ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ১৩৫ তম জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষে ‘বঙ্গ ভাষার প্রতি’ সভা করল সংস্কার ভারতী ও সূত্রধর

২৭ শে নভেম্বর,কলকাতা। আজ কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাস ভবনে ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ(দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত)’ এবং ‘সূত্রধর’ প্রকাশনীর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হল বাংলা ভাষা- সংস্কৃতির কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর ১৩৫ তম জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষে এবং ‘বাংলা ভাষা’-কে ধ্রুপদী মর্যাদায় অভিহিতকরণের ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি শুভেচ্ছা- জ্ঞাপনার্থে ‘বঙ্গ ভাষার প্রতি’ সভা।

সংস্কার ভারতীর ধ্যেয়গীত-এর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়।এরপর বক্তব্য রাখেন নীলাঞ্জনা রায়। তিনি বলেন, “ভারত সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়ে আমাদের দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলার সাথে হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে আমরা আমাদের ভাষার আদতে ক্ষতি করছি। বাঙালির সন্তান বাংলা ভাষায় লেখাপড়া শিখুক। বাংলা ভাষাতে লেখাপড়া ও লেখালেখি করে আমাদের দেশের মনীষীরা এই ভাষার গৌরব বাড়িয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব নিয়ে সেই সম্মান বজায় রাখতে হবে।”

এরপর ড. কল্যাণ চক্রবর্তী বলেন,”বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করা যায় না এমন মতামত অনেকেই দিয়ে থাকেন। কিন্তু আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু প্রভৃতি লেখকরা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় জোর দিয়েছেন। আমাদের উচিত যথাযথ পরিভাষা তৈরি করে অন্যান্য ভাষার বই গুলিকে বাংলায় অনুবাদ করা,যাতে বাঙালির সন্তান বাংলা ভাষায় যথাযথ শিক্ষা লাভ করতে পারে।”

আজকের অনুষ্ঠানে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাঙালিয়ানা নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমতা রামসদয় কলেজের অধ্যাপক ড. অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,আজকের বাঙালির ঘোর দুর্দিনে সুনীতিকুমারের মতো মানুষই আদর্শ দিশারীর ভূমিকা নিতে পারেন, যিনি বাঙালি হয়েও হিন্দুয়ানির প্রশ্নে কখনো কোথাও আপস করেননি। আবার ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্যের প্রতিও তাঁর অগাধ আস্থা। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ‘যত মত তত পথ’কে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সুনীতিকুমারের তথাকথিত সেকুলারিজমের প্রতি তীব্র বিরোধিতার কথাও ড. বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

ড. আমিন বলেন,”বাংলা ভাষার ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার বিবর্তন, গত হাজার বছর ধরে বঙ্গ সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি ও বাঙালি জাতিসত্ত্বার বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণার পথ প্রশস্ত করবে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে গত কয়েক দশক ধরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটছে, তার প্রকৃতি অবশ্যই চিরন্তন বঙ্গসংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেক্ষেত্রে এই স্বীকৃতি চিরায়ত ও লোকায়ত বঙ্গসংস্কৃতির পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ও দিকচিহ্ন।”

সূত্রধর প্রকাশনীর কর্মাধ্যক্ষ সুমন ভৌমিক বলেন,”এই অনুষ্ঠানে বাঙালির নিজস্ব সত্ত্বার চারিত্রিকতার সন্ধানে আমরা নিয়োজিত হতে চাই। যে দুখিনী বর্ণমালা থেকে মুখ ফিরিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার জড়ত্ববাদী প্রকরণ আচরণে অভ্যস্ত হওয়ার একটি অসৎ ক্রিয়ায় এই সমাজ মেতে উঠেছে, তার বিপ্রতীপে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা সংস্কৃতি – ত্রিবিধ জাড়নে আমরা জাড়িত হতে চাই। তাই এই ঘোর অসময়ে আমাদের এহেন সাংস্কৃতিক অভি প্রয়াস।”

ড. সরূপ প্রসাদ ঘোষ বলেন,”হিন্দু বাঙালি নিজেরাই আজকাল বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বাংলা ভাষায় বেশি কথা বলে বাংলা ভাষী মুসলিমরা। বাঙালির ছেলে মেয়েদের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে শহরের অধিকাংশ মানুষ ভর্তি করেন না। গ্রামের দিকেও দিন দিন তা বাড়ছে। নিজের ভাষার চর্চা যদি বাঙালিরা নিজেরা না করে তাহলে অন্য কেউ করে দেবে না। আগে নিজের সন্তানদের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়াতে হবে। নিজেরা সব জায়গায় বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে হবে। তবেই আমাদের ভাষা বেঁচে থাকবে।”

আজকের এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ(দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত)’-এর ‘সাহিত্য বিধা প্রমুখ’ মিলন খামারিয়া বলেন,”সংস্কার ভারতীর সাহিত্য বিধা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করে চলেছে। বাংলা ভাষার সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেই সাহিত্যকে ভারত তথা বিশ্বের মানুষের কাছে অনুবাদ করে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা চাই বিশ্ববাসী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আরও বেশি বেশি করে জানুক এবং তার রসাস্বাদন করুক। এই ভাষায় লিখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছেন, বাঙালির সন্তান যেন তা না ভুলে যায়। বাঙালির সন্তান যদি বাংলা ভাষার চর্চা না করে তাহলে সে দু:খের আর সীমা নেই। আমি আশাকরি ধীরে ধীরে বাঙালি আবারও বাংলা ভাষায় লেখাপড়ার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা বেশি করে করবে। সংস্কার ভারতী সেই উদ্যোগই নিয়েছে।”

অনুষ্ঠানে একক গীত পরিবেশন করেন সুনীতা রায় কর্মকার, অনিমা দাস মজুমদার ও তনুশ্রী মল্লিক। পারমিতা নিয়োগীর নির্দেশনায় সমবেত গীত পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন সূত্রধরের কর্মাধ্যক্ষ সুমন ভৌমিক।

এই অনুষ্ঠানে ‘সূত্রধর’ প্রকাশনী দ্বারা প্রকাশিত প্রফুল্ল চন্দ্র রায়-এর ‘বঙ্গভাষায় বিজ্ঞানচর্চা’, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর ‘ইতিহাস-সংস্কৃতি-শিল্প প্রসঙ্গে’ এবং স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দ-এর সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষার অনুষঙ্গে’ – বই তিনটি উন্মোচিত হয়।

পারুল খামারিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.