দু’বছরের ওপর নবান্ন-র চিঠির প্রতীক্ষায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বজনরা
অশোক সেনগুপ্ত
এসে গেল আরও একটা স্বাধীনতা দিবস। দু’বছরের ওপর নবান্ন-র চিঠির প্রতীক্ষায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বজনরা। এঁরা প্রায় সকলেই বরিষ্ঠ নাগরিক। পূর্বপুরুষদের ত্যাগ আর বীরত্বের প্রসঙ্গে আলোচনায় যতটাই দীপ্ত, ততটাই হতাশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ব্যাপারে প্রশাসনিক নির্লিপ্ততায়।
দীর্ঘদিন ধরে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। নতুন জেল তৈরি হয়েছে বারুইপুরে। ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্সি জেলের বন্দীদেরও সেখানে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরের কথা। বেসরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, আলিপুরের মত অভিজাত এলাকায় ওই দুই জেলের বিপুল জমিতে আবাসন তৈরি করতে প্রভাবশালী একাধিক নির্মাণগোষ্ঠী রাজ্যকে আগ্রহ দেখিয়েছে। এই অবস্থায় এই দুই জেলকে ‘জাতীয় স্মারক’ এবং সমগ্র জেল চত্বরকে ‘জাতীয় ঐতিহ্যপূর্ণ এলাকা ঘোষণার আবেদন করে অগ্নিকন্যা সুনীতি চৌধুরীর মেয়ে ডঃ ভারতী সেন ৬ই জুন, ২০১৯ মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। শুক্রবার তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, সেই চিঠির উত্তর পাননি।
এর পর ২০১৯ এর ২২ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন বেশ ক‘জন বিশিষ্ট নাগরিক। প্রথম স্বাক্ষরকারী ছিলেন প্রায় ১০০ বছর বয়সী স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য। গত জুন মাসে তিনি প্রয়াত হন। এ ছাড়াও ছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন, দুই গবেষক অমিয় কুমার সামন্ত ও শিবশঙ্কর ঘোষ, লেখক-অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদার প্রমুখ।
“এই দু’টি জেলে মোট দশজন বিপ্লবীর (কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, চারুচন্দ্র বসু বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত গোপীনাথ সাহা, অনন্তহরি মিত্র, প্রমোদরঞ্জন চৌধুরী, দীনেশ গুপ্ত, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও দীনেশ মজুমদার) ফাঁসি হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষ, বাঘা যতীন, সূর্য সেন, নেতাজি সুভাষ, বিপিন পাল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (এম এন রায়), যতীন দাস, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, প্রতুল গাঙ্গুলী, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, বীণা দাস, কল্পনা দত্ত, সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ, উজ্জ্বলা মজুমদারদের মতন অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী এই দুইটি জেলে দেশের মুক্তির জন্য চরম লাঞ্ছনা ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বস্তুত হাজার হাজার অহিংস সত্যাগ্রহী ও বিপ্লবীদের পাদস্পর্শে ধন্য এই দু’টি জেলকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ‘মুক্তিতীর্থ’ বলে আমরা মনে করি।“
চিঠিতে ওপরের কথাগুলো ছাড়াও তাঁরা লিখেছিলেন, “আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই আবেদনের মাধ্যমে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও জাতীয় ইতিহাস, এবং ঐতিহ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট; বিশেষত বাঙালির আবেগের সাথে যুক্ত একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং এ বিষয়ে আমাদের মনোভাব জানাতে চাই। আমরা বিভিন্ন সংবাদসূত্রে জানতে পেরেছি যে, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল বারুইপুরে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং প্রেসিডেন্সি জেলও অদূর ভবিষ্যতে বারুইপুরে স্থানান্তরিত হবে। আমাদের আবেদন, ভবিষ্যতে এই দু’টি জেলের অন্তর্গত বিপুল পরিমাণ জমিকে ঘিরে সরকার এমনই এক পরিকল্পনা করুন যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঙালি জানতে পারে স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে এই দু’টি জেলের কী অসামান্য ভূমিকা ছিল।
উল্লেখিত দাবিগুলির মধ্যে ছিল ১) সমগ্র জেল চত্বরকে অবিলম্বে ‘জাতীয় ঐতিহ্যপূর্ণ এলাকা’ এবং দু’টি জেলের অন্তর্গত যাবতীর স্থাবর সম্পত্তিকে ‘জাতীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্মারক’ বলে চিহ্ণিত করা, ২) স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে যাঁরা এই দু’টি জেলে ছিলেন, সরকারি রেকর্ড ঘেঁটে তার বিস্তারিত তথ্যপঞ্জী জনসমক্ষে প্রকাশ করা: ৩) জেল দু’টির কোনওরকম কাঠামোগত বিচ্যুতি না ঘটিয়ে প্রতিটি ঘরে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি ও তৎসহ প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে সুসজ্জিত করা, ৪) জেলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যা যা ব্যবস্থা ছিল মডেলের মাধ্যমে তা দেখানোর ব্যবস্থা করা, ৫) লাইট-অ্যান্ড-সাউন্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরা; ৬) স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে একটি উচ্চমানের গবেষণা কেন্দ্র এখানে গড়ে তোলা, ৭) স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের নিয়ে যাবতীয় বইপত্রের একটি লাইব্রেরি তৈরী করা; ৮) স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত যাবতীয় পুলিশ ফাইল, সরকারি নথি ও পুরোনো সংবাদপত্রের একটি ডিজিটাল আরকাইভ এখানে গড়ে তোলা; ৯) স্বাধীনতা সংগ্রাম-সংক্রান্ত যে কোনও অনুষ্ঠান করার উপযোগী একটি অডিটোরিয়াম করা, ১০) সমগ্র জেল চত্বরকে পরিবেশ-বান্ধবকে এলাকা বলে ঘোষণা করে কলকাতায় দূষণের মাত্রা রোধ করার জন্য জেলের সরকারি জমিতে কৃত্রিম বনভূমি গড়ে তোলা প্রভৃতি।
বসন্ত বিশ্বাস শহিদ স্মারক সমিতির সহকারী সম্পাদক তথা সম্পর্কে বসন্ত বিশ্বাসের নাতি তরুণ বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে বলেন, মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা ওই চিঠি আমি স্পিডপোস্ট করেছিলাম। উত্তর আসেনি। এর পর ছিল বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পৌত্রী শ্যামলী মুখার্জী ও বিপ্লবী যাদুগোপাল মুখার্জীর পুত্র ডাঃ সিদ্ধার্থ মুখার্জীর ২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠি। সূত্রের খবর, এটিরও উত্তর আসেনি।
এই অবস্থায় আলিপুর জেলের সংরক্ষণ এবং প্রস্তাবিত সংগ্রহশালা নিয়ে বিপ্লবীদের পরিবারের সদস্যরা এবং বিপ্লব-গবেষকরা রীতিমত অন্ধকারে। রাজ্যের কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে বলেন, “আলিপুর জেলের জমি কারা দফতর মুখ্যমন্ত্রীর দফতরকে হস্তান্তর করেছে। জেলের ফাঁসিকাঠ এবং স্মরণীয় বিপ্লবীরা ছিলেন, এমন কিছু সেল চিহ্ণিত করা হয়েছে। সেগুলো সংরক্ষণ করে সংগ্রহশালা এবং আশপাশের কিছু অংশে সৌন্দর্যায়ন হবে। এত বড় জেলচত্বরে বিভিন্ন অংশের বাড়িগুলো পুরনো ও বিপজ্জনক হয়ে যাওয়ায় এমনিতেই ভেঙে ফেলতে হবে। ওই সব জায়গায় কী হবে বলতে পারছি না।“
কারা দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “অতীতের ঐতিহ্যের দিল্লি সেন্ট্রাল জেলচত্বরে পরবর্তীকালে মৌলনা আজাদ মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়েছে। সেখানে অতীতের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ফাঁসিঘর সংরক্ষণ হয়েছে। ওখানে যাঁদের ফাঁসি হয়েছিল, তাঁদের নাম খোদাই আছে প্রস্তরফলকে। পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতা সংগ্রামী বা তাঁদের পরিবারের অনেকেই সেটা দেখে এসেছেন। আলিপুর জেলচত্বরে কিছু সংরক্ষণের সময় অবশ্যই সংগ্রামীদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নেওয়া হবে।“