চলে গেলেন আধুনিক ORS এর আবিস্কারক ডাঃ দিলীপ মহলানবিশ
যার তৈরি ORS বাঁচিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। বাঁচিয়েছে গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া মড়কের হাত থেকে।
ঢাকা কলেরা রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশে তখন ORT (Oral Rehydration Therapy) নিয়ে গবেষণা তখন তুঙ্গে। এই ORT র জনক হলেন আমেরিকান আর্মির ডাক্তার ক্যাপটেন ফিলিপ। ১৯৬৪ সাল। গ্লুকোজ আর খাদ্যলবনের সলিউশন ডিহাইড্রেশনে আক্রান্ত সেনাকর্মীদের উপর প্রয়োগ করে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু সংক্রমন সেভাবে আটকাচ্ছে না। কিছু সময় পর আবারো আক্রান্ত হচ্ছে কেউ কেউ। সবাই না। একটা সময় পর একই ব্যক্তির উপর বারবার ORT প্রয়োগ করলে শেষের দিকগুলোকে তেমন সাড়া মিলছে না। ঢাকা মেডিকেলের ডাঃ দিলীপ মহালনবীশ পরীক্ষামূলকভাবে মিশ্র লবনে দুটি আরো উপাদান জুড়ে দিলেন। সবমিলিয়ে উপাদানগুলো তেমন কিছু নয়। গ্লুকোজ, খাদ্যলবন, পটাশিয়াম ক্লোরাইড আর সোডিয়াম সাইট্রেট। নাম দেওয়া হল ইলেকট্রল। দেখা গেল জলে মিশিয়ে খাওয়ালে ডিহাইড্রেশন থেকে মুক্তি মিলছে। ডায়েরিয়া, জিয়ার্ডিয়া, আমাশা, আন্ত্রিক বিভিন্ন পেট খারাপে বেশ কাজ দিচ্ছে। ১৯৬৫-৬৬ হবে।
১৯৭১… ও পারে মুক্তিযুদ্ধ, এ পারে উদ্বাস্তু স্রোত। শিকড়-ছেঁড়া লাখ লাখ মানুষ অস্থায়ী শিবিরে আক্রান্ত হতে লাগল কলেরায়। ক্রমশ মহামারি। বনগাঁ সীমান্ত জুড়ে পথেঘাটে মানুষের লাশ। ভয়ঙ্কর সেই মৃত্যুমিছিলে ত্রাতা হয়ে এলেন বছর সাঁইত্রিশের বাঙালি চিকিৎসক, দিলীপ মহলানবিশ। আক্রান্তদের মধ্যে প্রয়োগ করলেন ওআরএস। সাড়া পেলেন ম্যাজিকের মতো। দ্রুত নামিয়ে আনা গেল মৃত্যুর হার। পাশাপাশি সংক্রমণ রুখতে চলল ওষুধ। নুন, চিনি, বেকিং সোডার সহযোগে এই স্যালাইন রোগীদের দেওয়ার পর সুস্থতার পথে এগিয়েছিলেন তৎকালীন হাজার হাজার মানুষ। এই কর্মকাণ্ডে ছিল প্রবল ঝুঁকি। তখনো ওআরএসকে স্বীকৃতি দেয়নি বিশ্বের স্বাস্থ্য নিয়ামক সংস্থা। তবুও সেই ঝুঁকিয়ে নিয়ে বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন দিলীপ মহালানবীশ। সরকারি মেডিকেল টিমের অনেকে বাধা দিচ্ছিলেন। আপত্তির কারণ ওই স্বীকৃতির ছাপ পড়েনি ORS-এর ওপর। মড়ককে পরাস্ত করে এল জয়। অবশেষে আর আই ভি-র (ইন্ট্রাভেনাস) পরিবর্ত হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেল চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসের অমর অবদান ORS।
জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। ১৯৫৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাশ করে সেখানেই শিশু বিভাগে ইনটার্নশিপ শুরু করেন দিলীপবাবু। ১৯৬০-এ লন্ডনে চালু হল ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, প্রচুর ডাক্তারের চাহিদা তখন সেখানে। আবেদন করলেন, সুযোগও এল। লন্ডনে ডিসিএইচ করলেন, এডিনবরা থেকে এমআরসিপি। কুইন এলিজ়াবেথ হসপিটাল ফর চিল্ড্রেন-এ রেজিস্ট্রার পদে যখন যোগ দিলেন এই বাঙালি ডাক্তার, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮। এই পদে তিনিই প্রথম ভারতীয় । পরে আমেরিকায় জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির মেডিকেল কেয়ার ফেলো পদে যোগ দিলেন। তখন এই প্রতিষ্ঠানের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল বেলেঘাটার আই.ডি. হাসপাতালে। কলেরা আক্রান্তদের চিকিৎসা হত এখানে। ১৯৬৪-তে দেশে ফিরে যোগ দিলেন সেখানে। এখানেই শুরু করেন ওআরএস ও স্পেশাল মেটাবলিক স্টাডি নিয়ে কাজ। হাতে-কলমে সাফল্য পাচ্ছিলেন, কিন্তু গবেষণাপত্র বার করা হয়ে ওঠেনি। তার পরেই ’৭১-এর ওই ঘটনা। জনা আটেক পরিচিত সাহসী ছেলেকে নিয়ে ছুটলেন বনগাঁ সীমান্তে। সঙ্গীরা সবাই সাধারণ মানুষ।
দু’মাস অক্লান্ত কাজে সাফল্য এল। বিশদ তথ্য দিয়ে পেপার লিখলেন এবার। ১৯৭৩-এ জন হপকিনস মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হল তা। বিখ্যাত ‘ল্যান্সেট’ পত্রিকা স্বীকৃতি দিল সেই প্রকাশনাকে। খবর ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ সসম্মানে ডেকে নিল তাঁকে। ১৯৮০-র মধ্যপর্ব থেকে ১৯৯০-এর প্রথম পর্ব পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়রিয়া ডিজ়িজ় কন্ট্রোল প্রোগ্রাম-এর মেডিক্যাল অফিসার নিযুক্ত হলেন তিনি। ১৯৯০-এ বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়ারিয়াল ডিজ়িজ় রিসার্চ-এর ক্লিনিক্যাল সায়েন্সের ডিরেক্টর ছিলেন। ১৯৯৪-এ রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত ছিলেন পার্ক সার্কাসে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এও। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান।
বিধানচন্দ্র রায়, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, নীলরতন সরকার, মহেন্দ্রলাল সরকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নামগুলির সাথে বাঙালি যতটা পরিচিত, দিলীপ মহালনবীশ নামটি ততটা পরিচিত হয়তো নয়। তাঁকে পদ্মভূষণ, বঙ্গভূষণে বিভূষিত করার কথা মনে পড়েনি কারুর। কিন্তু তাঁর পেশাজগতে তিনি এক অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রই বটে।
আজ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে এই মহাত্মা চিকিৎসক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন নক্ষত্রলোকে। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। সাধারণ মানুষের জন্য তার এই কাজ সাধারণ মানুষের সামনে আসুক।
তথ্য সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা