ক্রেমলিনে ফিরে মৃত্যুর পরোয়ানায় সই — এই ছিল স্তালিনের দৈনন্দিন জীবন। ১৯৩৭ আর ৩৮ সালে ১৫ লক্ষ ৭৫ হাজার মানুষকে গ্ৰেফতার করা হয় ; তার মধ্যে ৬ লক্ষ ৮১ হাজার ৬৯২ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও অন্যান্যদের শ্রমশিবির বা অন্যান্য শাস্তি দেওয়া হয়।
ল্যাভরেন্টি পাভলোভিচ বেরিয়া — ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত NKVD অর্থাৎ ‘পিপলস্ কমিসার ফর ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘ এর প্রধান ছিল।
১৯৩৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া পোল্যান্ড দখল করলে ২২০০০ পোলিশ সৈন্যের গণহত্যা করে বেরিয়া।১৯৪০ সালে রোমানিয়া দখল করার পর বাল্টিক রাজ্য, রোমানিয়া থেকে হাজারে হাজারে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধকালীন উৎপাদনের জন্য গুলাগের শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। প্রায় ১৯ লক্ষ ককাসিয়ান সংখ্যালঘু মানুষ কে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয় , যা গণহত্যার থেকে কম কিছু নয় — নেতৃত্বে বেরিয়া।গুলাগের পাশবিক শ্রমশিবিরে বিশেষভাবে বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্বে ছিল বেরিয়া । ১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর পর বেরিয়া ‘মিনিস্ট্রি অফ ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স’ এর প্রধান হয়। কিন্তু NKVD এর প্রধানদের নিয়তি খন্ডাবে কে ? ১৯৫৩ এর ডিসেম্বরে সোভিয়েত প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভের নির্দেশে বেরিয়াকে হত্যা করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, NKVD এর সদরদপ্তর লুবিয়াঙ্কা জারের আমলে রাশিয়ার জীবন বীমা সংস্থার সদরদপ্তর ছিল। রাশিয়ার মানুষের সঙ্গে বিধাতার কি নিষ্ঠুর পরিহাস! যে ভবন জীবনের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল সেখানে শুধু রাশিয়ার নয়, বিশ্বের সবথেকে বেশি সংখ্যক গণহত্যা ও মানবাধিকার দলনের ইতিহাস রচিত হয়েছে, তাও আবার সাম্যবাদের মুখোশের আড়ালে !

তথ্যসূত্র :

১)The Black Book of Communism — Harvard University Press (1999)

২) ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত ডকুমেন্টারি

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.