আমার চোখে জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী ( খোকা দা)

এক ছুটির দিন বিকালে যতীন বাবু গিরিশ পার্কে পায়চারি করছিলেন। চোখে পড়লো কিছু তরুণ ছেলেরা ড্রিল করছে। তিনি কিছুক্ষণ ধরে ওদের নিরীক্ষণ করতে লাগলেন, ভাবতে লাগলেন ছেলেগুলো তো খুব ডিসিপ্লিন। খেলাধুলা এবং গান গাওয়ার পর এক সারিতে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলো। খুবই আগ্রহের সাথে সমস্ত কার্যক্রম লক্ষ্য করলেন তিনি। পরিশেষে যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনিও এক সুদর্শন যুবক। নাম জিজ্ঞাসা করতে বললেন, “আমার নাম অনন্ত”, একদম পরিষ্কার বাংলাতে উত্তর দিলেন।

কিছুদিন ধরেই যতীন বাবু লক্ষ্য করছিলেন যে তাঁর একমাত্র পুত্র নিজে খেলার থেকে খেলা দেখায় বেশি ঝুঁকে পড়ছে। কোনক্রমে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বইয়ের ব্যাগটি টেবিলে রেখে কখনো ইস্টবেঙ্গলের মাঠে তো কখনো মোহনবাগান বা মহামেডান স্পোটিং ক্লাবের মাঠে খেলা দেখতে ছুটে যাচ্ছে। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়ছে। যতীন বাবু একটু চিন্তিত ছিলেন, মনে মনে ভাবলেন ছেলেটা যদি বাড়ির পাশে এখানে এদের সাথে শরীরচর্চা, খেলাধুলা করে তাহলে খুব নিশ্চিন্ত হন। এই সব ভেবে তাই অনন্ত বাবুকে মানে আমাদের অনন্তদা অর্থাৎ প্রচারক স্বর্গত অনন্ত লাল সোনীকে অনুরোধ করলেন, “আমার ইচ্ছা আমার ছেলেটাও আপনাদের সাথে এসে খেলাধুলা করুক”। অনন্তদা তো এই কাজেই নিবেদিতপ্রাণ। কাল বিলম্ব না করে সেই দিনই তাঁর বাড়িতে গিয়ে যতীন বাবুর পুত্রের সাথে আলাপ করলেন এবং পরের দিনই সাথে করে শাখার মাঠে নিয়ে এলেন। যতীন বাবুর পুত্রটি আর কেউ নন, আমাদের বিশেষ করে আমার সংঘ জীবনের অভিভাবক স্বরূপ, শ্রী জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী, আমাদের সকলের প্রিয় খোকা দা। বাল্য অবস্থা থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য নবম শ্রেণীতে পাঠরত সময় থেকেই উল্টোডাঙ্গা শাখার মুখ্য শিক্ষক এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী শাখার কার্যবাহ ছিলেন। দীর্ঘদিন আমার সাথে এই সম্পর্ক, আমি ওনার অনুগামী, উনি আমার অভিভাবক। নিজের প্রফেশনের সাথে সাথে সংঘ কাজের দায়িত্ব বেড়েছে ধীরে ধীরে। পূর্ব ক্ষেত্রের সংঘ চালকের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। তারপর তবেই ছুটি পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আমাদের সাথে নিয়মিত সম্পর্ক কখনোই ছিন্ন হয় নি।

খোকা দার হবি ছিল বই পড়া। নিয়মিত বই পড়তেন তিনি। সংঘের আদর্শ অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে ব্যক্ত করতেন। তাঁর বক্তব্য যেমন বিজ্ঞানভিত্তিক হত, তেমনি আধুনিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্য হত।

আমার ব্যক্তিগত বৌদ্ধিক জ্ঞান খোকা দার থেকেই আহরিত। আমার বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে, “তুমি এত পড়াশোনা কখন করো?” তখন মনে মনে বলি, “সবই খোকা দার বৌদ্ধিকতার প্রতিধ্বনি মাত্র।”

খোকা দা যেমন রসিকপ্রবর ছিলেন ঠিক তেমনি অভিভাবক সুলভ শাসন করতেন। কলেজে ভর্তি হয়েছি, জিন্সের প্যান্ট পরে কলেজ যাচ্ছি, দেখা হতে কিছু বললেন না। রাত্রিবেলায় বাড়িতে এসে বললেন, “এই ধরনের প্যান্ট বিদেশে মাইনিংয়ের লেবাররা পরে।” ব্যাস, আমার জিন্স পরা বন্ধ হয়ে গেল।

তারপর মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। হঠাৎ গতকাল রাত্রিতে সুজনের (জ্যোতির্ময় চক্রবর্তীর কনিষ্ঠপুত্র) ফোন আসাতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। সবই শুনলাম, মনে হল আমার কোন একটা দিক ফাঁকা হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে এলাম, আপাতদৃষ্টিতে সবই ঠিক আছে, কিন্তু না, মনটা কোথাও যেন শূন্য হয়ে গেছে। ওই শূণ্যস্থানটা আর কেউ ভরতে পারবে না। সংঘ জীবনের বাঁধনগুলো একটা একটা করে খসে পড়ছে।

ফুল নয়, মালা নয়, শুধু একটি প্রণাম নিবেদন করেই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করলাম।

স্মৃতিচারণ: শ্রী সুশান্ত রঞ্জন পাল
27/02/22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.