কল্যাণ চক্রবর্তী।
ছাত্রাবস্থাতেই আমায় শিক্ষক বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তখন অমরশঙ্কর মহারাজ (স্বামী বোধাতীতানন্দজী) রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আমি আশ্রমিক জীবন শেষ করে তখন রহড়ায় একটি ভাড়াবাড়িতে থাকি। কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে বিসিকেভিতে পড়ছি। শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় মাঝেমধ্যেই আমার বাড়িতে কাউকে পাঠাতেন। নির্ধারিত শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে স্কুলে পড়াতে যেতে হবে তক্ষুনি। ফলে শনিবার দুপুরটা ফাঁকাই রাখতাম। কখনও ক্লাস টেস্টের খাতা দেখতে হতো; কখনও অফিসিয়াল কিছু কাজ। অনাথাশ্রমের ছেলেদের প্রতি বরাবরই তাঁর বিশেষ ভরসা ছিল। তাই নিজের মনে করে ডাক দিতেন। দুই তিনটে ক্লাস নিতাম। ডাক আসতো শনিবার-রবিবার সন্ধ্যাতেও; বালকাশ্রমে অনাথ ছাত্র ভাইদের অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য। আমি সাধ্যমতো তাঁর সম্মান রক্ষার চেষ্টা করেছি। পড়ানোর পারিশ্রমিক বলতে ভালো ভালো কিছু খাবার, মাঝেমধ্যে নতুন ধুতি, উদ্বোধন প্রকাশিত কিছু বইপত্র। আর এতেই আমি বেজায় খুশি। উনি বলতেন, “আশ্রমে বিনা বেতনে পড়েছো, যতটা সম্ভব ফেরত দিয়ে যাও।” উনার আদর্শে পরে সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশনে সকাল-সন্ধ্যা বিনা বেতনে পড়িয়েছি। তখন আমি বহরমপুরে সরকারি আধিকারিক।
অমরশঙ্কর মহারাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়েই তাঁর কাছাকাছি আসা। আশ্রম থেকে বেরিয়ে যাবার আগের কথা; মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বের ঘটনা। মহারাজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, অন্য সমস্ত ছাত্রদের মতো সেন্ট আপ ক্যান্ডিডেটদেরও সময় মতো খেতে যেতে হবে, মন্দিরে নিয়মিত প্রার্থনায় যেতে হবে। আগের বছর পর্যন্ত এদের বিশেষ ছাড় দেওয়া হত। তাতে হয়তো কিছুটা সময় বাঁচতো, কিন্তু নিয়মানুবর্তিতার যথেষ্ট অভাব চোখে পড়তো, অনেক দুষ্ট ছেলে সেই সুবাদে নিয়ম বহির্ভূত কাজ করে ফেলতো বিশেষ সুবিধা ভোগের আড়ালে। মহারাজ এটা ধরে ফেলেছিলেন। এদিকে আমার ব্যাচের ছেলেরা আমায় ভালো করে বুঝিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্বে বসিয়ে দিল। পরের দু’টি ব্যাচের ছেলেরাও (ক্লাস নাইন এবং টেন) পিছনে রয়েছে। কারণ এই নিয়ম একবার চালু হলে তাদেরও কিছু সুবিধা ক্ষুণ্ন হবে, তারা তা চায় না। সব শুনে আমি নেতৃত্ব দিলাম। প্রথম দিন সন্ধ্যায় কেউ প্রার্থনায় গেলাম না, রাতে খেতেও গেলাম না। অনেক খাবার নষ্ট হল। পরের দিন সকালের প্রেয়ার বর্জন করলাম, সকালের জলখাবার খেলাম না, মধ্যাহ্ন ভোজনেও গেলাম না। এবার অমরশঙ্কর মহারাজ আমার বাড়িতে খবর পাঠালেন, খবর পাঠালেন স্কুলে আমার লোকাল গার্জেন বিশ্বেন্দ্র বাবুকে (প্রয়াত বিশ্বেন্দ্র নারায়ণ সান্ন্যাল)। স্কুল থেকে স্যার এলেন, বাড়ি থেকে এলেন আমার মা আর দিদি। ব্রহ্মানন্দ ধামের সামনের মাঠে আমরা। দূরে দাঁড়িয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রেরিত ছাত্রদল। সেন্ট্রাল অফিসের জানালায় দাঁড়িয়ে সকল কর্মী, ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীবৃন্দ। মহারাজ চিৎকার করে বলছেন, “এই ছেলেটাকে আমি এত স্নেহ করি পড়াশোনায় ভালো বলে, সভ্য ভদ্র বলে, ওকে স্পেশাল কোচিং-এর জন্য সন্তোষ বাবুর কোয়ার্টারে (পোস্ট অফিসের পিছনে) আর নন্দ স্যারের মেসে (দিঘির পাড়) পড়ার অনুমতি দিয়েছি। রোজই নানান খাবার পাঠাই, শারীরিক দুর্বলতার কারণে। আর ও এত অকৃতজ্ঞ যে এইসব দুষ্ট ছেলেদের নেতা হয়েছে। ওকে এখনই আশ্রম থেকে বের করে দেবো! দেখি কেমন মাধ্যমিক পাশ করে! এসব জানোয়ার ছেলে আমার দরকার নেই।” সবাই চুপ। আমি ছাড়া অন্য কোনো ছাত্রকে একটাও কথাও তিনি বললেন না। আধ ঘন্টা ধরে কেবল আমার উপর বাক্যবাণ চললো। এরপর সেক্রেটারি মহারাজ (স্বামী রমানন্দজী) ছুটে এলেন। সব শোনার পর মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন। এতক্ষণ নির্বাক থাকার পর মহারাজের পায়ে পড়লাম। অভিমানে তবুও অমরশঙ্কর মহারাজের কাছে যাচ্ছি না। বড় মহারাজ বলছেন, আমি নই, তোমাকে ক্ষমা করতে পারেন অমরশঙ্কর। যাও ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। পাশেই ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে অনাথবন্ধু দা। অমরশঙ্কর মহারাজ একটা ঢাউস হরলিক্সের শিশি বের করে সবার সামনে আমাকে দিচ্ছেন, “ফুরোলে আবার বলবি। এখন আর ক্ষমা চাইতে হবে না। তোর টিম নিয়ে এক্ষুনি খেতে চলে যা। গতকাল রাত থেকে তোরা কিছু খাস নি। তাই আমিও খেতে পারি নি। তোদের জন্য কী মহারাজও না খেয়ে থাকবে?” এবার আমার হুঁশ এলো। মহারাজের পায়ে লুটিয়ে পড়লাম। মহারাজ আমায় প্রায় কোলে তুলে নিয়েছেন। বলছেন, “আশ্রমে আমাদের সকলকেই নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকতে হয়। এরই নাম ব্রহ্মচর্য। এরপর তো তোরা বাইরে চলে যাবি! কিন্তু যথাসম্ভব নিয়মের মধ্যে জীবনচর্যা চলবে, আমরা তার প্রাকপ্রস্তুতি করিয়ে দিই। তুই আগামী দিনের নেতা। কিন্তু যে নেতৃত্ব শুভঙ্করী সেই নেতৃত্ব দিতে হবে তোকে। কোনো জঙ্গি নেতা হবি না তুই। ছেলেদের এমনভাবে বুঝিয়ে বল যেন তারা কখনো বিপথে চালিত না হয়। তোদের কার কী প্রয়োজন জেনে এসে একটা তালিকা করে দিস।”
তাঁর সন্ন্যাস নাম স্বামী বোধাতীতানন্দ, রহড়া বালকাশ্রমে উনাকে চিনতাম ‘অমরশঙ্কর মহারাজ’ নামে। দীর্ঘদেহী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, গৌরবর্ণ, টিকালো নাক, সৌম্যকান্তি চেহারা, চোখেমুখে মৃদু রসিকতা, কঠোর অথচ কোমল হৃদয়ের স্নেহ বৎসল এক সাধু। রহড়ায় বসবাসকালে উনার নাম আগে অনেক শুনেছিলাম, দেখেওছিলাম। চীনের এক প্রাচীন সম্রাটের নামে ছেলেরা আড়ালে ডাকতো, উনি নিজেও তা জানতেন আর মুচকি হাসতেন। যেহেতু আমি নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে পড়ি নি (উনি একসময় ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন), আমার আশ্রমিক জীবন যেহেতু ক্লাস এইট থেকে শুরু হল (ক্লাস সিক্সে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই), উনার অভিভাবকত্বে প্রথম এলাম যখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। উনি সেসময় আশ্রমের বড়বাড়ি অর্থাৎ ব্রহ্মানন্দ ও শিবানন্দ ধামের ছাত্রদের ভারপ্রাপ্ত ব্রহ্মচারী ছিলেন। স্বামী বামনানন্দজী (ভুবন মহারাজ), স্বামী সুপ্রসন্নানন্দজী (শেখর মহারাজ)-র পর বড়বাড়ির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তার বছর দুয়েকের মধ্যে সন্ন্যাস পান। উনাকে স্বামী রমানন্দজী মহারাজের সান্নিধ্যে সাবলীলভাবে কাজ করতে দেখেছি। দীর্ঘ সময় নানান কেন্দ্রে একত্রে কাজ করেছেন। রহড়ায়, সেবা প্রতিষ্ঠানে এবং কাশীতে। কাশী রামকৃষ্ণ মিশনে অবসর জীবন অতিবাহিত করছিলেন মহারাজ। ২০১০ সালে যখন কাশী রামকৃষ্ণ মঠে যাই, উনি খুব যত্ন করেছিলেন। আমার পরিবারের সঙ্গে অনেক কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তখন অন্য এক ভাব-জগতে বিরাজ করছেন। পুরোনো কোনো কথাই আর তুলতেন না। মাথায় হাত রেখে মনে মনে কী বললেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে আছি। বললেন, অনেক বড় হতে হবে, মানুষের মাঝে যেতে হবে। মহারাজের পদনখকণা গ্রহণ করলাম। আর দেখা হয় নি। প্রাক্তন নানান ছাত্ররা কাশীতে গেলে উনার সংবাদ এনে দিতেন। গত ৬ ই এপ্রিল, ২০২১-এ রাত ৮ টা ২৫ মিনিটে তিনি রামকৃষ্ণলোকে যাত্রা করেছেন। ঠাকুর-মা-স্বামীজির পাদপদ্মে উনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।