রাধাকৃষ্ণাণ , উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথ

উপনিষদ বিশ্বের প্রাচীনতম এবং গভীরতম দার্শনিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি। এটি ভারতীয় দর্শনের মর্মবাণীকে তুলে ধরে এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করে। উপনিষদের শিক্ষাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে এবং এর গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, এবং ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি, যার জীবন ও কর্মের মাধ্যমে উপনিষদের শিক্ষা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
রাধাকৃষ্ণণ ১৮৮৮ সালে তামিলনাড়ুর একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে দর্শনশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। যদিও তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পাশ্চাত্য দর্শনে কেন্দ্রীভূত ছিল, তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন উপনিষদের শিক্ষায়। রাধাকৃষ্ণণ বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয় দার্শনিক গ্রন্থগুলিতে জ্ঞানের এমন গভীরতা রয়েছে যা সমগ্র মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উপনিষদকে শুধু একটি ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে দেখেননি, বরং একে একটি সর্বজনীন এবং মানবিক আধ্যাত্মিক দর্শন হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।
রাধাকৃষ্ণণ উপনিষদের মূল দর্শন এবং তার গুরুত্বকে শুধু ভারতীয়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছেও তা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি উপনিষদের শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তিনি তার লেখায় এবং বক্তৃতায় উপনিষদের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন, যা দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের একটি সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

রাধাকৃষ্ণণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপনিষদের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি উপনিষদের মূল শিক্ষা, যেমন আত্মার ধারণা (আত্মন) এবং সর্বশক্তিমানের ধারণা (ব্রহ্ম), দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং দেখিয়েছেন কিভাবে এই শিক্ষা সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রাসঙ্গিক।

রাধাকৃষ্ণণ ১৯৩৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পাল্ডিং প্রফেসর অব ইস্টার্ন রিলিজিয়নস অ্যান্ড এথিক্স পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এখানে তিনি উপনিষদ এবং ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বক্তৃতা দেন। এই সময়ে তিনি উপনিষদের শিক্ষা সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষাবিদদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রচার করেন।
রাধাকৃষ্ণণ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপনিষদ এবং ভারতীয় দর্শন নিয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। তিনি উপনিষদের গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক দিকগুলো সম্পর্কে আলোচনা করে মার্কিন শিক্ষাবিদ ও ছাত্রদের মধ্যে ভারতীয় দর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
রাধাকৃষ্ণণ ১৯৪৮ সালে ইউনেস্কোতে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। এখানে তিনি উপনিষদ এবং ভারতীয় দর্শনের সার্বজনীনতার ওপর জোর দেন এবং বিশ্বশান্তি ও সমঝোতার জন্য এর প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন।
রাধাকৃষ্ণণ উপনিষদ এবং ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে প্যারিস ও জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে বক্তব্য রাখেন। তিনি এখানে উপনিষদের শিক্ষা ও মানবতার সার্বিক উন্নয়নের জন্য তার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
রাধাকৃষ্ণণের বিশেষত্ব ছিল তাঁর গভীর দার্শনিক দৃষ্টি এবং বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা। তিনি উপনিষদের জটিল এবং গভীর বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যা সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য এবং বোধ্য হয়ে উঠেছিল। তাঁর মতে, উপনিষদের মূল শিক্ষা হলো মনুষ্যত্বের উন্নতি এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি। রাধাকৃষ্ণণ বিশ্বাস করতেন যে উপনিষদের শিক্ষায় মানবজাতির জন্য চিরন্তন সত্য এবং নৈতিকতার মূল শিক্ষা রয়েছে, যা সর্বজনীন এবং প্রাসঙ্গিক।
রাধাকৃষ্ণণ তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে, বিশেষত “ইন্ডিয়ান ফিলসফি” এবং “দ্য প্রিন্সিপাল উপনিষদস” গ্রন্থে, উপনিষদের শিক্ষাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং এগুলোর গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন। তাঁর এই রচনাগুলো উপনিষদের জ্ঞানের আলোকে একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা পশ্চিমা বিশ্বের দার্শনিকদের মধ্যেও বিশেষভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
রাধাকৃষ্ণণের জীবন ও কাজ উপনিষদের শিক্ষাকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি উপনিষদের গভীর দার্শনিক জ্ঞানকে সার্বজনীন করে তুলেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে এটি কেবল ভারতীয়দের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য মূল্যবান। তাঁর প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, উপনিষদ আজও বিশ্বব্যাপী অধ্যয়ন এবং প্রশংসার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রাধাকৃষ্ণণ উপনিষদ সম্পর্কে ইউরোপীয় শিক্ষাবিদদের মধ্যে প্রচলিত ভ্রান্তি দূর করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় শিক্ষাবিদরা উপনিষদকে প্রায়শই একটি ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে বিচার করতেন, যেখানে তারা প্রাচ্যতত্ত্বের (Orientalism) দৃষ্টিকোণ থেকে উপনিষদের জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন করতেন। তারা উপনিষদের গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে প্রায়শই অতিপ্রাকৃত বা অবৈজ্ঞানিক বলে মনে করতেন।

রাধাকৃষ্ণণ এই ভুল ধারণাগুলোকে সংশোধন করতে উদ্যোগী হন। তিনি তাঁর গ্রন্থ এবং বক্তৃতার মাধ্যমে উপনিষদের গভীর দার্শনিক দিকগুলোকে ইউরোপীয় শিক্ষাবিদদের সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি যুক্তি দেন যে উপনিষদের শিক্ষা কেবল আধ্যাত্মিক নয়, বরং এটি মনোবিজ্ঞান, নৈতিকতা, এবং জীবনের সার্বিক দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করে।

রাধাকৃষ্ণণ দেখান যে উপনিষদে বর্ণিত আত্মা ও সর্বশক্তিমানের সম্পর্ক একেবারেই যুক্তিসম্মত এবং তা মানুষের জীবনের গভীরতম প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সক্ষম। তাঁর এই প্রচেষ্টা ইউরোপীয় শিক্ষাবিদদের উপনিষদ সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা সংশোধন করতে সহায়ক হয় এবং উপনিষদের গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায়।

রাধাকৃষ্ণণ উপনিষদকে কেবল একটি ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে নয়, বরং মানবতার সার্বিক কল্যাণের জন্য একটি দর্শন হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, উপনিষদ সর্বধর্মসমন্বয়ের একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করতে পারে এবং বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাঁর গ্রন্থ “The Principal Upanishads” এ তিনি উপনিষদের এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এর প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন।
রাধাকৃষ্ণণ বিশ্বাস করতেন যে উপনিষদের মূল শিক্ষা হলো একত্বের ধারণা, যা “আত্মা” (আত্মন) এবং “ব্রহ্ম” (সর্বশক্তিমান) এর মধ্যে সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। তাঁর মতে, এই শিক্ষা কেবল একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রাসঙ্গিক। উপনিষদে বলা হয়েছে, “सर्वं खल्विदं ब्रह्म” (সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম) অর্থাৎ, “এই সমস্তই ব্রহ্ম”। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে সমগ্র সৃষ্টিই এক এবং অভিন্ন। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানবজাতির মধ্যে বিভাজনের পরিবর্তে একত্ব ও ঐক্যের বোধ জাগ্রত করতে সহায়ক হতে পারে।
রাধাকৃষ্ণণ উপনিষদের এই একত্বের দৃষ্টিভঙ্গিকে সর্বোপাসনা সমন্বয়ের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, উপনিষদের এই শিক্ষা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সাধারণ মূল্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে সহায়ক হতে পারে। উপনিষদে উল্লেখ করা হয়েছে যে “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি” (একই সত্যকে জ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন)। এটি বিভিন্ন উপাসনার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে। রাধাকৃষ্ণণ তাঁর ‘Hindu view of life’ বইতে বলেছেন —“That the Hindu solution of the problem of the conflict of religions is likely to be accepted in the future seems to me to be fairly certain.”। এখানে ‘Hindu Solution’ বলতে হিন্দু জীবন পদ্ধতির দিকেই নির্দেশ করেছেন যার দার্শনিক ভিত্তি ‘উপনিষদ’।
রাধাকৃষ্ণণ মনে করতেন, যদি বিভিন্ন উপাসনার মানুষ উপনিষদের এই সার্বজনীন সত্যকে গ্রহণ করেন, তবে তা ধর্মীয় সংঘাত ও বিভেদের অবসান ঘটাতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে উপনিষদের এই শিক্ষা উপাসনা পদ্ধতির পারস্পরিক সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সর্ব উপাসনা সমন্বয়ের জন্য একটি আদর্শ ভিত্তি প্রদান করতে পারে। তিনি নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছিলেন যে বিশ্বের সমস্ত পরবর্তী দার্শনিক মতগুলি নিজেদের উপনিষদের বলিষ্ঠ যুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সচেষ্ট হয়েছিল —- “*Later Systems of philosophy display an almost pathetic anxiety to accommodate their doctrines to the views of the Upanishads, even if they can not father them all on them.Every revival of idealism in India has traced its ancestry to the teaching of the Upanishads.”।
রাধাকৃষ্ণণ উপনিষদের শিক্ষা দ্বারা বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধানেরও পথ দেখতে পেয়েছিলেন। আজকের বিশ্বে জাতীয়তা, বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি সমস্যাগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। রাধাকৃষ্ণণের মতে, উপনিষদের শিক্ষা এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সহায়ক হতে পারে।

রাধাকৃষ্ণণ বিশ্বাস করতেন যে উপনিষদের শিক্ষা বৈশ্বিক সংঘাতের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করতে পারে। অহিংসা এবং সহনশীলতা বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল চাবিকাঠি হতে পারে। উপনিষদের এই শিক্ষা বিশ্বজুড়ে সংঘাতের পরিবর্তে শান্তি ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।

উপরন্তু, উপনিষদে যে ব্রহ্ম ও আত্মার সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে, তা মানুষের মধ্যে সাম্য ও ন্যায়বিচারের বোধ জাগ্রত করতে সহায়ক হতে পারে। রাধাকৃষ্ণণ মনে করতেন যে যদি মানুষ উপনিষদের এই শিক্ষা অনুসরণ করে, তবে অর্থনৈতিক বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য এবং জাতিগত সংঘাতের অবসান ঘটতে পারে। উপনিষদ মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার বোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম, যা বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
“The Philosophy of Upanishads” গ্রন্থে তিনি এই বিষয়গুলোকে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ।
রাধাকৃষ্ণণের মতে, ভারতবর্ষের পুনরুজ্জীবনেও উপনিষদের শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে উপনিষদে অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলি জাতির মানসিক ও নৈতিক পুনর্গঠনে সহায়ক হতে পারে। উপনিষদের শিক্ষাগুলি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে সাম্য, ন্যায়, এবং নৈতিকতার বোধ জাগ্রত করতে পারে।রাধাকৃষ্ণণ মনে করতেন যে উপনিষদের শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ আত্ম-উপলব্ধি ও আধ্যাত্মিকতায় উন্নীত হতে পারে, যা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে সহায়ক হবে। তিনি উপনিষদের অহিংসা, সত্য এবং ধৈর্যের শিক্ষাকে জাতীয় চরিত্র গঠনের জন্য অপরিহার্য মনে করতেন। উপনিষদের এই সার্বজনীন মূল্যবোধগুলি নতুন প্রজন্মের মধ্যে জাতীয়তাবোধ, নৈতিকতা, এবং আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে, যা ভারতবর্ষের পুনরুজ্জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৬ বার ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন আর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ১১ বার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য ডঃ রাধাকৃষ্ণণের সাহিত্য ‘প্রস্থানাত্রয়ী’ অর্থাৎ ‘ভগবদ্গীতা’ , ‘ব্রহ্মসূত্র’ ও ‘উপনিষদ’-এর অনুবাদ,ব্যাখা ও বর্তমান বিশ্বে তাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই ছিল অর্থাৎ ভারতীয় শাস্ত্রের সাহিত্যিক গুণকেও বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি দানে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য‌। অন্য আর এক নোবেলজয়ী সাহিত্যিক উপনিষদের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে একমত। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।’The Philosophy of Upanishads’ এর প্রস্তাবনায় কবিগুরু লিখছেন “I feel strongly that this, for us, is the teaching of the Upanişads, and that this teaching is very much needed in the present age for those who boast of the freedom enjoyed by their nations, using that freedom for building up a dark world of spiritual blindness, where the passions of greed and hatred are allowed to roam unchecked, having for their allies deceitful diplomacy and a wide-spread propaganda of falsehood, where the soul remains caged and the self battens upon the decaying flesh of its victims.”
আবার ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ ১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন নিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ‘The Philosophy of Rabindranath Tagore ‘ বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং দেখিয়েছেন বিশ্বকবির কবিতায়, প্রবন্ধে , তাঁর কবিত্বের সর্বত্র উপনিষদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কবিগুরু ভারতবর্ষের প্রাচীন আদর্শকেই আধুনিক যুগে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন আর রাধাকৃষ্ণাণ বিশ্বের সামনে তা দেখালেন(His writings are a commentary on the U panishads by an individual of this generation on whom the present age has had its influence.— The Philosophy of Rabindranath Tagore) । ১৯১৩ সালে কবিগুরু ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্ৰন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।ডঃ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ যেনো রবীন্দ্রনাথকে আর রবি ঠাকুরের মাধ্যমে ভারতীয় দর্শনকে বোঝানোর ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন আর তাতে বিশ্বকবির পূর্ণ সমর্থন ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠার মধ্যেও যে উপনিষদীয় যুগের শিক্ষাব্যবস্থা ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের যুগানুকূল প্রয়োগ ছিল তার যুক্তি পেশ করেছেন রাধাকৃষ্ণাণ। রবীন্দ্রনাথের কথাতেও তাঁর স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় — “জীবনের কোনো লক্ষ্য নাই অথচ শিক্ষা আছে, ইহার কোনো অর্থই নাই। আমাদের ভারতভূমি তপোভূমি হইবে, সাধকের সাধনক্ষেত্র হইবে, সাধুর কর্মস্থান হইবে, এইখানেই ত্যাগীর সর্বোচ্চ আত্মোৎসর্গের হোমাগ্নি জ্বলিবে, এই গৌরবের আশাকে যদি মনে রাখি তবে পথ আপনি প্রস্তুত হইবে এবং অকৃত্রিম শিক্ষাবিধি আপনি আপনাকে অঙ্কুরিত পল্লবিত ও ফলবান করিয়া তুলিবে।”
( লক্ষ্য ও শিক্ষা)*
The Philosophy of Rabindranath Tagore এ রাধাকৃষ্ণণ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি বোঝাতে বলছেন “Rabindranath feels that there is a great difference between the spiritual ideal for which India stands, and the material ideal with which it is in conflict. Through the acceptance of the civilisation of the East, which is religious and not secular, it is easy for us to enter the kingdom o God. Though not exclusively, still mainly, the emphasis in the East is on life and not possession, intuition and not intellect, religionand_not science, freedomand not direction. It is because India represents this ideal that Rabindranath is proud to be a son of India. ” I shall be born in India again and again with all her poverty, misery, and wretchedness I love India best.”। পার্থিব সুখের অভাব যে কোনোদিনই সামাজিক সংগ্ৰাম তথা অবক্ষয়ের উৎস নয় বরং আধ্যাত্মিকতার অভাবই যে সমস্যার মূল রাধাকৃষ্ণাণ বলেছেন A materialist view of life is the root cause. of social discontent, and the remedy for the social unrest is a spiritual one. ” এবং রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন — “He brings his spiritual vision to bear on the social problems, and lifts them up to a higher idealist plane. His attitude to them is determined, not by the accident of birth, habit, or training, but by the spiritual vision, the one central principle to which he devotes his whole life. The present social unrest would be at an end if people adopted the right attitude to life, and developed reverence for the divine in man. The materialist view of life makes us afraid of poverty, and in nations of spiritual vision, poverty is not the cause of social discontent India is very poor, but centuries of spiritual discipline have given the Indian peoples so much restraint and self-suppression that though the problem of poverty is most intense in India, social unrest and struggle are greater in the West.”। হিন্দু ধর্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আশা ছিল যে সমস্ত কুসংস্কার , পাশ্চাত্য সভ্যতার আক্রমণকে প্রতিহত করে আবার স্বমহিমায় ভারতের পুনরুজ্জীবনে সহায়ক হবে –It is Rabindranath’s sincere conviction that the Hindu religion can stand against the onslaught o Western civilisation, religion, and culture, on condition that it rids itself of its dogmatism and superstition. “।
উপনিষদের যুগের দুই ঋষি যেন আধুনিক ভারতের জন্য তাঁদের প্রাচীন বাণী নতুনভাবে এনেছেন আমাদের সামনে।

প্রত্যেক ‘শিক্ষক দিবস’ সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণাণকে সামনে রেখে প্রাচীন ভারতবর্ষের অমৃত বাণী ‘উপনিষদ’কে আমাদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ আনে আর এই সুযোগ শুধু ভারতবর্ষের পুনরুজ্জীবন নয় বরং বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানের পথ পেতে সহায়ক হয় ।

তথ্যসূত্র :
১) The Philosophy of Rabindranath Tagore by Dr Sarvepalli Radhakrishnan
২) The Hindu View of Life by Dr Sarvepalli Radhakrishnan
৩) East & West — Some Reflections by Dr Sarvepalli Radhakrishnan

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.