উপেক্ষা করা হয়েছিল মেট্রোর নকশা বদলে আপত্তি সম্বলিত বহু চিঠি ও নোট

বৌবাজারে নির্মীয়মান মেট্রো রেলপথের নিচে ভয়াবহ অবস্থার চারণ নিয়ে বিতর্ক চলছে। আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল শিয়ালদহ ও এসপ্লানেডের মধ্যবর্তী অংশে বৌবাজারে রেলপথ যাবে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের নিচ দিয়ে। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পর এই নকশার বদল হয়।

এই পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের আপত্তির মাত্রা জানা যাচ্ছে প্রকল্পের লগ্নি সংস্থা ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি’ (জাইকা)-র একটি চিঠিতে। প্রসঙ্গত, দুর্ঘটনা ঘটেছে এই পরিবর্তিত নির্মীয়মান রেলপথের নিচেই। বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের নিচ দিয়ে ভূগর্ভের সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে এরকম দুর্ঘটনা হত না। কিন্তু সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে আড়াআড়িভাবে যে অংশের ওপরে রয়েছে অনেক পুরনো বাড়িঘর।

মেট্রো রেলের নকশা বদল না করতে, অর্থাৎ রাজ্যের প্রকল্পের পথ পরিমার্জনের প্রস্তাবে প্রতিবাদ জানিয়ে
এক দশক আগে বারবার লিখিত আপত্তি এসেছিল।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব সমর ঘোষকে উদ্দেশ করে ২০১২-র ৩১ জুলাই জাইকা-র প্রধান প্রতিনিধি স্নিয়া এজিমা একটি চিঠি লেখেন (জিকা- আইডি ২৪-৫২৫)। তাতে সংশ্লিষ্ট অপর চিঠির ক্রমিক (আই-পি১৯২/২০৭) উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, “নকশা বদল সম্পর্কে ২০১২-র ৩০ জুনের রাজ্যের বৈঠকে আলোচনার কার্যসূচি পাঠানো হয়েছে ‘জাইকা’-র কাছে। ওই বৈঠকে বিবেচনার জন্য আমরা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক এবং রেলমন্ত্রকের বক্তব্য পাঠিয়েছিলাম।

আমরা নিজেরা নকশা বদলের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৪ মে এবং ১১ জুনের বৈঠকের চিঠিতে বিশদ জানিয়েছি। ১৮ জুলাই কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব নকশা বদলের প্রস্তাব নিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। আমরা সেটি নিয়ে ২৪ জুলাই অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রকের বৈঠকে আলোচনা করি। এসবের পরেও নকশা বদল করতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।”

২০১২-র গোড়ার দিকে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব সুধীর কৃষ্ণ নকশা বদলের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছেন। নকশা বদল হলে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা ওঠে। রাজ্য তখন তড়িঘড়ি করে ‘রাইটস’-কে দিয়ে একটা সমীক্ষারিপোর্ট দাখিল করে। টানাপড়েনে প্রকল্পের কিছু কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। ২০১২-র ২৫ এপ্রিল মুখ্যসচিবকে পাঠানো কেএমআরসিএল-এর এমডি-র পাঁচ পাতার নোটে ডানানো হয় নকশা বদলে আপত্তির কথা।

২০১২-র ৩১ জুলাই জাইকা-র প্রধান প্রতিনিধি স্নিয়া এজিমা লিখেছেন, “এর আগে কোনও মেট্রো প্রকল্পে এই ধরনের পরিবর্তন করা হয়নি। এই নকশা বদল অন্য মেট্রো প্রকল্পগুলিতে ভুল সংকেত পাঠাবে। একটি দায়িত্বশীল তহবিল সংস্থা হিসাবে, আমরা সমস্ত প্রকল্পের সময়মত এবং সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেমন, আমাদের অভিজ্ঞতা ও বিচারে ব্যবহারিক এবং যুক্তিযুক্ত নয়, আমরা এমন কোনও উদ্যোগকে সমর্থন করার অবস্থানে নাও থাকতে পারি। প্রকল্পে আমাদের অবস্থান এবং প্রতিশ্রুতি পর্যালোচনা করার কথা বিবেচনা করতে পারি।

এই ধরনের পরিবহণ প্রকল্পর জন্য যে পথ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেরা করিডোর হিসাবে বিবেচিত হয়, সেটাই গ্রহণ করা হয়। তার সম্ভাব্যতা/ডিপিআর পর্যায় শেষ করা হয়। কলকাতা পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো প্রকল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয়। দয়া করে মনে রাখবেন যে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আগে তৈরি ডিপিআরটি পাওয়ার পরে, প্রকল্পের জন্য আমরা তহবিলের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম।

দু’বছরেরও বেশি সময় আগে ঠিকাদারদের একত্রিত করা হয়েছে। সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ সক্রিয়ভাবে চলছে। এই অবস্থায় নকশা বদলালে আমাদের অভিজ্ঞতায় প্রকল্পের সময়সূচীর জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর হবে। ফলে যথেষ্ট খরচ বৃদ্ধি পাবে, যা খুব কঠিন বলে মনে করি। কলকাতা মেট্রো প্রকল্পের নির্মাণ অতীতে একটি না অন্য কারণে ধারাবাহিকভাবে বিলম্বিত হয়েছে। প্রকল্পের সর্বোত্তম স্বার্থে, আমরা আপনাকে আবারও আন্তরিকভাবে অনুরোধ করব যে প্রকল্পটি মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলুন এবং এর সময়মতো এবং সফল সমাপ্তির সুবিধার্থে।

২০০৮-এর ৩০ জুলাই রেল মন্ত্রক মেট্রোর এই রেলপথের ছাড়পত্র দেয়। বহু আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পে দেরি এবং বিপুল অতিরিক্ত খরচের কারণ ও বৌবাজারের অনিশ্চয়তার সঠিক ব্যখ্যা— এসবের জবাব এখন কে দেবে?

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.