১ জুলাই বিস্ময়কর প্রতিভা যামিনী কবিরাজের জন্মদিন

স্মরণীয় ও বিস্ময়কর প্রতিভার বহু বাঙালির কথা আমরা বছরভর মনে রাখিনা। হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় কোনও একটা দিন। উত্তর কলকাতায় যামিনী কবিরাজ রো দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমাদের মাথায় আসেনা কে এই যামিনী কবিরাজ?

জন্ম ১৮৭৯ সালের ১ জুলাই অধুনা বাংলাদেশে খুলনার পয়োগ্রামে। বাবা ছিলেন ‘কবিচিন্তামনি’ উপাধিপ্রাপ্ত কবিরাজ পঞ্চানন রায়। যামিনী অল্প বয়সেই চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন ভবানীপুরের সাউথ সুবার্বন স্কুলে। সেখান থেকে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মাত্র ১৪ বছর বয়সে। এর পর কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে বিএ ও এমএ পাশ করেন। প্রধান বিষয় ছিল সংস্কৃত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯০৫ সালে এমবি (ব্যাচেলার অফ মেডিসিন) হওয়ার পর এমআরএএস-এ প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক পান। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা অনেকের নজর কাড়ে।

এমবি ও এমআরএএস পড়ার সময় যামিনী কবিরাজ বাবার কাছে আয়ুর্বেদ ও কবিরাজির পাঠ নিতেন। ঠিক করেন আধুনিক চিকিৎসা নয়, আধুনিক চিকিৎসাকেই করবেন উপজীব্য। অনেকে তাঁকে বোঝালেন, ভবিষ্যতে পশ্চিমী চিকিৎসায় উপার্জন হবে অনেক বেশি। আয়ুর্বেদ চিকিৎসক হলে অভাবে পড়তে হবে। কিন্তু প্রলোভনের পথে পা না বাড়িয়ে যামিনী কবিরাজ জবাব দিয়েছিলেন, “লাগলে পাঁচন বিক্রি করে খাব!“

সেকালের বিখ্যাত চিকিৎসক মহামহোপাধ্যায় কবিরাজ বিজয়রত্ন সেনের কাছে আয়ুর্বেদের পাঠ নিতে থাকেন। অচিরেই যামিনী কবিরাজের নাম ছড়িয়ে পড়ে। বাগালা মারোয়ারি হাসপাতাল তাঁকে মাসে ৪০ টাকা বেতনে কাজ দেয়। সেকালে ওই অর্থের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট। নাম ছড়াতে থাকায় চার টাকার ভিজিট করে দিলেন ৩২ টাকা। গরিবদের জন্য মাপ। ভিন রাজ্যে গেলে ফিজ ১ হাজার টাকা। গোয়ালিয়র, ইন্দোর, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজপরিবার তো তাঁকে আনার জন্য আরও বেশি টাকা দিতে প্রস্তুত!

১৯১৫-তে চেন্নাইয়ে সর্বভারতীয় আয়ুর্বেদ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হলেন তিনি। ১৯১৬ সালে ২৯, ফড়িয়াপুকুর স্ট্রিটে ভাড়া বাড়িতে তিনি ‘অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ কলেজ’ তৈরি করেন। গাঁধীজী পর্যন্ত তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। ১৯২৬-এ মারা যাওয়ার ঠিক আগের দিন ২ লক্ষ টাকা ওই কলেজকে দান করেছিলেন যামিনী কবিরাজ। তার আগেই, ১৯২৫-এ রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে নয়া ভবনে স্থানান্তরিত হয় ওই কলেজ। এখন যেটিকে আমরা জানি জেবি রায় আয়ুর্বেদ হাসপাতাল নামে। হাসপাতালটির শিলান্যাস করেছিলেন মহাত্মা গাঁধী।

পাতিপুকুরে প্রায় ১২ বিঘায় তাঁর যে বাগানবাড়ি ছিল, সেখানে তৈরি হয় যক্ষা হাসপাতাল হয়েছিল, তার শিলান্যাস করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। কলকাতায় বালিগঞ্জ, গ্রে স্ট্রিট এবং কার্শিয়াং, রাঁচিতে বেশ বড় জমি ছিল। জেবি রায় হাসপাতালে তাঁর মূর্তি আছে। অথচ, তাঁর সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ হয় না।

ভারতে পশ্চিমী চিকিৎসাব্যবস্থা শুরু মোটামুটিভাবে ধরা যেতে পারে ১৮৩৫ সালে। তৈরি হল মেডিক্যাল কলেজ। এর পর এই ক্ষেত্রে সাড়া জাগিয়েছিলেন মধুসূদন গুপ্ত (জন্ম ১৮০০)। ১৮৩৬-এর ২৮ অক্টোবর চার সহকারীকে নিয়ে কীভাবে শব ব্যবচ্ছেদ করলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রকে এগিয়ে দিলেন কয়েক কদম, সে কথা অনেকেরই জানা। এর পর নানা সময়ে ভারতের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার দিকপাল হিসাবে স্বীকৃতি পান মহেন্দ্রলাল সরকার (জন্ম ১৮৩৩), রাধাগোবিন্দ কর (জন্ম ১৮৫২), নীলরতন সরকার (১৮৬১), কাদম্বিনী গাঙ্গুলি (১৮৬১), বিধান চন্দ্র রায় (১৮৮২) প্রমুখ।

এর পাশাপাশি তৎকালীন বাংলায় ছিল সনাতন চিকিৎসাব্যবস্থা। আজ থেকে দু’শ বছর আগে লোকে ছড়া কাটত ‘গণি মিঞার ঘড়ি আর নীলাম্বরের বড়ি’। নীলাম্বর ছিলেন খ্যাতিমান কবিরাজ। তাঁর পুত্র গঙ্গাধর কবিরাজও ছিলেন সেকালের স্বনামধন্য ব্যক্তি।

১৮৩৫-এর কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সাহেব টমাস মেকলে শিক্ষাব্যবস্থা-সম্পর্কিত এক নয়া ফরমান আনলেন। চালু হল বিলিতি আলোয় শিক্ষা দেওয়ার নিয়ম। প্রতিবাদ জানালেন শীর্ণকায় চেহারার রোগাটে, কঠোর মানুষ গঙ্গাধর কবিরাজ।তিনি ‘গঙ্গাধর নিকেতন চতুষ্পাঠী’ খুলে বসলেন। ১৮৬৮-তে নিজে সম্বাদ জ্ঞানরত্নাকর যন্ত্রে ছাপিয়ে ফেললেন চড়ক সংহিতার টীকা ‘জল্প কল্পতরু’। 

গঙ্গাধর তৈরি করলেন আয়ুর্বেদ চর্চার দিকপাল সব ছাত্রদের। গঙ্গাপ্রসাদ, বিজয়রত্ন, যামিনীভূষণ কবিরাজ প্রমুখ দিকপাল চিকিৎসকদের কীর্তি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ১৮৭৭ সালে মহারানি ভিক্টোরিয়া হিন্দু চিকিৎসা বিজ্ঞানে দক্ষতার জন্য গঙ্গাপ্রসাদকে ‘রায়’ উপাধি দিলেন। আজও কুমোরটুলিতে আছে কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেনের বাড়ি। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ঘোর অসুখের সময়ে দক্ষিণেশ্বরে তাঁর চিকিৎসা করতে এলেন কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেন। হয়ে গেলেন ঠাকুরের ভক্ত। বিখ্যাত কবিরাজের বাড়িতে আগে থেকেই পুজো হত। কিন্তু শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব অসুস্থ অবস্থাতে তাঁর বাড়ির দুর্গোৎসব দেখতে আসেন। এর পর থেকে
লোকমুখে বেশি প্রচার পেল ওই পুজোর।

কবিরাজ বিজয়রত্নও পিছিয়ে ছিলেন না। নিজের খ্যাতিকে এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন যে, ইংরেজ সরকারই তাঁকে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। আজও কুমোরটুলি স্ট্রিটে দেখা যায় বিজয়রত্ন ভবনের জীর্ণ ফলকটি। যেখানে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধিটিও পড়া যায়।

চিকিৎসাশাস্ত্রে আজ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নানা কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বাংলার ঐতিহ্য। কিন্তু একটা সময়ে বাংলা এই ক্ষেত্রে কেবল এদেশে নয়, পথ দেখিয়েছিল গোটা মহাদেশে। ১৮৮৭ সালে জন্মেছিলেন সাধনা ঔষধালয়ের যোগেশচন্দ্র ঘোষ। অবিভক্ত বাংলার বাইরে কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই প্রতিষ্ঠান, আজ তা নিছকই ইতিহাস।

বাংলার চিকিৎসার ঐতিহ্যের কথা। সেই হৃত গৌরব কীভাবে এবং কতটা ফিরিয়ে আনা যায়, তার পথ খুঁজতে হবে নবীন চিকিৎসকদেরই। বিশেষ করে যাঁরা দেশীয়, সনাতন চিকিৎসাপদ্ধতিকে এখনও টিঁকিয়ে রেখেছেন।

ন্যাশনাল আয়ুর্বেদ স্টুডেন্টস ও ইয়ুথ এসোসিয়েশন-এর সর্বভারতীয় কার্যকারনি সদস্য
ডাঃ সুমিত সুর এই প্রতিবেদককে বলেন, গত বছরের মতোই আমরা এবছরও রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর, রাজ্যপাল, কেন্দ্রের আয়ুষ মন্ত্রালয়, বিধানসভা স্পিকার, বিধানসভা মুখ্য সচেতক, বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার কাছেও অনুরোধ জানিয়েছি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য ও ওনাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য। আমরা চাই আর এক বরণীয় বাঙালি চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়ের মত শ্রদ্ধা পান যামিনী কবিরাজ। দু’জনেরই জন্ম একই দিনে।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.