২৮শে জুলাই, ২০০১ ছিলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কোটি কোটি স্বয়ংসেবকদের জন্য একটি কালো দিন। এই দিনে ভারত সরকার চারজন প্রবীণ আরএসএস কর্মীর মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা করে। এই চারজন স্বয়ংসেবকদের ত্রিপুরা রাজ্যের কাঞ্চনছড়ায় অবস্থিত ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’-এর একটি ছাত্রাবাস থেকে মিশনারিদের ব্যাকাপ পাওয়া দুস্কৃতীরা ৬ আগস্ট, ১৯৯৯-এ অপহরণ করেছিল।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন শ্রী শ্যামলকান্তি সেনগুপ্ত, বয়স ৬৮ বছর। তিনি সুপাতলা গ্রামে (মহকুমা করিমগঞ্জ, জেলা শ্রীহট্ট, বর্তমান বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। শ্রী সুশীলচন্দ্র সেনগুপ্তের পাঁচ পুত্রের মধ্যে শ্রী শ্যামলকান্তি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। দেশভাগের পর তার পরিবার আসামের শিলচরে বসতি স্থাপন করেন। ম্যাট্রিকুলেশন করার সময়, তিনি প্রচারক শ্রী বসন্তরাও, আরেক কার্যকর্তা শ্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ এবং নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপক শ্রী উমারঞ্জন চক্রবর্তীর সংস্পর্শে এসে স্বয়ংসেবক হন।
ম্যাট্রিকুলেশন করার সময়ে তাঁর বাবা মারা যান। বাড়ির দায়িত্ব কাঁধে আসায় চাকরি করতে করতে এম.কম পর্যন্ত শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারেন। এরপর তিনি ডিব্রুগড় ও শিবসাগরে জীবন বীমা কর্পোরেশনে কাজ করেন। এরপর তিনি ১৯৬৫ সালে কলকাতায় আসেন। ১৯৬৮ সালে তিনি গৃহস্থ জীবনে প্রবেশ করেন। সেখানে তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে হয়। চাকরির পাশাপাশি তিনি সংঘ কার্যেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯২ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পূর্ণ সময় দিয়ে সংঘের কাজ করতে লেগে পড়েন। তার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দেখে বশিষ্ঠ কার্যকর্তারা তাকে ক্ষেত্র কার্যবাহের দায়িত্ব দেন।
আরেকজন কার্যকর্তা ছিলেন শ্রী দিনেন্দ্র দে। তিনি ১৯৫৩ সালে উল্টোডাঙ্গায় ( বর্তমান বিধাননগরে) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শ্রী দেবেন্দ্রনাথ দে ডাক বিভাগের একজন কর্মচারী ছিলেন। পরে তারা সোনারপুরে বসতি স্থাপন করে। ১৯৬৩ সালে তিনি এখানকার বৈকুণ্ঠ শাখায় স্বয়ংসেবক হন। এখান থেকে তিনি ১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
‘ডায়মন্ড হারবার ফকিরচাঁদ কলেজ’- এ গণিতে (অনার্স) অধ্যয়নকালে তিনি সংঘের ঘনিষ্ঠ হন এবং বিদ্যার্থী বিস্তারক রূপে কাজ আরম্ভ করেন। তার পর যথাক্রমে সংঘের তৃতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণ নেন। প্রচারক হিসেবে তিনি ব্রহ্মপুর নগর প্রচারক, মুর্শিদাবাদ সহ জেলা প্রচারক, কোচবিহার, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের জেলা প্রচারক ছিলেন। এরপর তিনি বিভাগ প্রচারক, প্রান্তীয় শারীরিক প্রমুখ থাকাকালীন বনবাসীদের মধ্যে সেবামূলক কাজেও নিয়োজিত ছিলেন।
৫১ বর্ষীয় শ্রী সুধাময় দত্ত ছিলেন মেদিনীপুর শাখার স্বয়ংসেবক। স্নাতকের পড়াশোনা শেষ করে তিনি প্রচারক হয়েছিলেন। প্রথমে তিনি হুগলি জেলার চুনচড়া নগর প্রচারক এবং তারপর মালদহ জেলা প্রচারক হন। কিছুকাল তিনি বাংলার সেবা বিভাগের দায়িত্বও পালন করেন। এরপর সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘স্বস্তিকা’-এর ম্যানেজার করা হয়। অপহরণের সময় তিনি আগরতলায় বিভাগ প্রচারক ছিলেন।
৩৮ বর্ষীয় শুভঙ্কর চক্রবর্তী, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার স্বয়ংসেবক ছিলেন তাদের মধ্যে বয়সে সবথেকে ছোট। এলএলবি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রচারক হন। বর্ধমান জেলার কালনা ও করোয়াতে কাজ করার পর তাঁকে ত্রিপুরায় পাঠানো হয়। ঐ সময় উনি ত্রিপুরার ধর্মনগর জেলার প্রচারক ছিলেন।
এই সকলের মৃত্যুর খবর স্বয়ংসেবকদের জন্য ছিল হৃদয়বিদারক। কিন্তু তাদের পরিবারের দুর্ভোগ এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল, যা আজও শেষ হয়নি। যেহেতু এই চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি, তাই তাদের আনুষ্ঠানিক শেষকৃত্য ও মৃত্যু পরবর্তী কার্যক্রমও করা সম্ভব হয়নি।