‘গোত্র’ শব্দের উৎস ও তাৎপর্য: বেদ, আবেস্তা ও অন্য প্রাচীন সভ্যতায় ‘গো’ – পর্ব ১

‘গোত্র’। ‘গোত্র’ মানে কি? তাৎপর্য কি?

শ্রুতি ও আবেস্তা নিয়ে কিঞ্চিৎ জ্ঞান ছাড়া কি ‘গো’ তাৎপর্য বোঝা সম্ভব? না, সম্ভব নয়। কারণ, ইন্টারপ্রিটেসন তাহলে ‘অ্যানাক্রোনিস্টিক’ হয়ে যাবে, বা ‘ক্রম বিপর্যয়’ ঘটবে। বর্তমানে কোনও শব্দের কোনও অর্থ অধিক প্রচলিত মানে এই নয় প্রাচীনকালেও তাই ছিল। বৈদিক হিন্দু ধর্মের শিকড় জানতে গেলে এবং বৈদিক হিন্দু ধর্মকে গতিশীল ও সংস্কারমুখী রাখতে গেলে আদিতে ফিরতে হবে। আদি হল শ্রুতি।

বাংলায় তো এখনও আমরা তিনটি শব্দ ব্যবহার করি যাতে ‘গো’ আছে –
গবেষণা = গো + এষণা
গবাক্ষ = গো + অক্ষি
গোমুখ = গো + মুখ (গঙ্গার উৎস)

তাহলে ‘গো’ মানে কি ‘গরু’? গবেষণা করছেন মানে কি গরু খুঁজছেন? (প্রচলিত বাগধারা অবশ্য আছে – ‘গরু খোঁজা খুঁজলাম’)! বাড়ীতে জানালা লাগিয়েছেন মানে গরুর চোখ ফিট করেছেন? গঙ্গার উৎস গোমুখ দেখতে গেছেন মানে গরুর মুখ দেখতে গেছেন? যদি তাই ভেবে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা হয়, তাই থাকুন। আর যদি বিদ্যা চর্চার মানসিকতা থাকে অর্থাৎ অনুসন্ধিৎসা থাকে, তাহলে ‘গরু’ না খুঁজে ‘গো’ খুঁজুন।

চলুন, অনুসন্ধান করি। গোত্র = ‘গো + ত্র’। অর্থাৎ, ‘গো’-এর আশ্রয়। ‘গো’ মানে কি? কার আশ্রয়?

বৈদিক গ্রন্থে, ‘গো’ শব্দের বহু অর্থ হয় –

১। ‘গো’ = জ্ঞান, বিদ্যা [আগেই বলেছি, গো + এষণা = গবেষণা । ‘গবেষণা’ ঋগ্বেদের শব্দ]
২। ‘গো’ = পৃথিবী [geo] [উদাহরণ – মহাভারত ১২.১২০.৩০-৩১]
৩। ‘গো’ = নদী (ঋগ্বেদ) [আগেই বলেছি, গঙ্গার উৎস ‘গোমুখ’ = গো + মুখ]
৪। ‘গো’ = ছন্দ [বাচ্‌-এর রূপ]
৫। ‘গো’ = বাচ্ [ভাষা, শব্দ] [উদাহরণ – ঋগ্বেদ ৮.১০০.১১। মহাভারতে কৃষ্ণের মুখে ব্যাস – ১৪.২১]
৬। ‘গো’ = আলো [আগেই বলেছি, ‘গবাক্ষ’ = গো + অক্ষি]
৭। ‘গো’ = গরু, ধন, অর্থ, সম্পদ
৮। ‘গো’ = ঋষি (উদাহরণ – অথর্ব বেদ, শৌনক ৮.৯.২৫)

‘অসুর’ এবং ‘রাক্ষস’ শব্দের তাৎপর্য ‘আক্ষরিকতা’ এবং প্রবৃত্তি তাড়িত দেহকেন্দ্রিকতা (সংহিতার কিছু অংশ ছাড়া সমগ্র শ্রুতিতে, রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণে)। অর্থাৎ, ‘গো’ মানে আক্ষরিকভাবে ‘গরু’ মনে করা। ‘গো’ মানে কি ‘গরু’ নয়? অবশ্যই হ্যাঁ। কিন্তু অনেক অর্থের একটি অর্থ। এখন, ‘গো’ শুনলেই যদি ‘গরু’ মনে আসে, তাহলে বুঝতে হবে সেটা সংস্কৃত ভাষা এবং ঐতিহ্য ভুলে যাবার ফল। গোদা বাংলায় মগজধোলাই। একটি অর্থকে সম্পূর্ণ অর্থ মনে করা ও চালানোর চেষ্টায় যে সাধারণীকরণ আছে, বলাই বাহুল্য, তা নিকৃষ্ট কুযুক্তিবাদ।

ঐতিহ্য ভোলা আর আধুনিকতা যদি কেউ সমার্থক মনে করেন, বেশ তো, আপনাকে প্রণাম – ‘খুরে খুরে প্রণাম’। নিজের ঐতিহ্য ভুলছেন খুব ভালো কথা, কিন্তু অন্য সভ্যতা সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আবার আধুনিকতা ভাবছেন না তো? নিজের ঐতিহ্য প্রতীক হেয় করে আবার অন্য সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতীক ঘাড়ে চাপাচ্ছেন না তো? খেয়াল রাখবেন। না হলে, এই পাতকুড়ানো দ্বিচারিতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। আমি প্রশ্ন করবো। উত্তর দিতে পারবেন তো?

সংস্কৃত ভাষায় একই শব্দের বহু অর্থ হয়। সেই অর্থ নিরূপণ করতে হয় প্রসঙ্গ দেখে। প্রসঙ্গ দেখলাম না, নিরুক্ত বুঝলাম না, অথচ প্রসঙ্গ থেকে খাবলে নিয়ে মনোমত এজেন্ডা-প্রসূত গল্প বানালাম, সেটা কি করে যুক্তিসঙ্গত হয়? সুতরাং, ‘গোত্র’ মানে ‘গরুর আশ্রয়’ ‘গোশালা’ প্রভৃতি মনে করা খুবই ভোঁতা রকমের আক্ষরিকতা এবং/ অথবা ঐতিহ্য ভুলে ‘ময়ূর পুচ্ছধারি আধুনিক কাক’ সাজার ফল।

‘গোত্র’ শব্দে, ‘গো’-এর অর্থ বিদ্যা, আলো এবং পৃথিবী। সুতরাং গোত্র মানে, বিদ্যার পৃথিবীর ও আলোর আশ্রয়। ‘গবেষণা’ শব্দই তার প্রমাণ। গো মানে গরুও হয়, তাই এরপরও যদি কারো মনে হয় ‘গোত্র’ মানে ‘গুরুর আশ্রয়’ না হয়ে ‘গরুর আশ্রয়’ বা ‘গোশালায় আশ্রয়’, বেশ, আপনাকেও প্রণাম। আপনি না হয় ‘গুরুর আশ্রয়’ না নিয়ে ‘গরুর আশ্রয়’ নিলেন। গণতান্ত্রিক মানসিকতায় মেনে নিলাম!

আসলে ব্যাপারটা খুবই বাস্তব সম্মত। ‘গো’ মানে ‘ঋষি’ হয় আবার ‘গরু’ হয়। যার যেমন মেধা, সে তেমন অর্থ করবে। যার যেমন স্বভাব, তার বাস্তব বোধ তেমনই হবে। বিদ্যা ও জ্ঞান অর্জন যার জীবনের মুখ্য লক্ষ্য – নিদেন পক্ষে যিনি মনে করেন পুঁথিগত বিদ্যা না হলেও জীবন থেকে শেখা জীবনের উদ্দেশ্য – তিনি ‘গোত্র’ শব্দে ‘গো’ শব্দ ‘ঋষি’ ধরে বুঝবেন ‘গোত্র’ মানে ‘ঋষির আশ্রয়’। আর সে মেধা যার নেই – মানে স্কুল জীবনে মাস্টারমশাইদের ‘গরু’ সম্বোধিত যে ধেড়ে বয়সে তাই থেকে গেছে, বিকাশ বা বিবর্তন হয়নি – সে ‘গোত্র’ মানে ভাবুক ‘গরুর আশ্রয়’ বা ‘গোশালার আশ্রয়’। গণতান্ত্রিক। বৈচিত্রের সহাবস্থান। নো প্রব্লেম!

স্মরণে রাখুন, ছান্দোগ্য উপনিষদে সত্যকাম জবালা গরু চরাতে চরাতে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। সুতরাং গরু থেকে গুরু হওয়া যায় – এ আশাবাদ উপনিষদে আছে। সত্যকাম জবালার বিষয়ে আবার ফিরবো। খেয়াল রাখুন, তাঁর গোত্র পরিচয় তাঁর মায়ের নামে। সুতরাং গোত্র মানে পুরুষ পুরুষ ব্যাপার, ইহা নিতান্ত বেঢপ ঢপ।

এবার বোঝা যাক, ‘গোত্র’ তাৎপর্য কি। কেন ‘গোত্র ব্যবস্থা’?

প্রথম কথা, এখানেও একই মগজধোলাই কাজ করছে – যারা মনে করে গোত্র, বর্ণ, আর caste এক!

আজ্ঞে না। তার প্রমাণ, একই গোত্র ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ এবং caste হতে পারে। অর্থাৎ, গোত্র এমন এক template যা বর্ণ ও caste ভিন্ন হলেও এবং পালটালেও constant থেকে যাবে, যদি না কেউ নিজে পাল্টায়।

নিজে যদি নিজের গোত্র জানেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন ঐ গোত্রে বিভিন্ন জাত ও বর্ণ আছে। গোত্র ব্যবস্থা আসলে পারিবারিক ইতিহাস যাতে কেউ ভুলে না যায় জাত বর্ণ আলাদা হলেও উৎস এক। ‘পারিবারিক ইতিহাস’ মানে কি রক্তের সম্পর্ক? একেবারেই না। গোত্র ব্যবস্থার আর একটি উদ্দেশ্য রক্তের সম্পর্ক নামক জাতবাদি বিষয় কায়েম হতে না দেয়া। সে প্রসঙ্গে আসছি।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে না যে প্রাচীনকালে লোকে নিজের পদবী কি বলত? মানে ধরুন, যুধিষ্ঠিরের পদবী কি ছিল? নাহ্‌, পদবী ছিল না। গুরুর গোত্রে বা বংশ পরিচয়ের পরিচয়ে গোত্র পরিচয় ছিল। যুধিষ্ঠির নিজের পরিচয় দিতেন ‘ব্যাঘ্রপদ’ – যা বশিষ্ঠ গোত্রের একটি অনু-গোত্র। তবে, আপাতত সে আলোচনায় যাব না। আলাদা পোস্টে লিখবো। ব্যাঘ্রপদ বিষয়ে বিরাট আলোচনা আছে। এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না।

আপাতত কয়েকটি তথ্য – সত্যকাম জবালার শিষ্য ছিলেন ব্যাঘ্রপদের পুত্র গোশ্রুতি (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৫.২.৩)। খেয়াল রাখুন ‘গোশ্রুতি’ – ‘গো + শ্রুতি’। ব্যাঘ্রপদ বশিষ্ঠ ঋগ্বেদের একজন ঋষি। মহাভারতের এক পৌরাণিক মতে, বশিষ্ঠের জন্ম হয়েছিলো ব্যাঘ্র যোনিতে। আধুনিক চিন্তায় একে অনায়াসে ‘টোটেম’ ভাবতে পারেন। অর্থাৎ, বশিষ্ঠ হলেন – ঐ যে ইয়ে কি যেন বলে আপনাদের ভাষায় – হ্যাঁ, ‘ভূমিপুত্র’! [আরে মশাই, ‘ভূমিপুত্র’ শব্দে যে চ্যাটচ্যাটে পুরুষতান্ত্রিক জাতবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ আছে খেয়াল করুন, সচেতন হন। ভূমিপুত্র নিয়ে ডায়ালগ দেবেন, তাহলে ভূমিকন্যা কোথায় গেলো? তৃতীয় জেন্ডার হলে ভূমি বুঝি তার নয়? আপনি কি গাছ নাকি মশাই যে নির্দিষ্ট কোন ভূমিতে গজিয়েছেন? যে ভূমিকে আপনার বলে বক্তৃতা দিচ্ছেন, সে ভূমিতে এক সময় ডাইনোসর চরত। মানুষ নামক নগণ্য জীব লুপ্ত হলে অন্য কোন প্রজাতি চরবে। বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন বিনয়ী থাকুন। নিজের কয়েক পুরুষের বেশী ইতিহাস জানেন না – দাদুর দাদুর নাম বলতে পারেন না – আবার এর ওর বংশ তালিকা মুখস্থ করে হিস্ট্রি নির্মাণ! ভাঁড়ামো টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি!]

ব্যাঘ্রপদ বশিষ্ঠ কত শ্রদ্ধার ঐতিহ্য ছিলেন, জানেন? গৌতম বুদ্ধও তাঁকে স্মরণ করেছেন। ত্রিপিটকের অঙ্গুত্তর নিকয়ে ‘ব্যাগঘপজ্জ সুত্ত’ আছে। গৌতম বুদ্ধ নিজের পরিচয় তাঁর বৈদিক গোত্র এবং জাতি উল্লেখ করে দিতেন। সুত্ত নিপাতের পবজ্জা সুত্তে (৩.১), গৌতম বুদ্ধ রাজা বিম্বিসারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছেন, তাঁর গোত্র সূর্য বংশীয় (আদিচ্চ বা আদিত্য) এবং তাঁর জাতি শাক্য। অতনতিয় সুত্ত-তে (দীঘ নিকয় ৩২), গৌতম বুদ্ধ বলেছেন তিনি অঙ্গিরা, এবং আদিত্যর আত্মীয় (আদিচ্চ বন্ধুনাম), অর্থাৎ সূর্য বংশীয়। আবার, মহাপদন সুত্ত-তে (দীঘ নিকয় ১৪), গৌতম বুদ্ধ বলেছেন তিনি গৌতম গোত্রীয় – গোতমো গত্তেন অহোসিং। সুতরাং, গোত্র বিষয়ে ননসেন্স জাতবাদি গল্প শোনাবেন না।

অনেকে হা হুতাশ করেন ঋগ্বেদে নাকি বাঘের উল্লেখ নেই; এবং সেই কল্পনা ভাঙ্গিয়ে তত্ত্ব হাঁকড়ানো হয় ঋগ্বেদ নাকি ভারতের বাইরে রচিত। ঋগ্বেদে বাঘ না থাকার গল্প ‘আর্যজাতির আক্রমণ/ আগমন তত্ত্ব’ আর ‘আর্য বনাম অনার্য’ এন্টারটেইনমেন্ট মুভির সাপোর্টিং এক্টর। তা মশাই, ঋগ্বেদের ঋষি যদি ব্যাঘ্রপদ হন, তাহলে তাঁর নাম দিয়েই তো ঋগ্বেদে বাঘ রইলো? ঋগ্বেদে বাঘ শব্দ দিয়ে ঋষি নাম আছে, আর বৈদিকরা বাঘ জানতো না?

আমাদের প্রাচীন ঋষিরা এমন গোত্র ব্যবস্থা কেন করেছিলেন? করেছিলেন, যাতে মানুষ হয়ে জন্মালেই প্রত্যেক মানুষে সামাজিক পরিচয় থাকে। যার কোন গোত্র নেই, বা গোত্র ভুলে গেছে, তার default গোত্র ‘কশ্যপ’। এর উদ্দেশ্য, সমাজের কোন শিশু যাতে পরিচয়হীন না থাকে; illegitimate child বলে কোন কিছু বৈদিক হিন্দু ধর্মে ছিলো না। যদি কোথাও তেমন তকমাবাজী হয়ে থাকে, তা বৈদিক হিন্দু ধর্ম নয়। [কতরকমের বিবাহ এবং কতরকমের সন্তান হতে পারে, সে আলোচনায় আপাতত যাচ্ছি না। অন্য পোস্টে সে বিষয়ে আলোচনা করবো]

কেন default ‘কশ্যপ’? কারণ, কশ্যপ আদি পিতা। পৌরাণিক মতে তিনিই জীবজগতের স্রষ্টা। পৌরাণিক মত বিশ্বাস করতে আধুনিকতা টনটন করছে? খুব ভালো কথা। ও মত নিতে হবে না। তার সমাধান আছে উপনিষদে ও নিরুক্তে। ‘কশ্যপ’ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে না। আপাতত দুটি তাৎপর্য জানাই।

প্রত্যেক ঋষির নামের শ্রুতি তাৎপর্য হল ইন্দ্রিয় ও প্রাণ। আবার কশ্যপ হলেন সূর্য। সূর্য মন্ত্র স্মরণ করুন – ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং।/ ধ্বান্তারিং সর্ব পাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।। সূর্য যেমন সকলকে আলো দেন, সেই তাৎপর্য নিয়ে কশ্যপ গোত্র মানে পৃথিবীতে মানুষ পরিচয়ে বেঁচে থাকার অধিকার, তা সে অন্য সামাজিক গোত্র পরিচয় থাক বা না থাক। প্রত্যেক মানুষের মানুষ পরিচয় থাকবেই। তাই যার কোন গোত্র নেই বা জানা নেই, কিন্তু গোত্র পরিচয়ের প্রয়োজন আছে, সেও নিজের পরিচয় দিতে পারে কাশ্যপ।

দেখবেন আবার, কাশ্যপ নাম নিয়ে জাতবাদের গল্প শোনাতে আসবেন না। বৌদ্ধ মতে, ত্রিপিটকের মহাপদান সুত্ত অনুযায়ী, সপ্ত বুদ্ধের ‘বর্ণ পরিচয়’ এবং গোত্র উভয়ই আছে। সকলেই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়। গৌতম বুদ্ধের আগের তিন বুদ্ধ –
১। ৪র্থ বুদ্ধ কাকুসন্ধ – ব্রাহ্মণ –কশ্যপ গোত্র
২। ৫ম বুদ্ধ কোনগমন – ব্রাহ্মণ – কশ্যপ গোত্র [‘অশোকের শিলালিপিতে’ একমাত্র এনার নাম উল্লেখ আছে]
৩। ৬ষ্ঠ বুদ্ধ – তাঁর নামই কশ্যপ – ব্রাহ্মণ – কশ্যপ গোত্র

জৈন মতের তীর্থঙ্কর মহাবীর ছিলেন কশ্যপ গোত্রের, এবং তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন ইন্দ্রভূতি গৌতম। আবার, বৌদ্ধ ঐতিহ্যে, গৌতম বুদ্ধের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে আছেন মহাকাশ্যপ। কশ্যপ নামের পবিত্রতা ও সর্বজন শ্রদ্ধার উদাহরণ হিসাবে এগুলি বললাম। মনে রাখবেন, কাশ্মীর ও Caspian Sea যে কশ্যপের নামে, সে মতও আছে।

তার মানে যার গোত্র নেই, তার default গোত্র কি ‘কশ্যপ’ হতেই হবে? আজ্ঞে না। এ হল বৈদিক হিন্দু ধর্ম। ব্যক্তি স্বাধীনতার ধর্ম। গোত্র পরিচয় মানে কি কোন পুরুষের (male) নামে পরিচয় হতেই হবে? আজ্ঞে না। মায়ের নামেও গোত্র পরিচয় নেয়া যেত। উদাহরণ, সত্যকাম জবালা। তিনি তাঁর মা জবালির নামে নতুন গোত্র প্রবর্তন করেন। সুতরাং, default গোত্র ‘কশ্যপ’ – এর ব্যতিক্রম ঘটানো সম্ভব কেউ যদি নিজ মায়ের নামে গোত্র স্থাপন করেন।

আদি গোত্র প্রণেতা কারা?

বর্তমান ঋগ্বেদ গ্রন্থে ৪২৪ জন ঋষি ও ঋষিকা (নারী ঋষি) আছেন। তাঁরা গোত্র পরিচয় সম্পন্ন, গোত্রহীন, অগোত্র – সব রকম। অর্থাৎ, ঋষি পরিচয়ের সাথে গোত্র পরিচয়ের কোন সম্পর্ক নেই। গোত্র পরিচয় না থাকলেও ঋষি হওয়া যায়। ঋষি পরিবার আছে – প্রধান ঋষি পরিবার ৮টি, তাঁরা গোত্র প্রবর্তক ঋষি। এছাড়াও পরিবার পরিচয়হীন বা গোত্র পরিচয় সম্পন্ন, গোত্রহীন, অগোত্র ঋষি ও ঋষিকা আছেন।

গোত্র প্রবর্তক ঋষি বা প্রবর্ষি ‘৮’ – বশিষ্ঠ, কশ্যপ, বিশ্বামিত্র, গৌতম, জমদগ্নি (ভৃগু), ভরদ্বাজ, অত্রি ও অগস্ত্য। বেদব্যাসের পিতা পরাশরের মতে, আদি গোত্র ৪টি – অঙ্গিরা, কাশ্যপ, বশিষ্ঠ ও ভৃগু। তাঁদের থেকে আরও অনেক গোত্র হয়েছে, এবং সর্ব ক্ষেত্রেই সেই সমস্ত গোত্রের উৎপত্তি করেছেন এমন ঋষি যাঁদের পিতা মাতা বর্ণ ও জাত মানেননি (মহাভারত, ক্রিটিকাল এডিসন ১২.২৮৫)।

তার মানে, মহাভারতেও আমরা পাচ্ছি, গোত্রের সাথে বর্ণ বা জাতের সম্পর্ক নেই।

এই ৮ ঋষির নামে গোত্র পরিচয় গ্রহণ করা কি বাধ্যতামূলক বা আবশ্যক? না! বৈদিক হিন্দু ধর্ম ব্যক্তি স্বাধীনতার ধর্ম। এখানে কোন ‘এক গ্রন্থ এক ঋষি এক মত’ জাতীয় কাল্পনিক ডিক্টেটরশিপ নেই।

কারোর যদি মনে হয় গোত্র পরিচয় রাখবেন না, রাখবেন না। সেই না রাখাটা কোন তথাকথিত আধুনিক ব্যাপার নয়। ঋগ্বেদের গোত্রহীন, অগোত্র ঋষি ও ঋষিকারাই তার প্রমাণ। জেনে রাখুন, নারীও যেমন গোত্র প্রবর্তক হতেন, তেমনই নারী ইচ্ছা করলে গোত্রহীন থাকতে পারতেন। এর সব থেকে বড় প্রমাণ কে জানেন? যারা হিন্দু মতে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করেছেন, তাঁরা কার মন্ত্র পড়েছেন? জানেন? নাকি কৌতূহলী হতে ইচ্ছা হয়নি?

ইদানীং নারী পুরোহিত বিয়ে দিচ্ছেন। খুবই ভালো। তাঁরা একটা লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য ফেরাচ্ছেন। ‘পুরোহিত’ মানে খ্রিস্টীয় প্রিস্ট আর ইসলামের মোল্লা কাজী নয়। যদি সমার্থক ভাবতে শিখে থাকেন, ভুল শিখেছেন। পুরোহিত মানে যদি পুং লিঙ্গ ভাবতে শিখে থাকেন, ভুল শিখেছেন। আর একটি মগজধোলাইয়ের নিদর্শন। ‘পুরোহিত’ মানে যিনি ‘সামনে থাকেন’ বা ‘নেতা/ নেত্রী’ এবং যিনি ‘পুরের হিতাকাঙ্ক্ষী’। সব মিলিয়ে তাৎপর্য হল, যিনি সমাজ কল্যাণ চেয়ে সমাজের নেতৃত্ব দেন। হ্যাঁ, জাতবাদ তার তাৎপর্য পাল্টে দিয়েছে সত্য কথা। অপব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে, সত্য কথা। সেটা সামাজিক ব্যাধি। কিন্তু মিথ্যাটা নেবো কেন? মিথ্যাটা বজায় রাখবো কেন? সংস্কার গতিশীল। ক্ষমতাতন্ত্র কায়েম হবার চেষ্টা হলেই তাকে ভাঙ্গতে হবে। এই গতিশীলতাই বৈদিক হিন্দু ধর্ম।

পুরোহিত হতে গেলে কি ব্রাহ্মণ-জাত হওয়া আবশ্যক? তাই যদি মনে করেন, তেমন যদি ধারণা হয়, সেটা আপনার জ্ঞানের ঘাটতি। ঐতিহ্য ভুলে ‘ময়ূর পুচ্ছধারি আধুনিক কাক’। খবর রাখেন আফ্রিকায় ইন্দোনেশিয়ায় বৈদিক হিন্দু ধর্মের অস্তিত্বের? হ্যাঁ, সেখানেও পুরোহিত আছেন। তাঁরা ভারতীয় নন। তাঁরা ব্রাহ্মণ পরিচয় পেয়েছেন। তাঁরা বিয়ে দেন পূজা করেন। সমস্যা আছে কি? একেবারেই নেই। শূদ্র বর্ণ থেকেও সরাসরি ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। মূল বিষয় গুণ ও কর্ম বা function। ‘আভীর ব্রাহ্মণ’ শুনেছেন? তাঁরা শূদ্র বর্ণ থেকে সরাসরি ব্রাহ্মণ পরিচয় পেয়েছেন পৌরহিত্যের জন্য।

ফর্মাল পুরোহিত হওয়া কি আবশ্যক? একেবারেই না। মনে ভক্তি নিয়ে উপাসনা করলে যে কেউ পুরোহিত হতে পারেন। জানেন কি, বৌদ্ধ এবং জৈন মতেও পুরোহিত আছেন এবং তাঁরা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত?

যারা রুদ্রপ্রয়াগ গেছেন, তাঁরা নিশ্চয় অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নদীর সঙ্গম স্থলের মূল মন্দিরে নারী পুরোহিত দেখে থাকবেন। আমি বহুবার গেছি। পুরোহিত পালটেছেন, কিন্তু নারী পুরোহিতের রীতি পাল্টায়নি। ২০২১- গতবছর শেষবার গেছি আপাতত। ২০০৭ এবং বর্তমান নারী পুরোহিতের ছবি দিলাম।

তো আধুনিক নারী পুরোহিত যারা বিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা কি জানেন, বিয়ের মন্ত্র কার? যাঁদের তাঁরা বিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের কি জানাচ্ছেন বিয়ের মন্ত্র কার? জানালে ভালো। না জানালে, প্রশংসনীয় কাজেও ঘাটতি থেকে গেলো। সেটা মেরামত করে নিলে আরও ভালো।

না জানলে জেনে রাখুন, বিয়ের মন্ত্রের অন্যতমা মন্ত্রদাত্রী হলেন নারী ঋষি ‘সূর্যা সাবিত্রী’ – যার কোন গোত্র নেই। যিনি অগোত্র বা গোত্রহীনা। তাৎপর্য ভেবে দেখুন। এনার মন্ত্র পড়েই হিন্দুরা শাস্ত্রমতে বিবাহ করে। অর্থাৎ বিয়ে হচ্ছে নারী ও গোত্রহীনা ঋষির মন্ত্র পড়ে। যে পবিত্র সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে, তার মধ্যে এই অসীম উদারতার বার্তা থেকে যাচ্ছে।

ঋগ্বেদে আরও দুইজন গোত্রহীনা বা অগোত্র ঋষিকার নাম – অর্থাৎ ‘ভূমিকন্যা’ – (আরও আছেন) –
১। সরমা দেবশুনী – ১০.১০৮.২ ইত্যাদি [এনার ‘কুকুর’ টোটেম ভাবতে পারেন]
২। সর্পরাজ্ঞী – ১০.১৮৯ [এনার ‘সাপ’ টোটেম’ ভাবতে পারেন]

ঋগ্বেদ রক্ত সম্পর্কের থেকেও শ্রদ্ধার সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছে বেশী। জীবন সত্য বোঝা এবং উপলব্ধি করাই ‘বেদ’। ঋষিরা তার উপায় বলেছেন – ‘শ্রদ্ধা’। ঋগ্বেদের অন্যতম বার্তা – ‘শ্রদ্ধা’। সমস্ত মানুষ জীব জড় – সর্বভূতে শ্রদ্ধা। তা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছে ঋগ্বেদের ‘শ্রদ্ধা সূক্ত’ (১০.১৫১)। ঋগ্বেদে আপাতভাবে আলাদা আলাদা ঋষি পরিবার, আলাদা গোত্র। কিন্তু সে শুধুই সামাজিক আইডেন্টিটি। ঋষিরা শ্রদ্ধা দিয়ে সে আইডেন্টিটির বর্ডার ভেঙ্গে দেন। তাই দেখা যায় (দুটি মাত্র উদাহরণ দিলাম) –
১। ঋষি নোধস গৌতম (অঙ্গিরা) ভৃগুকে মানবজাতির মধ্যে প্রথম অগ্নি প্রতিষ্ঠাকারী হিসাবে স্বীকার করেছেন; এবং অঙ্গিরা-গৌতমের পুত্র নোধা ঋষি ভৃগুকে ‘মহিমান্বিত পুরোহিত’ হিসাবে স্বীকার করেন
২। ঋষি শক্তি-পুত্র পরাশর (বশিষ্ঠ) আঙ্গিরাকে তাঁর পূর্বপুরুষ (“আমাদের পিতামহ”) হিসাবে গণ্য করেন এবং একই সূক্তের ৪র্থ ঋকে পরাশর নিজের পরিচয় দেন ভৃগু

ব্যাসের অন্যতম আদর্শ এই বৈদিক মতাদর্শের পুনর্জন্ম খোঁজা – বসুধৈব কুটুম্বকম (সমগ্র বিশ্ব এক পরিবার) (মহা উপনিষদ ৬.৭১)। সেই জন্যই, ব্যাসের সম্পাদিত বেদ সংকলনে, অ-গোত্র-অনুষঙ্গী ঋষি এবং ঋষিকা রয়েছেন।

গোত্র পরিবর্তন কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। আমরা আলোচনা করলাম, মূলত চার ভাবে –
১। গুরুর গোত্র পরিচয় নেয়া
২। স্বেচ্ছায় অন্য পরিবারের গোত্র নেয়া
৩। কোন গোত্র না নিয়ে কশ্যপ গোত্র নেয়া
৪। মায়ের নামে গোত্র পরিচয় ধারণ

এ ছাড়া, বিবাহে নারীর গোত্র পরিবর্তন হয়। নারী যে পরিবারে বিবাহ করলেন, সেই পরিবারের গোত্র পান। এটা কি পুরুষতান্ত্রিক শোনাচ্ছে? মানে, তেমন ভাবতে শেখানো হয়েছে? নারীর গোত্রান্তরের তাৎপর্য কি?

আগেই বলেছি, গোত্রহীনা বা অগোত্র নারী ঋষির মন্ত্র পাঠ করে বিয়ে নারীকে এই স্বাধীনতা অবশ্যই দেয় গোত্র বিষয়ে। কিন্তু প্রাচীনকালে এর অন্য উদ্দেশ্য ছিল। নারীর বিয়ে কম বয়সে হওয়ায় পতি গৃহই তাঁর গুরুগৃহ হত অধিকাংশ ক্ষেত্রে। সুতরাং পতির গোত্র নেয়ার মধ্যে গুরুর গোত্র নেয়ার তাৎপর্য থাকছে।

পতি গুরু – এই প্রস্পেক্টে এ যুগে অনেকের নারীবাদী কান কটকট করে উঠতেই পারে। সে কটকট অনেক ক্ষেত্রেই এতটা বাস্তবসম্মত কটকট যে এক্কেবারেই দ্বিমত নই [প্লাস, প্রাণের ভয় আছে!]। ঠিক আছে, তাঁদের মধ্যে কেউকেউ স্বামীকে সিঁদুর পরিয়ে স্বামীকে আপনার গোত্র গ্রহণে বাধ্য করুন। আমি ভোট দিতে রাজী, যদি গোত্রান্তরের তাৎপর্য বুঝে তা করেন, বা নিদেন পক্ষে ‘গোত্র’ শব্দটির তাৎপর্য বুঝে থাকেন। একটা প্রথা ভেঙ্গে বিপ্লবী হবেন, কিন্তু কার বিরুদ্ধে লড়াই – গোত্র খাবার জিনিস না কস্মেটিক্স জানবেন না – ব্যাপারটা কেমন ইয়ে ইয়ে মার্কা শ্যাডো ফাইট হয়ে যাবে না? গোত্র যদি ‘জুজু’ হয়, তাহলে জুজু বাস্তবিক না কাল্পনিক সেটুকু জানবেন না?

গোত্রকে যারা রক্ত সম্পর্ক ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছেন, ভেবে দেখেছেন কি পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং বৈদিক হিন্দু ধর্মে পবিত্র গণ্য বৈবাহিক সম্পর্ক মানেই কম্পালসরি রক্ত সম্পর্ক নয়? [ব্যতিক্রম সব কিছুরই আছে। Exception proves the rule]

বিবাহে নারীর গোত্রান্তর হয়, তখন নারী রক্ত সম্পর্কের না হয়েও সেই পরিবারের গোত্র পান। বিবাহে, নারীর কেন গোত্রান্তর হয়, পুরুষের কেন হয়না – এর উত্তর, কোন পরিবার যাতে তার গোত্র পরিচয় ‘বন্ধ দরজা’ করতে না পারে, বা কুক্ষিগত করতে না পারে, বা ‘গোত্র = রক্ত সম্পর্ক’ – এই ক্ষমতাতন্ত্র কায়েম করতে না পারে, তাই ‘বাইরের ব্যক্তি’ দ্বারা সেই ‘বন্ধ দরজা’ খোলার দায়িত্ব নারীকেই দিয়েছিলেন প্রাচীন ঋষিরা, কারণ নারীকেই তাঁরা উপযুক্ত মনে করেছিলেন। অর্থাৎ, বিবাহ সূত্রে কোন নারী অন্য কোন পরিবারে প্রবেশ করলে, সেই পরিবার তার গোত্র উদার করতে বাধ্য হবে কারণ সেই নারীকে সেই গোত্র দিতে তারা বাধ্য থাকবে। নারীর বিবাহ সূত্রে গোত্রান্তর আসলে গোত্র ব্যবস্থাকে উদার রাখার জন্য। আধুনিক বিচিত্র ইন্টারপ্রিটেসনে তার উল্টো মানে করা হয়েছে। তার কারণ এজেন্ডা। কোন পুরুষ কোন নারীকে বিবাহ করলে সেই নারীর পরিবারের গোত্র নিতে পারে না – এ আসলে পুরুষকে সীমাবদ্ধ করে রাখার জন্য।

আগেই বলেছি, গুরুর পরিচয়ে যে কোন সময়ে পুরুষ বা নারী তার গোত্র পরিবর্তন করতে পারতো। অর্থাৎ পুরুষের গোত্রান্তর সম্ভব ছিল বিদ্যা অর্জনের কারণে। ঋগ্বেদে এর উদাহরণ ঋষি গৃৎসমদ শৌনক। তিনি জন্মসূত্রে আঙ্গিরস গোত্র – শুনহোত্র আঙ্গিরসের বংশধর। তাঁর নাম ছিল গৃৎসমদ শুনহোত্র। পরে তিনি গোত্র পাল্টে ভৃগু গোত্র নেন। তাঁর নাম হয় গৃৎসমদ শৌনক। পুরাণেও এই গোত্র পরিবর্তনের প্রমাণ আছে। ব্রহ্ম পুরাণে (৯.৬৪-৬৮) আছে, শুনঃশেফ আগে ভার্গব গোত্র ছিলেন, পরে কৌশিক গোত্রের হন এবং বিশ্বামিত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র পরিচিত হন।

এতক্ষণের আলোচনায় যা দেখলাম, খুব আক্ষরিক গরু ছাড়া গোত্র শব্দে কেউ গরু পাবেনা। গোত্র আসলে পারিবারিক ইতিহাস রক্ষা। পারিবারিক ইতিহাস মানে রক্ত সম্পর্ক আবশ্যিক নয়। গুরুর পরিচয়ে এবং বিবাহ সূত্রে এবং অনাথ শিশু ইত্যাদি তৃতীয় ব্যক্তি কোন এক গোত্রের অন্তর্গত হতে পারে।

অনেক মুসলিম পুরুষ নিজের নামে মোহাম্মদ শব্দ রাখে। তা আসলে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের রীতি। হিন্দুরা এক ঋষিতে বিশ্বাসী নয়। তাই বহু ঋষির নামে বহু গোত্র। আধুনিক সাজতে গিয়ে যারা গোত্র নিয়ে কষ্টে আছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করা যাক, যারা শিক্ষিত বা নিজেদের শিক্ষিত বলে জানেন, তারা নিজের পারিবারিক হিস্ট্রি কয় পুরুষ জানেন? এদিকে শিক্ষিত হবার শর্ত হিসাবে হিস্ট্রি বইতে অন্য কারো পরিবারের বংশ তালিকা মুখস্থ করেছেন। ব্যাপারটা লজিকাল? লজিকাল মনে হলে কেন লজিকাল? মনে না হলে, কেন নয়?

গোত্রের সাথে caste বর্ণ বা জাতের কোন সম্পর্ক নেই। একই গোত্র যে কোন caste ও বর্ণ হতে পারে। আজকের জাত পরিচয় জমাট বেঁধে static হয়েছে ইংরেজদের জন্য। প্রত্যেক ধর্ম শাস্ত্রের বিধান, পাঁচ বা সাত পুরুষে প্রত্যেক মানুষের বর্ণ পরিচয় পাল্টাবে। হয় প্রমোশন, নয় ডেমোশন। কিন্তু বর্ণ পাল্টালেও গোত্র এক থেকে যাবে। অর্থাৎ ‘উচ্চ বর্ণ’ বা ‘নিম্ন বর্ণ’ কারোর স্ট্যাটাস চূড়ান্ত নয়। গুণ দেখাও, কর্ম করো, পরিচয় পাও।

গোত্র হল পারিবারিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার বৈজ্ঞানিক মেথড। যাদের কথাটা মনে ধরবে না, তারা গোত্র ব্যবস্থার একটা বিকল্প ব্যবস্থা প্রস্তাব করে দেখান দিকি যার দ্বারা পারিবারিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্মরণে রাখা যায়?

যারা গোত্র ব্যবস্থা ব্যাকডেটেড মনে করে স্মরণে রাখতে চান না, ওয়েলকাম। আগেই বলেছি আমি গণতন্ত্রে আর সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তাই আমার এক্কেবারেই আপত্তি নেই। কিন্তু শিক্ষিত হবার শর্ত হিসাবে অন্যের বংশপরিচয় – অমুক বংশ তমুক বংশ – মুখস্থ করছেন আর নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য জানে না, নিজের সাত পুরুষের নাম তো দূর অস্ত, অধিকাংশ দাদুর বাবার নাম জানেন না, এর মধ্যে কেন গড়মিল লাগছে না বা ব্যাপারটা অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না, কেন বিভিন্ন রাজবংশের নাম মুখস্থকে রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য তৈরির এজেন্ডা মনে হচ্ছে না, সে ব্যাখ্যা দেবার দায়ও আপনার রইলো। সে ব্যাপারটা কি করে ‘ফ্রন্টডেটেড’ হল তার তাহলে ব্যাখ্যা দিন।

ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৯.৮.২২
সোমবার
তথ্যসূত্র

Brereton, Joel P. & Jamison, Stephanie W. 2014 (trans.). The ṚgVeda: The Earliest
Religious Poetry of India. Volume Set. 1-3. Oxford University Press

Gonda, Jan. 1963. The Vision of the Vedic Poets. Mouton & Co., The Hague

Kṛṣṇadvaipāyana Vyāsa. Mbh. Critical Edition. 1919-1966. Pune: Bhandarkar Oriental
Research Institute. ‘The Machine-Readable Text of the Mbh’ Based on the Poona
Critical Edition, Produced by Muneo Tokunaga, Kyoto, Japan 1883-1896.
Mahābhārata. Trans. into English Prose by Kisari Mohan Ganguli. Scanned at sacred-texts.com, 2003

Mahadevan, Thennilapuram P. 2011. The Ṛṣi index of the Vedic Anukramaṇī system and the Pravara lists: Toward a Pre-history of the Brāhmaṇas. Electronic Journal of Vedic Studies, Volume 18 (2011), Issue 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.