১.
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ডঙ্কা বাজলো। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তাই সমগ্র মানবজাতির নজর এই দেশ এবং নির্বাচনটি ঘিরে। দেশের নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ভোটকর্মী এবং সংবাদ মাধ্যমের ব্যস্ততা ও তৎপরতা এইসময় সর্বোচ্চ স্তরেই থাকে। তবে একজন তন্বিষ্ট-ভোটার হিসেবে, সাধারণ মানুষ হিসাবে আমজনতার একটি বড় দায়িত্ব কিন্তু রয়ে যায়। সেটা হল সেরা এবং উপযুক্ত প্রার্থীকে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠানো, নির্ভরযোগ্য দলের হাতে দেশের শাসনভার ন্যস্ত করা, যাতে বিদেশীশক্তি ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, চীন এবং পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশ ভারতকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। বিদেশি ষড়যন্ত্রে ভারতেই ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকা দেশীয় এজেন্টদের চক্রান্তে যাতে দেশটি ছারখার হয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা করা। নির্বাচন করার কাজটি কঠিন এজন্যই যে আমরা অনেকসময় দেশের শত্রুকে সঠিকভাবে চিনতে পারি না। খবরের কাগজ এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ক্রমাগত মিথ্যা প্রচারে আমরা অনবরত বিভ্রান্ত হই। যে সংবাদ মাধ্যম অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশন করে, তারা ভোটের সময়ও মরিয়া হয়ে যায় ভোটারদের ঠকিয়ে অসৎ এবং দেশবিরোধী দলের পক্ষে ভোটবাক্স ভরিয়ে দিতে। যেহেতু কাগজে প্রকাশিত সংবাদকে ভোটাররা বেদবাক্যের মতো মনে করে, তাই প্রতারণার সম্ভাবনা থেকে যায়। যারা সাময়িকভাবে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তারা ভোটের সময় সঠিকপক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না। প্রস্তুত আলোচনায় আমরা নির্মোহদৃষ্টিতে দেখাবো যোগ্য প্রার্থী এবং যোগ্য দল বেছে নেবার উপায় কী আছে! সকাল সকাল সপরিবারে কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের ভোট নিজে কেন দেবো? নোটা-তে বোতাম টেপা কেন অনুচিত — এইসব বিষয়েই প্রস্তুত আলোচনা হবে।
২.
ভোটারের প্রথম কাজ হচ্ছে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের ভাবনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া। গুণ্ডাবাহিনীর পেশীশক্তি, দুর্নীতির আবহ, সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যা বুলি সত্ত্বেও একজন ভোটার যোগ্য এবং সেরা প্রার্থী খুঁজবেন কীভাবে? ভোটারকে এজন্য ‘ভোট-গোয়েন্দা’ হতে হবে। প্রকৃত গোয়েন্দা কারও দ্বারা প্রভাবিত হন না; সবদিক ভেবেচিন্তে নিরাপরাধ ব্যক্তিদের অপরাধের তালিকা থেকে আগে বাদ দিতে থাকেন। প্রার্থী বিচারেরও সবচাইতে সেরা পদ্ধতি হল অসৎ এবং অযোগ্যদের আগেই তালিকা থেকে সরিয়ে রাখা৷ যে প্রার্থী আপনাকে বোকা বানিয়ে আগে জিতেছে, যে দুর্নীতির পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রয়েছে, অথবা যে ব্যক্তির কাছে রাজনীতি টাইম-পাস, যে জেতার পর সাধারণ মানুষকে ভুলে যায়, পরিষেবা দেবার ক্ষেত্রে দলীয় সমর্থকদেরই সবকিছু পাইয়ে দেয়, তোষণের রাজনীতি করে, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিপরীতে কথা বলে, মা-বোনের শ্লীলতাহানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয় না, বাংলাভাষার উপরে নেমে আসা মরু-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথাটি কয় না — আপনি নিশ্চয়ই তাকে ভোট দিয়ে ‘আত্মঘাতী’ হতে চাইবেন না!
ভোট দেবার আগে আপনাকে ভাবতে হবে, সৎ, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ব্যক্তিত্ব কে রয়েছেন? কে সত্যিই আপনার সমস্যা সংসদে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলতে পারবেন, আপনার জন্য সুবিচার এনে দিতে পারবেন। এমন উপযুক্ত প্রার্থীই আপনি নির্বাচন করুন।
৩.
কোন দলের হাতে দেশের শাসনভার নিরাপদ তা ঠিক করবেন কীভাবে? প্রথমে বুঝে নিন নির্বাচনটির বিস্তৃতি কী! লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা না পঞ্চায়েত ভোট এটি! যেহেতু ২০২৪-এর ভোট লোকসভা নির্বাচন, যেহেতু এটি প্রধানমন্ত্রী সুনিশ্চিত করার ভোট, তাই এমন দলকে ক্ষমতায় রাখবো যে দলে প্রধানমন্ত্রীর মুখটি সর্বোত্তম এবং উজ্জ্বল ভাবেই রয়েছে, ধোঁয়াশা নেই, নানাভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এমন দলকে জেতাবো, যে দল দেশের নিরাপত্তা অটুট রাখতে সক্ষম হবে, যে দল দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাভিমান রক্ষায় বদ্ধপরিকর হবে। দেশের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে পদদলিত করে চলে যাবে না যে দল — তাদের হাতেই মূল্যবান ভোটটি অর্পণ করে নিশ্চিন্তে কালাতিপাত করতে পারবো আমরা। আমরা চাইবো না আমাদের দেওয়া ভোটটি নষ্ট হোক। আমরা চাইবো চারিদিক বিবেচনা করে যে দলকে ভোট দিলাম সেই দলই যেন ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করে। উন্নতির লক্ষ্যে সমগ্র দেশ যে সদর্থক পথে চলছে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে, বঙ্গপ্রদেশ যেন তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়! নোয়াখালির বীভৎস স্মৃতি নিয়ে সন্দেশখালির মতো অসংখ্য প্যাকেট ও পকেট যাতে তৈরি হয়ে না যায়। দেশে শক্তিশালী সরকার যে দল দিতে পারে, মজবুত অর্থনীতি যে দলের লক্ষ্য, সামাজিক স্থিতি যে দলের প্রায়োরিটি — তাকেই ভোট দিতে হবে৷ পাকিস্তান ও চীনের মতো শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী পাশেই রয়েছে এটা মাথায় যেন থাকে। সাধারণ ভোটার সবসময় চান ভারতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গও সবদিক থেকে বিকশিত হোক। যে রাজনৈতিক দলের হাতে দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি ঘটবে, দেশমাতা গৌরবশালিনী হবেন, অমৃতকালের জন্য ভব্য ভারতের ভিতগড়া সম্ভব হবে, সেই দলকেই আমাদের জয়ী করতে হবে।
৪.
প্রার্থী ঠিক করলাম, পছন্দের দলও ঠিক করালাম, চিন্তার সমন্বয় ঘটালাম, অথচ ভোট দিতে গেলাম না! ভাবলাম আমি ভোটাধিকার প্রয়োগ না করলেও ভোটের চলতি হাওয়ায় সে প্রার্থী, সে দল জিতে যাবে — তবে তা কিন্তু মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত হবে। সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য যেখানে ভোটের সময় সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়, রিগিং হয়, প্রভূত পরিমাণে ছাপ্পা ভোট পড়ে। সারা দেশের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই রক্তেরাঙা ভোট, বহু মানুষের মৃত্যু হয়। এটা এজন্যই সম্ভব হয়, সবমানুষ সপরিবারে ভোটে সামিল হন না, ‘গণতন্ত্রের পূজা’ করেন না। ভালোমানুষ যখন সঙ্ঘবদ্ধভাবে নীরব থাকেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না, তখনই পেশীশক্তি বুঝে যায়, তারা ফাঁকা মাঠ পেয়েছে, ভোট দুর্নীতি চালাতে পারবে। সবাই ভোটের ময়দানে না নামলে, সকাল সকাল নিজের নিজের ভোটটি দিতে না পারলে পছন্দের দল বা প্রার্থী কখনোই জিততে পারবেন না। আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার আপনাকেই প্রয়োগ করতে হবে। তবে গণতন্ত্রের জয় হবে, তবে গণতন্ত্রের পূজা সম্পন্ন হবে।
নোটা (NOTA বা None of the above)-তে ভোট দেওয়া একটি খারাপ প্রবণতা, নিজের ভোটটি হেলায় বিনষ্ট করা হয়। অনেকসময় অনেক রাজনৈতিক দল অন্য দুষ্ট দলকে জিতিয়ে দেবার জন্য নোটা-তে ভোট প্রয়োগ করার জন্য পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করে। অনেক নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে উত্তম প্রার্থীরা পরাজিত হয়ে গেছেন। সাধারণভাবে অভিজ্ঞতা এই, নোটা-তে ভোট মানেই অযোগ্য এবং নিকৃষ্ট প্রার্থীর জিতে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট স্বীকার করছেন, অথচ নোটা-য় ভোট দিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে সদর্থকতা আনতে পারছেন না, তা কী গণতন্ত্রের পক্ষে সুখকর? এই নঞর্থক ভোট থেকে যথাসম্ভব বিরত হতে হবে এবং অন্যদেরও বিরত করতে হবে।
পরিশেষে বক্তব্যটি দাঁড়ালো এই, সেরা প্রার্থী ও সেরা দল বাছার প্রদত্ত সূত্রগুলি অনুসরণ করে সপরিবারে নিজের গণতান্ত্রিক মত উপস্থাপন করবো, দেশকে বিকশিত করবো এবং পরম বৈভবশালী রাষ্ট্র গঠনে নিজেদের সামিল করবো। ২০২৪-এর ভোট মানেই অমৃতকালের উন্নয়নমূলক সপ্তঋষিকে সামনে আনার ভোট; সার্বিক কল্যাণের জন্য সংহত কর্মকৌশল রচনার মতামত প্রয়োগ।
@ রামব্রহ্ম দেবশর্মা।