… সৌদামিনী, সুকুমারী, শরৎকুমারী, স্বর্ণকুমারী ও বর্ণকুমারী — রবীন্দ্রনাথ-এর এই পাঁচ দিদি। ব্যস্তসমস্ত বিখ্যাত ভাইটি কোনো না কোনো দিদির হাত থেকে ফোঁটা নিতে পেরেছিলেন বিভিন্ন সময়।
… কবির যখন চুয়াত্তর বছর বয়স, একমাত্র জীবিত দিদি বর্ণকুমারী ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে দিলেন! দুই বছর ধরে তাঁর ভাতা বন্ধ কেন— প্রাপ্য আদায়ের জন্য এই মামলা রুজু হল ১৯৩৫-এর মার্চ মাসে। কলকাতা হাইকোর্টে মিস্টার প্যাংক্রিজের এজলাসে বর্ণকুমারীর আবেদন ছিল: ‘তিনি দেবেন্দ্রনাথের একমাত্র জীবিত কন্যা ও দুঃস্থা… এবং উইল অনুসারে ভাতা পাইবার যোগ্যা।’ সে বছরে ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় এই বিষয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তার শিরোনাম ছিল: ‘হাইকোর্টে রিসিভারকে সম্পত্তির দখল ছাড়িয়া দিতে নির্দেশ/ বর্ণকুমারী দেবীর খোরপোষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত।’ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে আদালতে এই মামলাটি লড়েছিলেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা এন সি চট্টোপাধ্যায়। এখানেই নিষ্পত্তি হয়নি এই মামলার। নভেম্বরে বর্ণকুমারী আবার একটি আবেদন করেন। আনন্দবাজারে এই বিষয়ে ২৭ নভেম্বর একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়ে যাওয়া মামলা সম্পর্কে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল সহজেই অনুমেয়।
পরে অমিতা ঠাকুর লিখেছিলেন:–
“বর্ণকুমারী দেবী অন্যান্যদের প্ররোচনায় ভাই-এর নামে নালিশ করেছিলেন সত্য কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ বয়সে মতিভ্রম না হলে নিজেই ভাইকে টাকার কথা লিখতে পারতেন। তাহলে এ কেলেঙ্কারী হত না। আর একশ টাকা মাসোহারার জন্য না খেয়ে মারা যাচ্ছিলেন না…।’
… পাঁচ বছর পরের কথা। ১৯৩৯ সাল। ভাইবোনেদের মধ্যে তখন বেঁচে রয়েছেন দুজন—রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর তিন-সাড়ে তিন বছরের বড় এই ছোড়দিদি বর্ণকুমারী। পুরনো বিবাদ মিটে গেছে। বৃদ্ধ, অশক্ত শরীরে ভাইয়ের কাছে যেতে পারেননি রবি ঠাকুরের ছোটোদিদি। তবে স্নেহাশীষ নিয়ে চিঠির শব্দরা আসে এইরকম —
ভাইটি আমার, শুনলুম তুমি জোড়াসাঁকোয় এসেছ, সেইখানে গিয়ে ভাইফোঁটা দেবো ভেবেছিলুম কিন্তু হলো না, ধিরেন নামে একজন চেনা লোক পেলুম তাকে দিয়ে সব আনিয়ে পাঠালুম কবির যা প্রিয় জিনিস তাই দিলুম আমি বড় তোমায় কিছু পাঠাতে হবে না। আশা করি তুমি ভাল আছ। ধানদূর্বা ফুল দিয়া আশীর্বাদ করিলাম কিন্তু দেখা হল না এই দুঃখ।
--- ইতি
ছোড়দি।
চিঠির উত্তরের শব্দগুলি যেন নতজানু এক ভাইয়ের প্রণাম। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন উত্তরে—
ভাই ছোড়দি তোমার ভাইফোঁটা পেয়ে খুশি হয়েছি। আমাদের ঘরে ফোঁটা নেবার জন্য ভাই কেবল একটি মাত্র বাকি আর দেবার জন্য আছেন এক দিদি। নন্দিনী তোমার প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমার প্রণাম গ্রহণ করো।
ইতি
তোমার রবি
১৪/১১/৩৯
সেই বর্ণকুমারী রবীন্দ্রনাথকে শেষ ভাইফোঁটা তিনিই দিয়েছিলেন।
… ১৯৪০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কালিম্পং থেকে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে। এমনি সময় এসে গেল ভাইফোঁটার পূন্য তিথি। আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন চুরাশি বছরের দিদি। গৌরবরণ একটি শীর্ণ হাতের শীর্ণ আঙুল স্পর্শ করল অসুস্থ পৃথিবীবিখ্যাত ভাইয়ের কপাল। দুজন দুপাশ থেকে ধরে রেখেছিলেন বর্ণকুমারীকে। তারপর ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহাসক্ত দিদি খুব বকলেন। বৃদ্ধ ভাইয়ের অসুস্থতার মূল কারণ নাকি কালিম্পং যাত্রা। নাহলে অসুস্থ হওয়ার কোনো কারণ আছে নাকি? বললেন —
“দেখো রবি তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনও। বুঝলে?”
রবি ঠাকুর এই বকুনি শুনে কৌতূকে পরিপূর্ণ এক গাম্ভীর্য নিয়ে বলেছিলেন —
“না আর কখনও ছুটে ছুটে যাব না, বসে বসে যাব এবার থেকে।”
তারপর শুরু হল ভাইবোনের কথালাপ। রোগশয্যায় এল উৎসবের আমেজ। তারপর প্রণাম পর্ব। দিদিকেই পা তুলে দিতে হবে। নাহলে অশক্ত ভাই প্রণাম করবেন কেমন করে? দিদি বললেন, ‘থাক, এমনিতেই হবে, তোমাকে আর পেন্নাম করতে হবে না কষ্ট করে।’ এরপর আদরে, আশীর্বাদে ভাইকে ভরিয়ে দিয়ে দুজনের হাতে ভর দিয়ে বেরিয়ে গেলেন বর্ণকুমারী। আর কোনোদিন তাঁর ভাইফোঁটা দেওয়া হবে না …