সম্প্রতি মুক্তি পেতে চলা একটা সিনেমায় হিন্দুদের স্বস্তিকা আর হিটলারের বাঁকানো ক্রসকে সমান দেখানোর চেষ্টা করেছে। কোন সিনেমা কার সিনেমা এসব এই লেখার উদ্দেশ্য না। মূল উদ্দেশ্য হল হিটলারের নাজী পার্টি কি আদৌ স্বস্তিকা ব্যবহার করত নাকি সেটা অন্যকোন চিহ্ন ছিল তা সবার সামনে তুলে ধরা।
আমাদের আশেপাশের অনেক মানুষও এই একই ভুল করে। বিভিন্ন স্কুল পাঠ্য ইতিহাস বইতে এটাই লেখা থাকে। এমনকি খোদ সত্যজিত রায়ও তার প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে লেখা একটি গল্পে এই ভুল করেছেন যে হিটলারের পতাকার চিহ্ন আসলে স্বস্তিকা।
কিন্তু তা নয়।
প্রথমেই বলি যে হিটলার তার আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্ফে কিন্তু একবারও স্বস্তিকা শব্দের উল্লেখ করেনি। সে যতবার লিখেছে ততবার বাঁকানো ক্রসের (Haken Kreuz) কথাই লিখেছে। সেটাই ছিলো আসলে নাৎসীদের চিহ্ন।
তাহলে নাৎসী পার্টির সাথে স্বস্তিকার নাম জুড়ল কিভাবে?
জুড়ল প্রধানত হিটলার বিরোধী খ্রিস্টানদের মাধ্যমে। ইউরোপের নাৎসী বিরোধীরা (ইভাঞ্জেলিস্ট লবি ) প্রচার করার চেষ্টা করছিল যে নাৎসীরা আসলে বহু ঈশ্বরের আরাধনাকারী (pagan)‚ ওরা খ্রিস্টান নয়। আর‚ এমনই এক নাজী বিরোধী ধর্মযাজক ছিলেন জেমস মারফি। তিনিই প্রথম মেইন ক্যাম্ফের ইংলিশ অনুবাদ করেন আর সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে Haken Kreuz এর ইংলিশ অনুবাদ করে স্বস্তিকা। স্রেফ হিটলার আর তার অনুগামীদের অখ্রীস্টান দেখানোর উদ্দেশ্যে। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশেও চীনা ভাষা থেকে রেড বুকের অনুবাদ করতে গিয়ে Demoralization এর ইচ্ছাকৃত ভুল অনুবাদ করা হয়েছিল খতম। খুব সম্ভবত চারু মজুমদার করেছিল এই চিটিংবাজিটা।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বদৌলতে ইংরেজি ভাষার সারা পৃথিবী ব্যাপী ব্যপ্তির জন্যই সব জায়গায় ছড়িয়ে যায় যে হিটলার স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার করছে। পরবর্তীতে ভারতবর্ষেও হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনকে মানুষের সামনে ভুলভাবে তুলে ধরার জন্য আর জাতীয়তাবাদীদের ফ্যাসিবাদী হিসাবে দেখানোর জন্য কমিউনিস্ট আর সেকুলার লেখকরাও ঢালাওভাবে হিটলারের চিহ্নকে স্বস্তিকা বলে প্রচার করা শুরু করে। এছাড়া খ্রিস্টান আর ইউরোপীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুগামীরাও “খ্রিস্টান সমাজতন্ত্রের থেকে নাৎসীবাদের ঊত্থান” – এই সত্যকে চাপা দেওয়ার জন্য ঢালাওভাবে স্বস্তিকাকে বলির পাঁঠা করতে থাকে।
আর তাছাড়া এতো দেখলেই বোঝা যায়। যে হুকড ক্রস স্বস্তিকা নয়। নাৎসি হুকড-ক্রসটি সাধারণত অনুভূমিক থেকে 45 ডিগ্রী কাত হয়ে থাকে এবং নাৎসীদের আর্থসামাজিক নীতি “সমাজতন্ত্র” কে ইঙ্গিত করার জন্য “S” অক্ষরের মতো ছিল। অপরদিকে হিন্দুদের স্বস্তিকা মাটির সাথে সমতল হয়ে থাকে।
ছোটোবেলায় হিটলার প্রথম একটি খ্রিস্টান মঠে (Lambach Abbey) হুকড ক্রস প্রতীক দেখেছিলেন যেখান থেকেই সম্ভবত তিনি এই চিহ্নের প্রতি আকৃষ্ট হন। অন্ততপক্ষে তথ্য যা বলে আরকি। প্রাচীন কাল থেকেই এই বাঁকানো ক্রস ছিলো খ্রিস্টানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র চিহ্ন। এখনো বহু পুরানো গীর্জা এবং চ্যাপেলগুলিতে এই বাঁকানো ক্রস দেখতে পাওয়া যায়। ( দ্বিতীয় ছবিতে এমনই একটা ছবি দেওয়া হল। সম্ভবত এখানেই হিটলার প্রথম বাঁকানো ক্রস দেখেছিলেন। )
এছাড়াও চার্চে ব্যবহৃত সাধারণ ক্রসের সাথে বাঁকানো ক্রস থাকার ছবিও দেওয়া হল। দেখে নিন। ( তৃতীয় ছবিটা)
এমনকি দ্বিতীয় শতাব্দীতে আঁকা ইহুদীদের ধর্মগুরু মোসেস এর একটা ছবিতেও বাঁকানো ক্রসের ছবি দেখা গেছে। (চতুর্থ ছবি)
যাইহোক‚ লিখলে তো অনেক কিছুই লেখা যায়। দিস্তা দিস্তা লেখা হয়ে যায় ইতিহাসের এমন সব হট টপিক নিয়ে। তবে এই টুকুর মধ্যে যতটুকু দেখাতে পারলাম আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে স্বস্তিকা আর নাৎসী প্রতীকের ক্রস এক নয়?
এবার অন্যদেরও জানান এটা। প্লিজ। ইতিহাসের নামে চলা এইসব হিন্দুত্ববিরোধী চিটিংবাজি সবার জানা সত্যিই প্রয়োজন।
সৌভিক দত্ত
Source:
1- I Am Your Negro: Adolf Hitler, by Dead Writers Club, Ian Tinny
2- Hitler Never Used Swastika: Evangelical Defamation Of Hindu Symbol‚ True Indology
3 – Richard Evans, The Third Reich In Power: Penguin, 2005