স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে রবিবার পাড়ায় পাড়ায়, টিভি-তে বেজেছে দেশাত্মবোধক নানা গান। আমরা অনেকেই জানিনা এই সব গানের কথাকার ও সুরকার কারা। কিছু গানের পিছনে রয়েছে গল্প।
বন্দে মাতরম্ কথাটির অর্থ ‘মা-কে বন্দনা করি’। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৮২ সালে লেখা ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান।সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় লেখা গানটি দেবী ভারত মাতা বন্দনাগীতি এবং বাংলা মা তথা বঙ্গদেশের
একটি জাতীয় মূর্তিকল্প। শ্রীঅরবিন্দ বন্দে মাতরম্
গানটিকে ‘বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত’ বলে উল্লেখ করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই গানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
বন্দে মাতরম্ সঙ্গীতের প্রাচীনতম প্রাপ্ত অডিও রেকর্ডিংটি ১৯০৭ সালের। সমগ্র বিংশ শতাব্দীতে গানটি প্রায় একশোটি ভিন্ন সুরে রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০০২ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি জনপ্রিয় গান নির্বাচনের একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষায় ৭০০০ গানের মধ্যে থেকে এ আর রহমান সুরারোপিত বন্দে মাতরম্ গানটি বিশ্বের দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম গান নির্বাচিত হয়।
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতের জাতীয় স্ত্রোত্র বা সংগীত । এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক তৎসম বাংলা ভাষায় রচিত। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের একটি সভায় এটি প্রথম গীত হয়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত স্বীকৃতি লাভ করে এর প্রথম স্তবকটি।বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বন্দেমাতরম গানটিও সমমর্যাদায় জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি লাভ করে। জনগণমন ভারতের জাতীয় সংগীত বা জাতীয় স্তোত্র বা স্তব রাষ্ট্রগীত (ন্যাশনাল অ্যানথেম) ও ‘বন্দেমাতরম’ ভারতের রাষ্ট্রগান (ন্যাশানাল সং) বিবেচিত হয়।
‘ও আমার দেশের মাটি’ একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। এটি একটি দেশাত্মবোধক গান। এটির রচনাকাল ১৯০৫ থ্রিস্টাব্দে (১৩১২ বঙ্গাব্দ)। গানটির স্বরলিপিকার
ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী। এই গানটি বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনের সমর্থনে লেখা হয়েছিল।
বাংলার মাটি বাংলার জল – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী।
১৯০৫ সালে রচিত। এটি বাংলায় ‘বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলন’ সমর্থন করে লেখা হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদকারী হিন্দু ও মুসলিম বাঙালিদের পুনর্মিলনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালের ১ অক্টোবর ‘রক্ষা বন্ধন উৎসব’ শুরু করেছিলেন এবং সেদিন এই গানটি ছিল আন্দোলনের মূলমন্ত্র।
প্রবাদপ্রতিম বাঙালি কবি, গীতিকার ও চিত্রপরিচালক মোহিনী চৌধুরীর (জন্ম: ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ – মৃত্যু: ২১ যে ১৯৮৭)। গান ‘আজ কাশ্মীর হ’তে কন্যাকুমারী’: সুর ও শিল্পী- কৃষ্ণচন্দ্ৰ দে। আজ থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় আগে প্রখ্যাত কবি ও গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর লেখা এই অবিস্মরণীয় দেশাত্মবোধক গানটি বর্তমান অস্থির ও বিপন্ন সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও যে কত প্রাসঙ্গিক, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। ১৯৪৮ সালে বরেণ্য গায়ক ও সুরস্রষ্টা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সুরারোপে ও কণ্ঠে এই গানটি যে রেকর্ডে প্রকাশিত হয়, তার অপর পিঠেই ছিল মোহিনী চৌধুরী রচিত সেই অমর গান, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, সুর কৃষ্ণচন্দ্র দে-র।
এই দু’টি গানই কালজয়ী।
‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান–
তুমি কি এমন শক্তিমান!’ খাম্বাজ রাগ,
দাদরা তালের এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২১ আশ্বিন, ১৩১২, ইংরেজি ১৯০৫।
রচনাস্থান: গিরিডি। স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী।
জার্মানির মিউনিখে বসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন,
“নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার–
জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার॥
খনে খনে তুই হারায়ে আপনা
সুপ্তি নিশীথ করিস যাপনা–
বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার“
রাগ: ভৈরবী, তাল: কাহারবা, গানটির রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১ আশ্বিন, ১৩৩৩ (১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬)।
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘ওরে আজ ভারতের নব যাত্রাপথে’। – কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গানটির প্রথম প্রকাশ : ১৯৪৯ সালে। শিল্পী ছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ ও তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’— দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটি তাঁর “শাহজাহান” নাটকের অংশ। নাটকের একটি দৃশ্যে দেখা যায়, কারা রুদ্ধ সম্রাট শাহজাহান তাঁর পুরোনো দিনগুলোর স্মৃতি চারণ করছেন। কারাগারের এক টুকরো জানলা দিয়ে তিনি চারপাশের প্রাকৃতিক শোভা দেখে আপনা মনেই গেয়ে উঠলেন এই গান। এতে দেশ মাতৃকার প্রতি অটুট ভালোবাসা ও প্রবল দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে।
‘উঠ গো ভারত লক্ষ্মী, উঠ আদি জগত জন পুজ্যা’ – অতুলপ্রসাদ সেনের একটি অমর সৃষ্টি। গানটি লেখার নেপথ্যকাহিনী বলেছেন, “ভেনিসে এক সন্ধ্যায় গন্ডোলায় করে বেড়াচ্ছিলাম। চারদিকে বাড়ির আলো। আকাশের তারা। জলের ঝিকিমিকি। আর এ ধারে ও ধারে গন্ডোলার ছপ ছপ শব্দ। চুপ করে দেখছি, শুনছি। হঠাৎ একটা গন্ডোলা থেকে সুর ভেসে এল। মনে লাগল বেহালায় বাজানো সুরটা। গন্ডোলা দূরে চলে গেলেও সুরটা মনে বাজতে লাগল। ফিরে এসে লিখে ফেললাম ওই গান, উঠ গো ভারতলক্ষ্মী।” নানা সময় অনেকে পরিবেশন করেছেন গানটি। তার মধ্যে যন্ত্রসঙ্গীতে ভি বালসারা, দত্ত ভার্সেস দত্ত (২০১২) ছায়াছবিতে অঞ্জন দত্ত ও সোমলতা আচার্য চৌধুরীর গান উল্লেখযোগ্য।
‘বল বল সবে শত বীণা বেনু রবে, ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ – অতুলপ্রসাদ সেন।
ছোটদের নিয়ে অন্তরা চৌধুরী, প ঘোষাল, নূপুরছন্দা ঘোষ ছাড়াও গেয়েছেন অনেকে। যন্ত্রসঙ্গীতেও এর আকর্ষণীয় পরিবেশনা রয়েছে।
কারার ঐ লৌহ কপাট – কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভাঙার গান’। ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার, রূপঙ্কর বাগচি, শোভন গাঙ্গুলি প্রমুখ শিল্পী একক বা সমবেতভাবে পরিবেশন করেছেন এই গান।
পৃথা কুন্ডু জানিয়েছেন, “১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। নজরুল কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পর রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘ভাঙার গান’ – ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’ এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতা – ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’। বাংলা সঙ্গীত ও কবিতার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বিপ্লবী গান আর কবিতা“। ১৯২৪-এর শেষদিকে নিষিদ্ধ হয় গানটি।
পৃথা জানিয়েছেন, “বন্দিদশাতেই কবি বেঁধেছিলেন শিকল ভাঙার গান – ‘শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।’ (’প্রহর‘, ২৫ মে, ২০২০)।
ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে – সলিল চৌধুরীর এই গান জনপ্রিয় হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও।
ভারত আমার ভারতবর্ষ— শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা গানটির সুরকার অজয় দাস। শিল্পী- মান্না দে।
হিন্দিতেও রয়েছে অসংখ্য জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান। এ নিয়ে সুন্দর সংকলন করেছেন ‘ওয়ান ইন্ডিয়া’-র শ্রীতমা মিত্র। সেটি এরকম—
‘সন্দেশে আতে হ্যায়’—জেপি দত্তর বর্ডার ছবির গান ‘সন্দেশে আতে হ্যায়’ আজও বহু ভারতীয়কে আবেগপ্রবণ করে। মালিকের এই সুরের গান আজও অন্যতম হিট।
‘মেরে দেশ কি ধরতি’— উপকার’ ছবির গান ‘মেরে দেশ কি ধরতি’। এক কালে এই গানের ধারে কাছে কোনও হিট গান যায়নি। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের আবহে ১৯৬৫ সালের পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছে এই গান।
আই লাভ মাই ইন্ডিয়া— যুব সমাজের দেশের প্রতি ভালোবাসার ঘরানা একটু আলাদা। তবুও আগের প্রজন্মের মতো এঁরাও দেশকে একইভাবে ভালোবাসেন। আর সেই যুব প্রজন্মের ঘরানার ছাঁচে ফেলে ফিল্ম ‘রং দে বসন্তি-‘র টাইটেল ট্র্যাকও বেশ জমজমাটি গান।
ভারত হামকো..’— ‘পরদেশ’ ছবির এই গান একটা সময় বহু রেকর্ড ভেঙেছে। শাহরুখ মহিমা অভিনীত এই ছবির ‘আইন লাভ মাই ইন্ডিয়া’ বলিউডে অন্যতম হিট গান।
‘ভারত হামকো জান সে প্যায়ারা হ্যায়’— হরিহরণের কণ্ঠে এ আর রহমানের সুরে দেশের একাত্মবোধ এক লহমায় ধরা দিয়েছে রোজা ছবির এই গানে। ‘ভারত হামকো জান সে প্যায়ারা হ্যায়’ আজএ প্রতিটি ভারতীয়ের গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য।
‘চক দে ইন্ডিয়া’—সুখবিন্দর সিং এর কণ্ঠে ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবির টাইটেল ট্র্যাকও একটা সময় বেশ জনপ্রিয় হয়।
‘অব তুমাহারে হাওয়ালে…’—হকিকত’ ছবির গান ‘অব তুমাহারে হাওয়ালে…ওয়াতন সাথিও’ দেশবাসীকে আজও আবেগপ্রবণ করে। মহম্মদ রফির কণ্ঠস্বর ও কইফি আজমির লেখা এই গান আজও জনপ্রিয়।
‘হ্যায় প্রীত জাহাঁ কি …’— ‘হ্যায় প্রীত জাহাঁ কি রীত ‘.. জমজমাট ছন্দের এই গান ভারতের প্রতিটি কোণায় একসময় স্বাধীনতা দিবস পালনের অন্যতম অঙ্গ ছিল।
‘অ্যায় ওয়াতন’— মেঘনা গুলজারের ছবি ‘রাজি’র ‘অ্যায় ওয়াতন’ গানটিও বেশ দেশাত্মক ভাবনাকে তুলে ধরে।
’ছল্লা’— দেশপ্রেমের ‘জোশ’ যদি তুঙ্গে রাখার কথাই হয় তাহলে ‘উরি’ ছবির ‘ছল্লা’ গানটির তুলনা হয়না। ভিকি কৌশল অভিনীত এই ছবির গান প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
অশোক সেনগুপ্ত