ন্যাশনালিজম নয় , রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রাষ্ট্রবাদের পক্ষে

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘নেশন’ , ‘ন্যাশনালিজম’ , ‘নেশন-স্টেট’ ‘স্টেট-নেশন’ ইত্যাদি শব্দ গুলি বহুল প্রচলিত।একটি জনগোষ্ঠী যখন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে আশ্রয় করে একসাথে বসবাস করে এবং তাদের মধ্যে একসাথে থাকার বাসনা ও নিজেদের ঐক্যকে রক্ষা করার চেতনা তৈরি হয় তখন তাকে ‘নেশন’ বা ‘জাতি’ বলা যায়। সেই ‘জাতি’ যদি একটি সার্বভৌম রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন গঠনতন্ত্র অর্থাৎ ‘স্টেট’ এর মধ্যে থাকে তাহলে তাকে ‘Nation-state’ বলে।আবার একটি ‘State’ এর মধ্যে যদি একাধিক জনগোষ্ঠী নিজেদের জাতিগত পরিচয় অক্ষুন্ন রেখে বসবাস করে তাহলে তাকে ‘state-nation’ বলা হয়।প্রত্যেক ভাষার সঙ্গে তার সংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে বা বলা যায় কোনো শব্দের অর্থ কে বুঝতে তার জন্মদাত্রী সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে হবে।’প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ সভ্যতার তুলনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘নেশন’ শব্দ আমাদের ভাষায় নাই,আমাদের দেশে ছিল না। সম্প্রতি য়ুরোপীয় শিক্ষাগুণে ন্যাশনাল মহত্বকে আমরা অত্যাধিক আদর দিতে শিখিয়াছি। অথচ তাহার আদর্শ আমাদের অন্তঃকরণের মধ্যে নাই।ইউরোপীয় দার্শনিকগণ জাতি গঠনের মূল হিসেবে কখনো ভাষাগত ঐক্যের কথা বলেছেন ,কখনো রাজতন্ত্র কে ‘জাতি’ গঠনের আধার বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
ভারতবর্ষের ভাষাগত বিভিন্নতা , আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিভিন্নতা বরাবরই তাদের আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল। কিন্তু তারা ইউরোপীয় ‘জাতি’ গঠনের তত্ত্ব দিয়ে ভারতবর্ষ কে ব্যাখ্যা করেছেন।তারা ইউরোপীয় ‘রিলিজিয়ন’ এর চশমা দিয়ে ভারতবর্ষ কে দেখতে গিয়ে ভারতবর্ষের ভাষা-পোশাক-আচার এর বিভিন্নতার মধ্যে থাকা ঐক্যসূত্র কে চিনতে পারেন নি।
ইউরোপীয় দেশগুলির লিখিত বা লোককথায় বা উপাসনা পদ্ধতিতে(Religion) অতীতকালের যে কাহিনী পাওয়া যায় ভারতবর্ষের শাস্ত্রে তার চেয়ে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা, শিল্প ,বিজ্ঞান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় এবং এই সমস্ত জ্ঞানের ইতিহাস লিখতে গেলে ভারতবর্ষ কে প্রথম অধ্যায়েই স্থান দিতে হয়। ইউরোপীয় দেশগুলি পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করার কয়েক হাজার বছর পূর্বেই ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সীমারেখা বিষ্ণুপুরাণসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে, কাব্যে সুস্পষ্ট রূপে বর্ণিত হয়েছে। এই অবস্থায় ইউরোপীয় জাতির ঐক্যসূত্র অনুযায়ী ভারতের জাতীয়তাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে তা দুর্বোধ্য মনে হওয়া স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ'(আত্মশক্তি) প্রবন্ধে এই ব্যর্থতার কথা বলেছেন এইভাবে….
“এই লোকচিত্তের একতা সব দেশে এক ভাবে সাধিত হয় না। এইজন্য য়ুরোপীয়ের ঐক্য ও হিন্দুর ঐক্য একপ্রকারের নহে, কিন্তু তাই বলিয়া হিন্দুর মধ্যে যে একটা ঐক্য নাই, সে কথা বলা যায় না। সে-ঐক্যকে ন্যাশনাল ঐক্য না বলিতে পার– কারণ নেশন ও ন্যাশনাল কথাটা আমাদের নহে, য়ুরোপীয় ভাবের দ্বারা তাহার অর্থ সীমাবদ্ধ হইয়াছে।”

ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের অবধারণা(Concept) মূলত রাজনৈতিক ও সার্বভৌম ক্ষমতা ভিত্তিক। ভারতবর্ষের ‘জাতীয়তাবাদ’ এর ভিত্তি সংস্কৃতি যা তার ভাষা-মত-পরিধান এর বিভিন্নতাকে ছাপিয়ে গেছে এবং এই সংস্কৃতির মূল নিঃসন্দেহে তার ‘ধর্ম’ , ‘হিন্দুত্ব’ এর মধ্যে প্রোথিত।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে এই ধারণাটিকেই সুসংবদ্ধ করেছেন…
“হিন্দুধর্ম সমাজের প্রত্যেককে পঞ্চ যজ্ঞের দ্বারা ঋষি,পিতৃপুরুষ ,সমস্ত মনুষ্য ও পশুপক্ষীর সহিত আপনার মঙ্গলসম্বন্ধ স্মরণ করিতে প্রবৃত্ত করিয়াছে। ইহা যথার্থরূপে পালিত হইলে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের পক্ষে , সাধারণভাবে বিশ্বের পক্ষে মঙ্গলকর হইয়া উঠে।
……..ভারতবর্ষের মধ্যে একটি বাঁধিয়া তুলিবার ধর্ম চিরদিন বিরাজ করিতেছে। নানা প্রতিকূল ব্যাপারের মধ্যে পড়িয়াও ভারতবর্ষ একটা ব্যবস্থা করিয়া তুলিয়াছে ,তাই আজও রক্ষা পাইয়াছে”।
বিগত ২০০০ বছরে ইউরোপের ও আরবের জাতীয়তা একটিমাত্র উপাস্য, একটিমাত্র ভাষা, এক রাজার অধীনতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে গিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসকে রক্তাক্ত করেছে।ইউরোপে চার্চ ও রাজতন্ত্রের সঙ্ঘাতের রফাসূত্র হিসেবে ‘সেক্যুলারিজম’ এর জন্ম হয়েছে। তবুও ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই রিলিজিয়নের প্রতিনিধিদের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে স্থান দেওয়া হয়েছে।ইউ কে(UK) এর ‘হাউস অফ লর্ডস’ এ ইংল্যান্ডের বিশপদের জন্য ২৬ টি আসন সংরক্ষিত আছে।এমনকি ২০০১ এ ইংল্যান্ড সরকার আরো একধাপ এগিয়ে চার্চ-রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নকরণ কে দুর্বল করতে হাউস অফ কমনস্’ এ চার্চের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে House of Commons (Removal of clergy disqualification)Act পাশ করে।
‘আব্রাহামিক রিলিজিয়ন’ (খ্রীস্টিয় মত , ইসলাম) তাদের মতে ‘বিশ্বাসী’ ও ‘অবিশ্বাসী’ এইভাবে মানবসমাজকে ভাগ করে দেখে। ‘বিশ্বাসে’র উপরে বিভেদের প্রাচীর নির্মাণ করে বিশ্বকে শান্তি দেওয়া যে যায় না, ইতিহাসই তার প্রমাণ।
ভারতবর্ষে রাজা শাসন কার্য পরিচালনা ও অপরাধীদের শাস্তি দানের ক্ষেত্রে সর্বময় কর্তা হলেও রাজা নিজে সমাজের প্রচলিত নিয়ম নীতি অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য ছিলেন। সমাজের কল্যাণে রাজা কর্তব্য পালন করলে তিনি ধার্মিক হিসেবে পরিচিত হতেন অধার্মিক রাজাকে সমাজের সিংহাসনচ্যুত করার উদাহরণও আছে। যেমনটি আমরা দেখতে পাই চাণক্যের মার্গদর্শনে নন্দরাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের উত্থানে। তাই ভারতবর্ষের ঐক্যের মূলে সমাজ আর সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হতো তা হল ‘ধর্ম’ । এই ধর্ম ইউরোপের ‘রিলিজিয়ন’ নয় যার একটিমাত্র উপাস্য ও একটি মাত্র ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল। কবিগুরু এই পার্থক্যকে স্পষ্ট করে বলেছেন — “পলিটিক্‌স্‌ এবং নেশন কথাটা যেমন য়ুরোপের কথা, ধর্ম কথাটাও তেমনি ভারতবর্ষের কথা। পলিটিক্‌স্‌ এবং নেশন কথাটার অনুবাদ যেমন আমাদের ভাষায় সম্ভবে না তেমনি ধর্ম শব্দের প্রতিশব্দ য়ুরোপীয় ভাষায় খুঁজিয়া পাওয়া অসাধ্য। এইজন্য ধর্মকে ইংরেজি রিলিজন রূপে কল্পনা করিয়া আমরা অনেক সময়ে ভুল করিয়া বসি”।—-(ধম্মপদং , ভারতবর্ষ )
তাই ভারতবর্ষের শাসক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সমাজের শিক্ষা ,স্বাস্থ্য , বিচারব্যবস্থা,জীবনপদ্ধতির গতি মন্থর হয় নি বা আপন প্রয়োজনের তাগিদে রাজার মুখাপেক্ষী থাকে নি।রাজ সিংহাসনের ব্যক্তিটি পরিবর্তন হলেও তার প্রভাব সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নি কারণ সমাজের ধর্মে কখনোই হস্তক্ষেপ হয় নি। “আমাদের সমাজের গোড়াকার জিনিসগুলি কোনো রাজক্ষমতার স্বেচ্ছাকৃত সৃজন নহে। আমাদের জনসাধারণ নিজের জীবনকে এইরূপ শরীরতন্ত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। কোনো গবর্মেণ্ট্‌ তাহাকে গড়ে নাই, কোনো গবর্মেণ্ট তাহার বদল করিতে পারে না। এক কথায় আইন জিনিসটা উপর হইতে আমাদের মাথায় চাপানো হয় নাই–তাহা আমাদের জাতিগত জীবনের মূলসূত্র, এবং যাহা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে তাহাই ব্যবহারে প্রবর্তিত হইয়াছে।”—– ‘চীনেম্যানের চিঠি’ প্রবন্ধে বলেছেন কবিগুরু।
‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের এই ভাবেরই প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইউরোপের ‘Nationalism’ এর কেন্দ্রে ‘Religion’ ও ‘King’ এর যে সার্বভৌম শক্তি উপর থেকে সমাজের জীবনপদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রিত করার যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি কবিগুরু বীতস্পৃহ ছিলেন। কবিগুরু নিজের জীবদ্দশায় দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছিলেন আর ইউরোপের ভবিতব্য কবি তার আগেই বলেছিলেন ” —– “য়ুরোপীয় সভ্যতার মূলভিত্তি রাষ্ট্রীয় স্বার্থ যদি এত অধিক স্ফীতিলাভ করে যে, ধর্মের সীমাকে অতিক্রম করিতে থাকে, তবে বিনাশের ছিদ্র দেখা দিবে এবং সেই পথে শনি প্রবেশ করিবে।
স্বার্থের প্রকৃতিই বিরোধ। য়ুরোপীয় সভ্যতার সীমায় সীমায় সেই বিরোধ উত্তরোত্তর কণ্টকিত হইয়া উঠিতেছে। পৃথিবী লইয়া ঠেলাঠেলি কাড়াকাড়ি পড়িবে, তাহার পূর্বসূচনা দেখা যাইতেছে”।(প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা)
আপন রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ,আপন জাতিগত উৎকর্ষতার মিথ্যা অহংকারে ইউরোপীয় নেশনগুলি পৃথিবীতে প্রাণহানি দিয়েছে আর ভবিষ্যতে এই ধরনের যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ভান্ডার বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা দিয়েছে। কখনো ‘state-religion’ কে বিশ্বব্যাপী প্রসার ,কখনো আপন কলকারখানার উদ্বৃত্ত দ্রব্যের বাজার খুঁজতে আবার কখনো আপন প্রয়োজনীয় সামগ্রির খোঁজে ইউরোপীয় ন্যাশনালিজম বিশ্বশান্তির অন্তরায় হয়েছে। ঔপ্যনিবেশিকতার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজ-সংস্কৃতির, ভাষার বিলুপ্তির কারণ হয়েছে।
কবিগুরু ব্যক্তি মানুষকে শুধুমাত্র একটি কৃত্রিম মানচিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ , আপন রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংকীর্ণতায় বন্দি মানুষ হিসেবে দেখেননি। তিনি চেয়েছিলেন মানবতার সীমারেখা মানচিত্রের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে দেশের মানুষকে বিশ্ব মানবে পরিণত করবে আর তখনই মানবত্মা বিশ্বাত্মার সঙ্গে এক হয়ে সত্যিকারের স্বাধীন হবে। কবিগুরুর এই চিন্তা সম্পূর্ণভাবে উপনিষদের দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা ভারতীয় সংস্কৃতির আধার।

জার্মান দার্শনিক কান্টের মাধ্যমে যে মানবতাবাদের প্রথম ছোঁয়া পেলো ইউরোপ, তা ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়ালেও রিলিজিয়ন আর ঔপ্যনিবেশিকতার প্রভাবে সেই মানবাতাবাদ থেকে উপনিবেশের মানুষ বঞ্চিত থেকেছে।
ইউরোপ , আরব ও এশিয়ার অন্যান্য দেশসহ বাকি বিশ্বের শুধুমাত্র আপন রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অন্ধ হয়ে ভোগের পথে যাত্রার অভিমুখ পরিবর্তন করানোর জন্যই সভ্যতার দেবী ভারতবর্ষের স্বার্থত্যাগের দর্শনকে সুরক্ষিত রাখা ও বিশ্বমঞ্চে বারবার ধ্বনিত করার জন্যই উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে সমুদ্রে পরিবেষ্টিত এই তপোভূমিকে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা হিসেবে শাশ্বত জীবন দিয়েছে। ‘কারাকাহিনী’তে কবিগুরুর শ্রদ্ধেয় ঋষি অরবিন্দ ‘উত্তরপাড়া অভিভাষণে এই কথাটিই বলেছেন– “….হিমালয় ও সমুদ্রের যারা পরিবেষ্টিত এই উপদ্বীপে নিরালায় এই ধর্ম্ম গড়ে উঠেছে , এই পুণ্য ও প্রাচীন ভূমিতে আর্য্যজাতির উপর ভার দেওয়া হয়েছিল এই ধর্ম্মকে যুগ যুগান্তরের ভিতর দিয়ে রক্ষা করতে ।
….এইটিই হচ্ছে একমাত্র ধর্ম্ম যা মানবজাতিকে ভাল করে বুঝিয়ে দেয় , ভগবান আমাদের কত নিকট , কত আপনার , মানুষ যত রকম সাধনার দ্বারা ভগবানের দিকে অগ্ৰসর হতে পারে সবই এর অন্তর্গত।”
‘সনাতন ধর্ম্ম’ কে ঋষি অরবিন্দ ভারতবর্ষের জাতীয়তা বলেছেন।তারও আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতের মাধ্যমে সনাতন ধর্মের মাতৃরূপকে রাষ্ট্রের সঙ্গে এক করে দেখিয়েছেন। বিশ্বকবি নিজে ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘বন্দেমাতরম’ আবৃত্তি করেন।কবি ১৮৯৬ সালেই রচনা করেন ‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী, মা’ গান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রাক্বালে স্বদেশ পর্যায়ের প্রত্যেক গানে দেশবাসীকে, দেশমাতার নামে এক হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাই, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের জাতীয় ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র ধর্ম আর সনাতন ধর্ম ও ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয়তা অভিন্ন। ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রবাদ কবিগুরুর চেতনায় সমার্থক যার সঙ্গে ইউরোপীয় ‘ন্যাশনালিসম্’ এর কোনো মিল নেই। ভারতবর্ষের ঐক্যকে রাষ্ট্রবাদ বা জাতীয়তাবাদ যে নামেই ডাকা হোক না কেনো তাঁর মূল ভারতের সনাতন সংস্কৃতিতে। বিপিন চন্দ্র পাল থেকে শুরু করে বীর সাভারকার পর্যন্ত এই কথাটিকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন যে ভারতবর্ষ কে পূণ্যভূমি মনে করে যে ভারতীয়রা তারা এক ‘জাতি’ আর সেই ‘জাতি’র প্রাণভোমরা ‘বেদভূমি’ ভারতবর্ষ।
স্টেট রিলিজিয়ান এক বলে সমগ্র ইউরোপ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ন্যাটোর নামে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে এক হয়েছে বটে কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি ; আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ একদিকে ইউক্রেন কে নিজেদের দলে টানতে অস্ত্র সাহায্য করছে আর অন্যদিকে নিজেদের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে রাশিয়ার থেকে তেল ও গ্যাস কিনছে।
দুই স্বার্থের মাঝে দাঁড়িয়ে ইউরোপ শ্বাসরুদ্ধ হচ্ছে। যে রিলিজিয়ানকে ছড়িয়ে দিতে ইউরোপ জোটবদ্ধ হয়েছিল এখন তা দিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা শোনাতে পারছে না। আরব দুনিয়াতেও আমরা দেখতে পাই আব্রাহামিক রিলিজিয়নের অন্যরূপ ইসলামের নামে যে দেশগুলি গঠিত হয়েছে তাদের ভ্রাতৃত্বের বাণী ইসলামিক দেশগুলির আপন উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ইসলামিক দেশগুলির অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বিশ্ব-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ রাখতে তুর্কি, সৌদি আরব ,ইরান এক হলেও এদের মধ্যেও ইসলামিক দুনিয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে বিবাদ নতুন নয়।
এই আরব দুনিয়া হোক বা ইউরোপ নেশন বা ন্যাশনালিজম এর যে সূত্র এসব দেশে দেখা যায় তা শুধু নিজের স্বার্থের জন্যই কখনোই বিশ্বশান্তির পথ প্রশস্ত করেনি। বরং পাকিস্তানে, সিরিয়ায় ,ইরাকে আপন উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেই বিভিন্ন শাখার দ্বন্দ্বে বিশ্বের ইতিহাস রক্তাক্ত হচ্ছে। তাই স্টেটের আইনের মাধ্যমে যে সাম্য, যে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয় তা যেন রিলিজিয়নের মাটিতে উপর থেকে পুঁতে দেওয়া চারা গাছ যার ফলের ভাগ সারা বিশ্বের জন্য নয় , সেই গাছ সারাবিশ্বের আকাশের জন্য প্রাণবায়ু সৃষ্টি করে না।
অন্যদিকে ভারতবর্ষের ধর্মাশ্রিত ‘রাষ্ট্রবাদ’ ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার ,সমাজ ,রাজ্য, দেশকে আপন স্বার্থ ত্যাগের সোপান হিসেবে দেখেছে। কবিগুরু এই রাষ্ট্রবাদেরই জীবনভর পূজা করেছেন নিজের কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও বক্তৃতার মাধ্যমে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৩০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ করে তার বৈভব দেখে চকিত হয়েছিলেন কিন্তু সেই বৈভবের প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়ার আপন দেশবাসীর লক্ষ লক্ষ শবদেহের উপর। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ এর মধ্যে কাজাখের দুর্ভিক্ষে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মারা যায় , ইউক্রেনের হলডোমোর গণহত্যায় প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয় সোভিয়েত রাশিয়ায়। এরপরেও সোভিয়েত রাশিয়ার NKVD স্টালিনের নেতৃত্বে যে গণহত্যা (Great Purge) চালিয়েছিল তা সোভিয়েত রাশিয়ার লৌহ যবনিকা ভেদ করে কবিগুরুর চোখ-কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে নি , পৌঁছালে ১৯৪১ সালে কবিগুরু নিজের শেষ প্রবন্ধ ‘সভতার সঙ্কট’-এ সোভিয়েতের নিজের দেশবাসীর উপর এই অত্যাচারের কথা নিশ্চয়ই লিখতেন। কিন্তু এই অধর্মের পতন হতে আরো অর্ধশতাব্দী পার হয়েছিল।
বর্তমান ভারতে আমরা যে রাষ্ট্রবাদের উত্থান দেখছি তা ভারতবর্ষ কে ভিতর থেকে শক্তিশালী করছে আপন স্বার্থের জন্য নয় , বিশ্বকল্যাণের জন্য। করোনা মহামারির ভ্যাক্সিনের যোগান দেওয়া , ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ভারতবিরোধী তুর্কিকে ‘অপারেশন দোস্ত’ এ সাহায্য করা সবেতেই প্রমাণিত হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রবাদ ভোগের জন্য নয় , ভাগীদারির জন্য।একমাত্র উপনিষদ শুনিয়েছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। রাষ্ট্রবাদী ভারতবর্ষ যখন নেতৃত্ব পেল G20 সম্মেলনের, বিশ্বকে স্বার্থ ত্যাগ করে বিশ্বশান্তির এই মহামন্ত্রই শুনিয়েছে—- যে মন্ত্র কয়েক হাজার বছরের বৈদেশিক আক্রমণের পরেও ভারতবর্ষ নিজের বক্ষপিঞ্জরে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে।সেই বক্ষপিঞ্জরের নামই ‘রাষ্ট্রবাদ’। ভারতবর্ষের অতীতের গৌরবময় স্মৃতি আর বৈদেশিক আক্রমণে শত দুঃখ সহ্য করেও এই রাষ্ট্রীয়তাকে বাঁচিয়ে রাখার আনন্দকেই বিশ্বকবি ‘আত্মশক্তি’ বলে চিহ্নিত করেছেন ‘নেশন কী’ প্রবন্ধে।
নিজের জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে কবি যখন ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নিয়ে ভাবছেন , ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে তাঁর আশা “আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে”।
কবিগুরুর ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে দেখে বলতে ইচ্ছে হয় —
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম, মা গো তোমায় ভালোবেসে।।”

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.