আমের চারা তৈরির ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত স্থানীয় জাতের আমের বীজ থেকে প্রস্তুত চারা বা এলাগাছ (Rootstock)-ই ব্যবহার হয়। সাধারণভাবে অবর্ণিত স্থানীয় আমের পরিপুষ্ট, শাঁসবহুল আঁটি ব্যবহার করাটাই রেওয়াজ। ক্যানিং ফ্যাক্টরির সতেজ ও খোসাহীন আঁটি অনেকে ব্যবহার করেন। নার্সারীতে এই এলাগাছগুলিই মুখ্য স্থান দখল করে থাকে। কিন্তু নানান সময়ে দেখা যায়, জোড়কলমে সামঞ্জস্য হয় না (uncompatible)। কখনও পুরোনো বাগানে গিয়ে দেখা যায় কলমে প্রস্তুত গাছের জোড়ের ঠিক নীচে বা উপরের গুঁড়ির বেড় কম অথবা বেশি। এটাই হল অসামঞ্জস্যতা। এরফলে গাছের স্থিতাবস্থাও অনেকসময় নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এলাগাছ পরশাখী (Scion)-র উপর প্রভাব ফেলে। একইভাবে পরশাখীও এলাগাছের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। মাটির নানান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এলাগাছের সহনশীলতা আমচাষকে যথাযোগ্য স্থানে পৌঁছে দিতে পারে। সমস্যাবহুল এলাকায় অর্থকরী আমচাষ সম্ভব হয় এলাগাছ নির্বাচনের মাধ্যমে।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাঙ্গেয় নবগঠিত পলিমাটি অঞ্চলে (New Alluvial Zone of West Bengal) এলাগাছ সম্পর্কিত একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ‘ওলুর’ (Olour) এলাগাছের উপর ‘হিমসাগর’ (Himsagar)-এর পরশাখী চাপালে গাছের বৃদ্ধি খর্বাকৃতি (Dwarf) হয়। নেক্কার (Nekkare)-এর উপর হিমসাগরের সংযোগ সবচাইতে বেশি ফলন (Highest Yield) দেয়। ফলের গুণগত মানও বাড়ে বলে জানা গেছে।
এই পরীক্ষাটি করার জন্য এলাগাছ হিসাবে ছয়টি পলিএমব্রায়োনিক বা বহুভ্রূণধর আমের জাতের বীজ থেকে প্রস্তুত একাধিক চারা নেওয়া হয়েছিল। জাতগুলি হচ্ছে ভিলাইকোলোম্বান (Vellaikolamban), ওলুর (Olour), Peach, Kensington, Mylepelian এবং নেক্কার (Nekkare)। সেই সঙ্গে হিমসাগরের বীজের চারা (Open pollinated Seedling) ও নেওয়া হয়। এই এলাগাছগুলির উপর হিমসাগরের পরশাখী জোড় বেঁধে চারা তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় দশ বছর ধরে গাঙ্গেয় নবগঠিত পলিমাটি এলাকায় গাছগুলির উপর অঙ্গজবৃদ্ধি, ফলন সক্ষমতা এবং গুণগতমানের বিচারপর্ব চলে।
সারা ভারতবর্ষে সাধারণভাবে অবর্ণিত (Undescribed) বা স্থানীয় এলাগাছ ব্যবহার করে জোড়বাঁধা হয়৷ অন্যত্র এটাও দেখা গেছে ভিলাইকলম্বানের মত ভ্রূণ পোষককলা জাত চারা এলাগাছ রূপে ব্যবহার করলে গাছের বিস্তৃতি প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ফেলা যায়। অর্থাৎ সেইসব জায়গায় ভিলাইকলোম্বান এলাগাছ হিসাবে পরিণত গাছকে খর্বাকার দান করে। তবে অনেকসময় এটাও দেখা যাচ্ছে খর্বাকার প্রভাব ১৫-২০ বছরের পর আর থাকছে না। কোনো কোনো জায়গায় ‘তোতাপুরী’ জাতকে এলাগাছ রূপে ব্যবহার করলে আঁটি-পোকার প্রাদুর্ভাব বাড়ে বলে দেখা গেছে।
সাধারণভাবে উঁচু কেয়ারি (Raised Bed) তৈরি করে সেখানে এলাগাছের আমের আঁটি ফেলা হয়। কেয়ারির মাপ হতে পারে ৩ মিটার x ১ মিটার x ১৫ সেন্টিমিটার। আঁটি নিতে হবে এমন যেন তা নীরোগ, স্বাস্থ্যবান হয়, জলে দিলে ডুবে যায় — এমন বীজ। বীজ শোধন করে নিয়ে (প্রতি লিটার জলে চার গ্রাম কপার অক্সিক্লোরাইড মিশিয়ে সেই দ্রবণে) কেয়ারিতে বসাতে হবে। বীজ বসিয়ে তার উপর ছড়িয়ে দিতে হবে জৈবসার মিশ্রিত মাটির একটি পরত। বীজ বোনার পর ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজে অঙ্কুর গজায়। এলাগাছে পেনসিলের মতো পুরু হয়ে কাণ্ডটি পুষ্ট হলে তখন জোড়কলম করে পছন্দের পরশাখী (আগে থেকে প্রস্তুত করে) কেটে এনে জুড়তে হবে৷ সাধারণভাবে আট থেকে দশ মাসের মধ্যেই পেনসিল-পুরু এলাগাছ তৈরি হয়ে যায়। জোড়ার পর দুই-চার মাসের মধ্যে ভালোভাবে জোড়ও লাগে। অর্থাৎ এক জুলাইয়ে আঁটি লাগিয়ে পরের জুলাই মাসের মধ্যে জোড় কলমের চারা রেডি হয়ে যায়। সমস্ত চারাকুশলী এই ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে সঠিক এলাগাছ নির্বাচন করুন।
অধিক জানবার জন্য বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা কেন্দ্র, মণ্ডৌরী (মোহনপুর) কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে (ICAR-AICRP on Fruits, BCKV, Mohanpur)।
কল্যাণ চক্রবর্তী এবং দিলীপ কুমার মিশ্র।