অশোক সেনগুপ্ত
ক’দিন বাদেই পূর্ণ হবে কাদম্বিনী গাঙ্গুলির দেড়শ বছর। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৪০। বনফুলের ১২২, আশালতা সিংহর ১১০। বাংলা সাহিত্যের আলোড়ণজাগানো ’জাগরি’ পা দেবে আশিতে। প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে ৮০ বছরে পেড়িয়ে গেল ‘পথের পাঁচালি’। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে এঁদের কীর্তি বা এ সব হয়ে আছে এক একটা মাইলস্টোন। এর নেপথ্যে ভাগলপুরের উর্বর বাঙালি সমাজ। আজ তা বিস্মৃতির আড়ালে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ভাগলপুরে। এস্টেট ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে গিয়েছেন। বিভূতিভূষণ উত্তর কলকাতায় খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি, গৃহশিক্ষক ছিলেন। পরে তাঁর এস্টেটের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৮ সালের ২৬ এপ্রিল। বাংলা ১২ বৈশাখ, ১৩৩৫। ‘পথের পাচালি’ শেষ করলেন বিভূতিভূষণ। অপুকে নিশ্চিন্দিপুর থেকে পথে নামিয়ে শেষ লাইনটি লিখলেন, “সে বিচিত্র যাত্রাপথের অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমায় ঘরছাড়া করে এনেছি। চল এগিয়ে যাই। – সমাপ্ত।“ তার নিচে নাম স্বাক্ষর – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তো, সেই দিনই মানে ২৬ এপ্রিল বিভূতিভূষণ পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলেন সেকালের ডাকসাইটে পত্রিকা ‘বিচিত্রা’-তে। দিনলিপিতে লিখেছেন, “আজ আমার সাহিত্যসাধনার একটি সার্থক দিন- এই জন্য যে আমি আমার দুই বৎসরের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ উপন্যাসখানাকে ‘বিচিত্রা’-তে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্ত পত্রপাট খারিজ হয়ে গেল সেটি।“ কীভাবে সেটি দিনের আলো দেখল, মানে প্রকাশ পেল ‘পথের পাচালি’, সেই ঘটনা আছে কিশলয় ঠাকুরের ‘পথের কবি’-তে। তবে, গোটা বিষয়টি বুঝতে গেলে সমকালীন ভাগলপুরের জনমানচিত্রের অবস্থা বুঝতে হবে! ভাগলপুরে তখন নক্ষত্র-সমাবেশ। নামী-দামি বাঙালির মিলনক্ষেত্র। ওই উর্বর বাঙালি সমাজ না থাকলে হয়ত আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেত না ‘পথের পাচালি’।
বিভূতিভূষণ আর এ শহরের সম্পর্কের সামান্য কথা পরে আবার বলব। তার আগে এক ঝলক ভাগলপুরের সামান্য পরিচয়। বিহারের এই প্রশাসনিক বিভাগের সদর শহরের নামও ভাগলপুর। ২০০৫ সালের পরিস্থিতি অনুসারে, এই বিভাগ দুটি জেলায় বিভক্ত। সারা ভারতের সাক্ষরতার হারের চাইতে ভাগলপুরের সাক্ষরতার হার বেশি।
এক সময় ভাগলপুর ছিল বাঙালি মনীষার আঁতুড়ঘর। ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা কাদম্বিনীর জন্ম হয় ১৮ই জুলাই ১৮৬১ তে ভাগলপুরে। তাঁর মূল বাড়ি বরিশালের চাঁদসিতে। বাবা ভাগলপুর স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। ব্রজকিশোর বসু অভয়চরণ মল্লিকের সাথে ভাগলপুরে মহিলাদের অধিকারের আন্দোলন করেছিলেন। তাঁরা মহিলাদের সংগঠন ভাগলপুর মহিলা সমিতি স্থাপন করেছিলেন ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এই ঘটনা ছিল ভারতে প্রথম। কাদম্বিনী তাঁর পড়াশোনা আরম্ভ করেন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ২ জন মহিলা স্নাতকের একজন এবং ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক।
ভাগলপুরের প্রবাসী বাঙালি পরিবারের আর এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আশালতা সিংহ (১৯১১-’৮৩) যাঁর লেখা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “…আশার মননশক্তির মধ্যে অসাধারণতা আছে….।“ খুব ছোটবেলা থেকেই, ন-দশ বছর বয়স থেকেই আলাপ ছিল দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে। দিলীপকুমার, তাঁর প্রিয় ‘মন্টুদা-ভাই’ প্রায়ই যেতেন ভাগলপুরে। তাঁর জ্যাঠামশাই হরেন্দ্রলাল রায় থাকতেন ভাগলপুরে। হরেন্দ্রলালের ছেলে রবীন্দ্রলাল— মালবিকা কাননের বাবা, তাঁর কাছে অনেক দিন গান শিখেছেন আশালতা।
১৯২৪ সালে বীরভূমের বাতিকার গ্রামের জমিদার বাড়ির বউ হয়েছে তের বছরের মেয়ে আশালতা। বর দ্বিজেন্দ্রনাথ সিংহ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বিয়ের পর দু’বছর আশালতা বেশির ভাগ সময়টাই বাপের বাড়িতেই থাকতেন। পাশ করে দ্বিজেন্দ্রনাথ ডাক্তারি শুরু করেন ভাগলপুরের আদমপুরে। সুতরাং প্রথম দিকে, লেখকদের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়নি আশালতাকে। তিনি লিখেছেন, “আমি তখন ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বসুমতী, বিচিত্রা সব বড় বড় কাগজে অবিশ্রান্ত লিখছি। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় বেশ চমৎকার একটি সাহিত্যিক আসর বসত। সভায় বনফুলের বন্ধু পরিমল গোস্বামী, সজনীকান্ত দাস, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাননবিহারী মুখোপাধ্যায় সকলেই নিয়মিত আসতেন প্রতি মাসে। তাঁরা সব যাকে বলে কড়া সমালোচক ছিলেন এবং ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রায়ই আমাকে বেশ কড়া ডোজে গালমন্দ করতেন। আমারও খুব মজা বোধ হত। ভাগলপুরে আমি যতদিন ছিলাম সাহিত্যের আবহাওয়া খুব সরগরম ছিল”। এখন এ সবই স্মৃতি।
অত অল্প বয়সে লেখার এই ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছিলেন আশালতা, তার কারণ হয়তো ভাগলপুরের প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিকদের সঙ্গ। ১৯২৭ সালে ষোল বছর বয়সের একটি মেয়ের কলমে রোমান্টিকতার অমন শরীর-ঘেঁষা পরিমিত উচ্চারণ! বিস্মিত হয়েছিলেন সে কালের পাঠকরাও। বুদ্ধদেব বসু যখন অপরিচিত এই লেখিকার প্রথম উপন্যাস নিয়ে ঘুরছেন প্রকাশকের দরজায় দরজায় তখন অনেকেই ভেবেছিলেন বুঝি বা ছদ্মনাম আশালতা দেবী।
আশালতা জানিয়েছেন, “রবীন্দ্রনাথ আমাকে অনেক চিঠি লিখেছেন। আমাকে দেখতে চেয়েছেন। এঁরা রাজি হননি… বাইরের লোকের সামনে যাওয়ায় এঁদের আপত্তি।“ চব্বিশ বছর বয়সে বিবাহসূত্রে দুবরাজপুরে গিয়েছিলেন আশালতা সিংহ (১৯১১-১৯৮৩)। সেখান থেকে বোলপুর কাছেই। তাঁর লেখা পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আশালতা জানিয়েছেন, শ্বশুরবাড়ির আপত্তিতে দেখা হয়নি, কারণ রবীন্দ্রনাথও তো ‘পরপুরুষ’। ব্যতিক্রমী এই লেখিকা ষোলো বছরে লিখেছিলেন প্রথম বই ‘অমিতার প্রেম’। সে বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র অমিতার সঙ্গে তাঁর জীবনের অনেকটাই মিলে যায়। আর এ হেন আশালতার লেখাকে প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ‘বিচিত্রা’-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় লেখক বিভূতিকে আবিষ্কার করেন যে মানুষটি তার নাম উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এখানে বলা বেশ প্রাসঙ্গিক হবে যে, এই উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন দুজন বিখ্যাত সাহিত্যিককে আবিষ্কার করার কারণে। তাদের মধ্যে প্রথমজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর দ্বিতীয়জন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেন্ট জেভিয়ার্স এবং প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামা উপেন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে আইন পাস করে চলে এসেছিলেন ভাগলপুরে আইন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কলকাতায় লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সময়ই তিনি সাহিত্যের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওই সময়ের বিখ্যাত সব পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’, ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি পত্রিকায় তার লেখা বেরিয়েছে। ওকালতি করতে এসে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তার নিজ বাসভূম ভাগলপুরে একটি সাহিত্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেললেন তার চারপাশে। উপেন্দ্রনাথ একদিকে সাহিত্যপাগল অন্যদিকে মজলিশি। তার বাড়ির কাছারি ঘরে নিত্যদিন জমজমাট সাহিত্য আড্ডা বসে। সেই কাছারি ঘরে বসে পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনলাম পুরনো সেই দিনের কথা।
সাক্ষাৎকারে আশালতা বলছেন, ‘ভাগলপুরের আদমপুর পাড়ায় উপেন গাঙ্গুলীদের বাসভবন ছিল। … যখন ‘বিচিত্রা’ মাসিক পত্রিকা প্রকাশে প্রবৃত্ত হলেন, তখন একদিন আমার বাপের বাড়ীতে হানা দিয়ে যা কিছু এযাবৎ লিখেছিলাম গোপনে সব পাণ্ডুলিপি, কোনটা সমাপ্ত, কোনটা অর্ধ সমাপ্ত সব জড় করে নিয়ে গিয়েছিলেন।’ সেটা ১৯২৭। ষোলো বছর বয়সের একটি মেয়ের কলমের সেই ফসলে বিস্মিত হয়েছিলেন সে কালের পাঠকরাও। বুদ্ধদেব বসু যখন আশালতার প্রথম উপন্যাস নিয়ে ঘুরছেন প্রকাশকের দরজায় দরজায় তখন অনেকেই ভেবেছিলেন তাঁরই বুঝি বা ছদ্মনাম আশালতা দেবী। পরে তিনি হয়ে যান সন্ন্যাসিনী, আশা পুরী। কয়েক বছর আগে কেটে গেল তাঁর শতবর্ষ।
আরও একটা অধ্যায়! ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক বন্দি। যে সে বন্দি নন, রাজবন্দি। জেলের ভেতরেও তিনি কড়া নজরদারিতে থাকেন। আগে একবার দলবল নিয়ে জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। সেই স্মৃতি ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগ নিয়ে জেগে। কয়েক দিন আগেই তিনি জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁকে যেন কোনও একটি ‘টি সেলে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুনে সুপারিন্টেন্ডেন্টের মাথায় হাত! এই বন্দি বলে কি! টি সেলগুলোতে রাখা হয় খতরনাক বন্দিদের। ছোট্ট খুপরি, একা একা থাকা। আলো বাতাস ঢোকে না বললেই চলে। সেখানে কেউ সাধ করে ঢুকতে চায়? সুপারিন্টেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘‘বলেন কী মশাই! ওখানে কেন?’’
বন্দির উত্তর, ‘‘একা থাকলে লেখাপড়ার কাজটা ভাল হয়।’’ ‘‘বেশ, ব্যবস্থা করছি তাহলে।’’ আর ওই টি-সেলে বসেই রুল টানা খাতায় লেড পেন্সিলে লেখা হল এক উপন্যাস, যার নাম ‘জাগরী’। লেখক ‘ভাদুড়ীজি’- সতীনাথ ভাদুড়ী। সময়টা ১৯৪২। গোটা ভারতবর্ষ তখন গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের জ্বরে কাঁপছে। লেখক হিসেবে একেবারেই নতুন, কে পড়বে তার ওই লেখা?
‘বনফুল’, অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সতীনাথের পরম বন্ধু। তাঁর বাড়িতে কারামুক্তির পর নিয়মিত যাতায়াত ছিল সতীনাথের। একদিন গেলেন ভাগলপুরে বনফুলের বাড়ি। কথায় কথায় সংকোচে বলেই ফেললেন, ‘‘একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছি জেলে বসে, একবার পড়ে দেখবে?’’ এভাবেই ভাগলপুরে জন্ম নিল কালজয়ী উপন্যাস ‘জাগরী’।
বনফুল গত শতকের সতের দশকে বাড়ি বিক্রি করে চলে যান কলকাতায়। স্মৃতিচারণে স্থানীয় বাসিন্দা, ‘বিহার-বাঙালি সমিতি’-র সদ সদস্য শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে বললেন, “আমার বাবা পূর্ণেন্দু গঙ্গোপাধ্যায়কে বনফুল গোড়া-দা বলতেন। চারপাশের অবস্থা বদলে যাচ্ছিল। একদিন কাকু, মানে বনফুল বাবাকে বললেন, “গরাদ, আর থাকা গেল না। চলে যাচ্ছি।”
সময় যেন থমকে আছে বনফুলের সেই বাড়িতে।সুন্দর স্থাপত্যের অর্ধ গোলাকার বাড়ি। মোট জমি প্রায় ১৪ কাটা। মূল ভারি লোহার ফটক এবং লাগোয়া দেওয়ালের একাংশ ভেঙ্গে চৌচির। ফটকের পাশে বাঁধানো, ফুট দুই উঁচু একটা অংশ। এর উপযোগিতা বুঝতে পারলাম না। শান্তনুবাবুই বললেন, “এটা আসলে ছিল গো-শালা। ওপরে ছাউনি ছিল। কাকু নিজের হাতে গরুকে খাবার দিতেন।” এই বাড়িতে বসেই দিনের পর দিন লিখে গিয়েছেন চিরকালীন নানা কীর্তি, বিখ্যাত বহু ছোটগল্প।” এক তলা বাড়ির আশপাশে বিশাল খোলা জায়গা। বাড়িতে তৈরী হয়েছে বিউটি পার্লার। কেউ দেখিয়ে না দিলে বুঝতেই পারবেন না, এ বাড়ির মাহাত্ম্য। আমরাও পারতাম না শান্তনুবাবুর খোঁজ না পেলে। বনফুল এখন ভাগলপুরে একেবারেই অপরিচিত নাম।
বনফুল প্রসঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় জনিয়েছেন, “বড়জেঠু ও তাঁর স্ত্রী ১৯৬৮ সালে ভাগলপুরের পাট চুকিয়ে লেক টাউনে বাসা নেন। জেঠুরই কাহিনী নিয়ে ‘হাটেবাজারে’ ছবির কাজ চলছে। অশোককুমার সেখানে সদাশিব ডাক্তার। হঠাৎ তিনি খবর পেলেন, তাঁর বলাইদা এখন ভাগলপুরে। প্রসঙ্গত, অশোককুমারের মামাবাড়ি ওই ভাগলপুরেই।“
এক সময় বাঙালি মনীষায় গমগম করত ভাগলপুর। ২০১৭-১৮ সালে স্থানীয় দুর্গাবাড়ি উদযাপন করেছে শতবর্ষ। কালিবাড়ির বয়স হল ৮০। কালিমন্দির দেখভাল করেন হেমচন্দ্র চক্রবর্তী ও তাঁর পরিবার। হেমবাবু বললেন, “বাবা হরিগোপাল চক্রবর্তী ছিলেন ডাকঘরের সুপার। ছেলেবেলায় দেখেছি এখানকার প্রতিষ্ঠিত প্রায় প্রতি ঘড়ি ছিল বাঙালিদের। আর, এখন হাতে গোনা।”
অশোককুমারের সঙ্গে ভাই কিশোরকুমার ভাগলপুরে আসতেন পুজোর ছুটিতে। দাপিয়ে বেড়াত মামাবাড়ি। মামা ছিলেন ‘রাজা’ শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। গিয়ে দেখলাম পেল্লাই বাড়িটার সামনে, পাশের একটা বড় অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এলাকায় বেশ কয়েক একর জমি ছিল শিবচন্দ্রের। তাঁর দান করা জমির ওপরেই তৈরী হয়েছে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’। একসময় গমগম করত। এখন লোক যায় না। শিবচন্দ্রের অনেকটা জমি দখল হয়ে গিয়েছে। মামাবাড়িতে কিশোরকুমার নিজের একটা ঘর বানিয়েছিলেন। বাহারি দরজা, সোফা দিয়ে। ছেলে অমিতকুমার বাবার মৃত্যুর পর ভাগলপুরে রাজবড়ির ওই ঘরে এসে বললেন, “এটা তো আমার কাছে মন্দির!”
বাড়িটি হাতবদল হয়ে গিয়েছে। দেখভালের দায়িত্বে স্থানীয় প্রভাবশালী রাকেশ কুমার দুবে ওরফে গুড্ডু। ওঁর সঙ্গে ভিতরে ঢুকলাম। মূল রাজবাড়ির ঘরগুলোতে যেন আটকে আছে অতীত। পরিবারের সদস্যদের বড়, বাঁধানো ছবি ঝুলছে দেওয়ালে। শতবর্ষ প্রাচীন নানা আসবাব। হরেক টুকিটাকি জিনিস। শুনশান, লোক নেই! সাবেক রাজবাড়ির রাধাকৃষ্ণ সরে গিয়েছে পিছনে নতুন তৈরি তিন তলা ভবনের ঠাকুরঘরে। গুড্ডু জানালেন, “এখানে তৈরি হবে বহুতল। নাম দেব ‘রাজবাড়ি কমপ্লেক্স।‘ আজমপুর চকের এই সম্পত্তির সামনে এবং পাশে- দু’দিকে রাস্তা। যে বাড়ি এখনও অক্ষত, তার একতলায় একটি শিক্ষা কেন্দ্র, মানবাধিকার সংগঠনের অফিস প্রভৃতি।
অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মকালীন পরিচিত ছিলেন কুমুদলাল গঙ্গোপাধ্যায় নামে। তাঁকে দাদামণি নামে ডাকা হতো। অশোক কুমার নিজেকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছেন। কিশোর অবস্থাতেই চলচ্চিত্র জীবনে অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখতেন। আর কিশোর? তাঁর একটা গর্ব ছিল তাঁর এই নিয়ে যে, ‘পথের পাঁচালী’র সময় তিনি সত্যজিৎ রায়কে ৫০০০ টাকা ধার দিয়েছিলেন ! ‘পরশপাথর’-এ তুলসী চক্রবর্তীর চরিত্রটি নাকি আদতে করার কথা ছিল কিশোরকুমারের। সত্যজিতের প্রস্তাব পেয়ে কিশোর নাকি পালাবার পথ পাননি!
তবে সত্যজিৎকে অসম্ভব রকমের শ্রদ্ধা করতেন কিশোরকুমার। তাই হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও ঠিক সময় বার করে ‘চারুলতা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ ছবির গান গেয়েছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে। সত্যজিৎ নিজেই তাঁকে ‘জিনিয়াস’ আখ্যা দিয়েছেন। কিশোরকুমারের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “এমন কন্ঠস্বর কারও নেই, ছিল না।” দেখতে দেখতে মনের মণিকোঠায় ধাক্কা দিচ্ছিল কিশোরকুমারের সেই চিরকালের গান- “হয়ত আমাকে কারও মনে নেই, আমি যে ছিলাম………।“
লেখার শেষে আবার ফিরে আসি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। ‘পথের কবি’-তে কিশলয় ঠাকুর লিখেছেন, “ইংরেজি উনিশ শ’ চব্বিশের জানুয়ারির শেষে, শীত সন্ধ্যায় ভাগলপুরে এসে নামলেন বিভুতিভুষণ জঙ্গলমহালের কাজ নিয়ে। এসে উঠলেন ভাগলপুর শহরে রামনাথ ঘোষের সদর কাচারী ‘বড়বাসায়’।…..নগরীর এই প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিনী গঙ্গা। ওপারে দিগন্তব্যাপী বালুচর। দিকে দিকে তালবন, সেখানে চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা সাজুঙ্গী জলাশয়, তাকে বেষ্টন করে আছে নিবিড় অরন্যানী। আনন্দে ভরে গেল নবাগতের মন। ক’দিন ধরে কেবল ঘোরেন আর দেখেন।”(পৃষ্ঠা ১৩০)
কিছুকাল আগে গিয়েছিলাম ভাগলপুরে। গত সাড়ে নয় দশকে বেমালুম বদলে গিয়েছে চারপাশ। অনেক খোঁজ করে গেলাম যে বাড়িতে বিভূতিভূষণ থাকতেন, সেখানে। কোনও স্মৃতিফলক নেই। ‘পথের কবি’-তে লেখা, (ওই বাড়ির) “পশ্চিমে একটু গেলেই মহাবীর কর্ণের রাজধানী ‘চম্পানগর’ তার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে বর্তমান। কোনও অপরাহ্নে সেখানে বসলে যেন মহাভারতের যুগে চলে যাওয়া যায়।”
সেই পথ ধরে গেলাম। খুঁজে পেলাম দূর অতীতের নানা আলেখ্য। আমি গিয়েছিলাম খোঁজার চোখ আর মন নিয়ে। তাই অনুভব করলাম সময়ের ধারাপাতে চাপা পড়ে যাওয়া অতীতের নানা পরিচ্ছেদ। অন্যথায় ভাগলপুর এখন নিছকই বিহারের একটা শহর। ইতিহাস ও বাঙালির ঐতিহ্য খুঁজে পাবেন না কোনওভাবে!