১৮৩৫ সালে ভারতবর্ষে রূপায়িত হল মেকলে-প্রসূত ও প্রবর্তিত ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা। এটি খ্রিস্টীয়করণের পথে ঔপনিবেশিক ভারতে মানস-দখলের পরিকল্পনা। ঠিক পরের বছরই সেই ছন্দপতন! ১৮৩৬ সালে যে হিন্দু মনীষীর জন্ম, ১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি বিকেল তিনটেয় তিনিই তাদের প্রথম দিনটি ঐশী সৌন্দর্যে দখল করে নিলেন। তারপর ১৮৮৬ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর আঁটপুরে এবং ১৮৯২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর কন্যাকুমারীতে আসবেন স্বামী বিবেকানন্দ, বড়দিনটিকেও একইভাবে অতিক্রম করে যেতে। খ্রিস্টীয় ক্যালেণ্ডারে সনাতনী সংস্কৃতির স্রোত বইতে থাকবে।
১ লা জানুয়ারি হল কাশীপুর উদ্যানবাটিতে এক অবতারপুরুষের কল্পবৃক্ষ হয়ে ওঠার দিন। তাপিত সংসারে নিমজ্জিত মানুষের ইচ্ছেপূরণের দিন। জীবোদ্ধার করে স্বর্গীয় মহিমা বিতরণের দিন। দক্ষিণেশ্বর নাটমন্দিরের জনবহুল সভায় ভৈরবী ব্রাহ্মণী একদিন তাঁকে অবতার রূপে প্রচার করেছিলেন। সেই তিনিই ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু রূপে কলকাতার উদ্যানের মালঞ্চে তামসভেদী আলোকের বেশে অবতীর্ণ হলেন। কেমন সে রূপ? ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’-তে কবি অক্ষয় কুমার সেন লিখছেন —
“শ্রীঅঙ্গের মধ্যে খোলা বদনমণ্ডল।
কান্তিরূপে লাবণ্যেতে করে ঝলমল।।
দারুণ বিয়াধি-ভোগে শীর্ণ কলেবর।
কিন্তু বয়ানেতে কান্তি বহে নিরন্তর।।
মনে হয় অঙ্গবাস সব দিয়া খুলি।
নয়ন ভরিয়া দেখি রূপের পুতুলি।।”
শ্রীরামকৃষ্ণ তখন অসুস্থ। সকল নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পোষাকে সর্বাঙ্গ আবৃত হয়ে বাড়ির দোতালা থেকে ভ্রাতুষ্পুত্র রামলালকে সঙ্গে নিয়ে নামলেন। ছুটির দিন। তাই উদ্যানে অনেক বহিরাগত ভক্ত এসেছেন। ঠাকুরের জন্য রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত হয়ে একতালার ঘরে নরেন ও কয়েকজন সেবক তখনও নিদ্রিত। ঠাকুরের ঘরদোর গোছাচ্ছেন সেবক লাটু আর শরৎচন্দ্র। উদ্যানে রয়েছেন গৃহীভক্ত গিরিশ আর রামচন্দ্র। ঠাকুর একাকী বেড়াচ্ছেন সুড়কির রাস্তা ধরে, পুষ্করিণী হয়ে ফটক পর্যন্ত। হঠাৎ গিরিশকে প্রশ্ন করছেন, “তুমি যে আমার সম্বন্ধে এত ব’লে বেড়াও, তুমি কি দেখেছ বা বুঝেছ?” তৎক্ষণাৎ বুঝে গেছেন গিরিশ, ঠাকুর আজ কী বলতে চাইছেন! শ্রীরামকৃষ্ণের পদতল আশ্রয় করে তিনি প্রত্যুত্তর করলেন, “ব্যাস বাল্মিকী যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর সম্বন্ধে বেশি কি আর বলতে পারি!” সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো ঠাকুরের, ভাবের গভীর সমাধিতে মগ্নচেতন হলেন, মুখমণ্ডলে নির্গত হল অপরূপ দিব্যপ্রভা, রূপমাধুরী সর্বশরীর থেকে বিনির্গত হতে লাগলো। ভক্তগণ বিমুগ্ধ, অস্ফুট। গিরিশ ঐশী-উল্লাসে জয়ধ্বনি করে উঠলেন, বারংবার ঠাকুরের চরণধূলিকণা গ্রহণ করলেন। চীৎকার করে ডাকলেন সবাইকে, “তোরা কে কোথায় আছিস্ আয়, আজ শ্রীশ্রীঠাকুর কল্পতরু হয়েছেন এবং সকলকে বর দিচ্ছেন।” ছুটে এলেন সবাই। ভক্তবৃন্দ ভাবোচ্ছ্বাসে উচ্চারণ করলেন “জয় রামকৃষ্ণ”। বুঝলেন আজ আর অবতারবরিষ্ঠ নিজেকে লুকোবেন না। আজ আর ভগবানের ধরাধামের বার্তা অপ্রকাশিত থাকবে না। স্বয়ং ভগবান আজ ‘সব হয়েছেন’। আজ তিনি কল্পতরু, আজ পুরো পৃথিবী রামকৃষ্ণময়। আজ পাপীতাপী সকলের অভয়পদে আশ্রয় লাভের দিন। ১ লা জানুয়ারি।
ঠাকুর ক্রমে বাহ্যদশায় ফিরে আসছেন। এবার হাসছেন তিনি। ভক্তের প্রতি কৃপাদৃষ্টি করে বলছেন, “চৈতন্য হোক”। সে মধুর বাক্য কেবল সেই বেলাকার নয়, সেই দিনের জন্যও নয়! শাশ্বতকালের চৈতন্যবার্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল ১ লা জানুয়ারি খ্রিস্টীয় আনন্দের এক দিনে। ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এ স্বামী সারদানন্দ লিখছেন, “স্বার্থগন্ধহীন তাঁহার সেই গভীর আশীর্বাণী প্রত্যেকের অন্তরে প্রবল আঘাত প্রদানপূর্বক আনন্দস্পন্দনে উদ্বেল করিয়া তুলিল।… কোন এক অপূর্ব দেবতা হৃদয়ে অনন্ত যাতনা ও করুণা পোষণপূর্বক বিন্দুমাত্র নিজ প্রয়োজন না থাকিলেও, মাতার ন্যায় তাহাদিগের স্নেহাঞ্চলে আশ্রয় প্রদান করিতে ত্রিদিব হইতে সম্মুখে অবতীর্ণ হইয়া তাহাদিগকে সস্নেহে আহ্বান করিতেছেন!” কারো অধ্যাত্মনেত্র গেল খুলে, কারও ভাগ্য, কেউ পেলেন সমাধি লাভের বরমাল্য, তো কেউ পেলেন অর্থসম্পদ। সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পুষ্পচয়ন করে মন্ত্রোচ্চারণ করে শ্রীপাদপদ্মে অর্পণ করছেন। একে একে তাদের সকলকে আশীর্বাদ দিয়ে ধন্য করলেন পরমপুরুষ। আর ধন্য হল সনাতনী হিন্দু-সংস্কৃতি। ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটাই ভারতীয় সাধু-সন্তের কাছে পরাজিত হল। যতদিন যাবে সমগ্র বিশ্বই কল্পতরু বৃক্ষের ফললাভ করবে। আর সুবাস ছড়াবে হিন্দুধর্মের। জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ।
বিদ্যুৎ মুখার্জী