“জীবন তো একটাই। সহযোদ্ধাদের ছেড়ে যাব কীভাবে?“ কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতির প্রস্তাব ফিরিয়ে পরে এই মন্তব্য করলেন সোমা দাস। শ্রদ্ধা কুড়ালেন লড়াকু মেয়েটি।
অভাব নিত্যসঙ্গী। একটা চাকরি খুব দরকার। বীরভূমের নলহাটির আশ্রমপাড়া থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত সোমা দাস নিয়মিত কলকাতায় আসেন। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা এখানে কখনও মেট্রো চ্যানেল, কখনও গাঁধী মূর্তির পাদদেশ, কখনও আবার কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে— নিয়োগ চেয়ে ধর্নায় বসেছেন। চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সেই লড়াইয়ের অন্তরায় হতে পারেনি।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেও দাবি আদায়ের আন্দোলনে সোমাও রাত জাগছেন কলকাতার রাজপথে। এই খবর পৌঁছয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। ঘটনাচক্রে তাঁর এজলাসেই চলছিল এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা। তিনি সোমাকে এক দিন আদালতে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
সেই মতো বুধবার বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে এজলাসে আসেন সোমা। সেখানেই তাঁর নিজের মুখেই সব শোনেন বিচারপতি। তার পর তাঁকে কোনও একটি সরকারি চাকরি করার প্রস্তাব দেন। বিচারপতির প্রস্তাব শোনামাত্রই ফিরিয়ে দেন সোমা। তাঁর জবাব শুনে বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনাকে আদালত মনে রাখবে। আগামী দিনে সরকারি শিক্ষকতার কোনও কাজের সুযোগ এলে, আপনাকে জানানো হবে। ভাল থাকবেন।’’
এই প্রতিবেদককে সোমা জানালেন, বাড়িতে তিনি ছাড়া মা, দীর্ঘদিন ধরে বসা অসুস্থ বাবা, এমএসসি পাশ বেকার ভাই। ২০১৬-তে সোমা বসেন এসএসসি পরীক্ষায়। ’১৮-তে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু হচ্ছে-হবে করেও কিছুতেই চাকরি হল না। ’১৯-এ ধরা পড়ল ক্যান্সার। মুম্বাইয়ে গিয়ে সাড়ে সাত মাস চিকিৎসা চলল। পরে ফের ব্যধির তীব্রতা বাড়ায় আবার যেতে হল মুম্বাই। দুই স্টেজে ১২টা কেমো নিতে হয়েছে। শরীরের ওপর প্রবল ধকল ছাড়াও খরচ হয়ে গিয়েছে ১০ লক্ষ টাকার ওপর। বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম ছাতিনায় কিছু পৈতৃক জমি ছিল। সব বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বছর ২৩ ধরে মা-ই সংসার চালান। আইসিডিএসে কাজ করে যা পান, কষ্টেশিষ্টে চলে।
তা সত্বেও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে বুধবার সোমা বলেননি, ’স্যার একটা কাজ আমার খুব দরকার’। মাথা উঁচু করে বলেন, শিক্ষিকাই হব আমি। অবাক হয়ে সবার শ্রদ্ধা কুড়িয়ে বেড়িয়ে গেলেন হাই কোর্ট থেকে। মনের কত জোর থাকলে এরকম বলা যায় বিচারপতিকে? বাংলায় স্নাতক সোমা সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আমার প্রতি সমব্যথী হয়ে অন্য কোনও দফতরে একটি চাকরি করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার লড়াই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যোগ্যতার লড়াই লড়ছি। চাকরিটা নিলে, হয়তো সবই হত, কিন্তু আমার শিক্ষক হওয়ার যে স্বপ্ন, তা পূরণ হত না। আমি সব হারিয়েছি, এটা হারাতে চাই না। উনি আমাদের হয়ে লড়ছেন, আমাদের লড়াই লড়ছেন। তাই আমি চাকরি নিয়ে সরে যেতে চাই না। চাকরিটা না নিয়ে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে ওঁকে এটাই বোঝাতে চাই, স্যর আমি আপনার পাশে আছি। যদি চাকরি হয়, সবার হবে, একসঙ্গে হবে। আলাদা করে আমি চাকরিটা নিয়ে আমার হকের লড়াই থেকে সরে যেতে চাই না।’’
রোগ সারেনি। স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের দরকার। এতে লাগবে আরও প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা। দূরারোগ্য রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর মধ্যে সোমা শিক্ষকের চাকরি করার স্বপ্ন দেখছেন। এখনও। ভাই-বোন দু’জনেই টিউশনি করে নিজেদের পড়ার খরচের সংস্থান করেছেন। এখন সোমা টিউশন করার সময় সেভাবে পান না।
এত মনের জোর পেলেন কীভাবে? এই প্রতিবেদককে সোমা বুধবার রাতে বলেন, “অসুখই আমাকে লড়াই করতে শিখিয়েছে।“ (ঋণ— অনলাইন আনন্দবাজার)
অশোক সেনগুপ্ত