সহস্র-বুধের গতিপথ

১৯৭৬ সালের মার্চ মাসের ঘটনা, মুম্বাই শহরের নাম তখন বোম্বে। দেশে জরুরী অবস্থা চলছে, শহরের একটি ব্যস্ত এলাকা খার। তার কাছেই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর।

পদ্মজা সহস্রবুধে – বছর ৪০ এর এই গৃহবধূ ১০ বছরের ছোট ছেলে জয়ন্তকে নিয়ে সকাল দশটা নাগাদ বাজারে এলেন। এক হাতে ধরা ছেলে আর অন্য হাতে বাজারের একটা ব্যাগ। আজ হঠাৎ জয়ন্ত অবাক হয়ে দেখল মা খুব সদয় হয়ে আছেন। যেসব অখাদ্য অন্য দিন কোন মতেই খেতে দেন না, আজ যেন সহজেই সবকিছু পেয়ে যাচ্ছে সে।
যে গোলা বহু অনুনয়-বিনয় করলেও মা কখনো কিনে দেন না আজ একবার চাইতেই পাওয়া গেল। গোলা শেষ হতেই আচার খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ভয়ে ভয়ে চেয়েই ফেলল ছেলেটি। আশ্চর্য্য ব্যাপার! সেটাও পাওয়া গেল। খুব অবাক লাগছে, মায়ের হল কি আজ?

সেই সময়ই বাজারের মাঝখানে কয়েকজন মহিলা চিৎকার করতে শুরু করলেন ‘ভারত মাতা কি জয়’ ‘লোকশাহী বাচবা, দেশ বাচবা’। জয়ন্তের মা পদ্মজাবাঈও ওদের সঙ্গে যোগ দিলেন। হাতের বাজারের ব্যাগ থেকে পতাকা বের করে জোরে জোরে স্লোগান দিতে লাগলেন। দুটো প্ল্যাকার্ড‌ও বের হল ব্যাগ থেকে। খবরের কাগজের উপরে লেখা স্লোগান ‘লোকশাহী বাচবা’।

মিনিট ১০-১৫ প্রদর্শন চলার পরেই পুলিশ চলে এলো। মহিলা পুলিশ নেই দেখে পদ্মজা চেঁচিয়ে উঠলেন ‘আস্থালা স্পর্শ করং নকা’ (কেউ ছোঁবে না আমাদের!)। আরও ১০ মিনিট লাগলো মহিলা পুলিশ আসতে। আধঘন্টা বিক্ষোভের পরে পশ্চিম মুম্ব‌ইয়ের খার পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসা হল ১১ জন বিক্ষোভকারী মহিলাকে। মায়ের পাল্লু ধরে লকাপে ঢুকে গেল দশ বছরের জয়ন্ত। পুলিশ বাচ্চাটাকে নিয়ে পড়লো মহা ফাঁপরে। মাকে চালান কেটেও জেলে পাঠানো যাচ্ছে না। বাচ্চাটিকে কয়েকবার বিস্কুট জল দেওয়া হয়েছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল। মহিলা পুলিশ কনস্টেবল ডিউটি ছেড়ে যাওয়ার আগে বাচ্চাটিকে একটি পাও ভাজি ও কিনে দিয়ে গেলেন। অনেক রাতে ডিউটি থেকে ফিরে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে গেলেন বাবা, পুলিশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

এই ছেলে বড় হয়ে লেখাপড়ায় খুব ভালো হলো।ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার বিভাগ থেকে ১৯৮৯ সালে স্নাতক হওয়ার পরে ভাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টারে বৈজ্ঞানিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু অতি অল্প সময় পরেই সেই গবেষণার কাজ ছেড়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রচারক হিসেবে যোগ দিলেন।

মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন আর গোয়ার সমুদ্রতটে বহুদিন সংগঠনের কাজ করলেন জয়ন্ত সহস্রবুধে। বিদেশী পর্তুগিজ খ্রিস্টানদের অত্যাচারের দগদগে ঘা এলাকার প্রত্যেক কোণায় তখনো বর্তমান। ওখানে ইতিহাস সংগ্রহের কাজ থেকে লোকসংস্কারের কাজ সবকিছুতেই মন লাগালেন জয়ন্ত। গ্রামে গ্রামে ভেসে উঠলো রাষ্ট্র ভাবনা। জাগরিত হল সামাজিক আন্দোলন। পরবর্তীকালে মনোহর পারিক্কারের মতো দেশ বরেণ্য নেতৃত্ব তৈরি হয়েছিলেন তার সংগ্রহ করা জনসম্পদ থেকে। সঙ্ঘ কাজের ভিত্তি তৈরি করেছিলেন তিনি। অত্যন্ত শান্তস্বভাবের মিশুকে অথচ প্রচণ্ড দৃঢ়চেতা মানুষটি সংস্পর্শে যিনি এসেছেন তিনিই আকৃষ্ট হয়েছেন। খুবই দ্রুতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে শাখা। যেখানে সংগঠনের কোন কিছু কাজই ছিল না, তার থেকে একটি শক্তিশালী কর্মকাণ্ড শুরু হয় সেখানে।

সেই সময় উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচন্ড অস্থিরতা চলছে। প্রায় ভারত বর্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা ঠিক সেই সময় একেকটি উপক্রমশীল বিভাগকে একটি করে প্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোঙ্কন বিভাগের উপর দায়িত্ব ছিল নাগাল্যান্ড প্রদেশের। ১৯৯০ সালে সংঘের সরকার্যবাহ হয়েছিলেন কুপ্পাহলি সীতারামাইয়া সুদর্শন। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরি ইমারত ধ্বংস হয়েছিল। ঠিক তার আগের দিনই ঘটনাক্রমে ঘোষণা হয়েছিল যে জয়ন্ত সহস্রবুধে মাননীয় সরকার্যবাহের সহায়ক হিসেবে কাজ করবেন।

সেদিন সব যানবাহন বন্ধ। কখনো কোন স্বয়ংসেবকের বাইকে কখনো বা কেবল পায়ে হেঁটে পানাজি থেকে মুম্বাই পৌঁছিলেন জয়ন্তরাও। সেদিন ২৬ বছরের এই দামাল যুবকের ইচ্ছাশক্তি আর ধ্যেয়নিষ্ঠা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং সুদর্শনজী।
এরপরে বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র জয়ন্ত শ্রীকান্তরাও সহস্রবুধে বিজ্ঞান ভারতীর সংগঠন সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন। দিনরাত এক করে কাজ করতেন মানুষটি। ট্রেনে, বাসে, গাড়িতে বা বিমানে সব যাত্রাতেই তার একটা ছোট্ট ব্যাগ। কারণ একদিনের কাপড়ই থাকতো ব্যাগে। প্রতিদিন নিজের পরিধেয় কাপড় ধুয়ে দিতেন আর শুকিয়ে ইস্ত্রি করে পরের দিন পরতেন। বালিশ ছাড়াই শুতেন। যে কোন জায়গায় ঘুমিয়ে যেতেন। সারারাত এয়ারপোর্টে বসে থেকে পরের দিন সকাল থেকে সারাদিন স্বাভাবিক কাজ করে যেতে পারতেন। মিতাহারী কিন্তু ভোজন রসিক ছিলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পরে থালা দেখে বোঝা যেত না কেউ সেই থালায় খেয়েছেন। কিন্তু সবরকম, সব মেজাজের আর কম বেশি ক্ষমতার সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারতেন।

পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জয়ন্ত রাওয়ের প্রাণের টান ছিল। স্বামী বিবেকানন্দের উপরে গভীর প্রজ্ঞা ছিল। শ্রদ্ধা ছিল নবজাগরণের সব বাঙ্গালী মনীষীদের উপর। আশুতোষ থেকে জগদীশচন্দ্র সকলের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা অবিরল বলতেন। বাঙ্গালী বিজ্ঞানীদের কাজের সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক সরল ব্যাখ্যা করতে পারতেন সব স্তরের ছাত্রছাত্রীদের সামনে।

বাঙালি বিজ্ঞানীরা স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে বিজ্ঞান গবেষণাকে তুলে নিয়েছিলেন এটা ছিল তার মত। এ বিষয়ে প্রচুর গবেষণামূলক কাজ করেছিলেন তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর প্রথম জীবনীকার পত্রিকায় নিয়ে এসেছিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে। ক্লেয়ার গেডিস সারাদিন কাটিয়েছিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে আর রাজাবাজারের আচার্য্য ভবনে। সারা ভারতের বড় বড় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ছিল তার সরল অথচ গভীর সম্পর্ক। মজার ব্যাপার হলো ২০১৪ সালের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী জয়ন্ত রাওয়ের অতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কলকাতার একটি বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার কয়েকজন বন্ধু এটি নিয়ে যখন তার সঙ্গে মজা করছেন ঠিক তখনই গেস্ট হাউসের রুম সার্ভিসের ছেলেটি জলের পাত্র আর গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। জয়ন্তরাও ছেলেটিকে দেখেই বললেন ‘আরে পার্থ! কেমন আছো!’ ছেলেটি একেবারে হতবাক। ঘটনার প্রায় দেড় বছর আগে তিনি একবার এখানে এসেছিলেন। তিনি ছেলেটির নাম এবং বাড়ি, মা আর একটি বোন আছে সেটিও মনে রেখেছেন।

ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সাইন্স ফেস্টিভ্যালে প্রধানমন্ত্রীসহ বহু বিশিষ্টজন এসেছেন বহুবার। তিনি সবচেয়ে কঠিন কাজ, সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। নিপুন ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু কখনই সামনে এসে দাঁড়ান নি। বাতাসের মধ্যেকার অক্সিজেনের মত তিনি ছিলেন অপরিহার্য কিন্তু অদৃশ্য।

বিজ্ঞান ভারতীর পূর্ণকালীনদের পরিচালনাতে উনি অদ্ভুত পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। তিনি দৈনিক বা মাসিক কাজের খবর নিতেন না। কেবল ভাবনা দিতেন আর স্বপ্ন দেখাতেন। তাঁর কথায় যেসব শিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক ছেলেমেয়ে তাদের যৌবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় দেশে বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য দিতে এসেছে তাঁরা তো ভালোবেসেই এসেছে, তাই ভালোবেসে যে কাজ করে তার কাজের হিসেব নিতে নেই।
কে বিজ্ঞান ভারতী সদস্য হবে কে হবেন বিজ্ঞান ভারতের কার্যকর্তা তার পরিষ্কার উত্তর ছিল যিনি দেশকে ভালবাসেন দেশে বিজ্ঞানের প্রচার প্রসার চান তিনি সদস্য হতে পারেন। তাকে বড় বিজ্ঞান শিক্ষক বা বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আসল সম্পর্কসূত্রটা হলো ভালোবাসা আর নিঃস্বার্থ কাজ।

স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের সময় জয়ন্তরাও বললেন, অগ্নিযুগে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অন্যতম প্রেরণা ছিল শ্রীমদ্ভাগবতগীতা। তার অনুপ্রেরণাতেই কলকাতা আর দিল্লিতে গীতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে দুটি বড়সড় অনুষ্ঠান হয়। কলকাতার অনুষ্ঠানের আগে বাংলা ও হিন্দিতে বই ছাপানো হল। বইতে বিভিন্ন বিপ্লবের জীবনে শ্রীমদ্ভাগবত গীতার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছিল। ১৮ই জুন ২০২২ তারিখে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার করে স্বামী বিবেকানন্দের পৈত্রিক বাসস্থান থেকে জোড়াসাঁকোতে আসা হয়েছিল গীতা ও পুস্তক বিলি করতে করতে। তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র মঞ্চে একটি সুন্দর অনুষ্ঠান হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গান আর নাটক উপস্থাপন হল। বক্তৃতা দিলেন ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বামী প্রদীপ্তানন্দ মহারাজ এবং জয়ন্ত সহস্রবুধে। তারপর রাতের বিমান ধরে দিল্লি চলে গেলেন জয়ন্তজী। সেই শেষবারের মতো কলকাতায়।

ড. জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.