বাংলাদেশের ভাইবোনেদের এই চরম দুর্দশায় আমাদের কতটা সহণশীল থাকা প্রয়োজন?

বাংলাদেশের হিন্দুনিধনে আশ্চর্যজনক ভাবে চুপ থেকে ভারতের বাঙালী রাজনীতিবিদ, সংবাদমাধ্যম এবং স্বঘোষিত বিদ্ধিজীবীরা গত 75 বছরের মতই যে সহণশীলতা বা TOLARENCE দেখালেন, সেটা কোন কোন বড় গুন বলে বিবেচ্য হতে পরে না l এটা দুর্বলতার লক্ষণ, মেরুদন্ডহীনতার লক্ষণ, সুবিধাবাদের লক্ষণ l তবে, দেশভাগের পর এই প্রথমবার সারা বিশ্বের বাঙালী গর্জে উঠেছে l কুমিল্লা, কলকাতা, ক্যালিফোর্নিয়া, কানাডা সর্বত্র l সম্ভবতঃ হিন্দু বাঙালীদের ইসরায়েল অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুভোটের বড় অংশ এক জায়গায় আসা এর মূল কারণ l  কিন্তু  সনাতনীদের কি চূড়ান্ত সহণশীল থাকার  কোন দায় আছে, যা আমরা এতদিন ছিলাম ? দিল্লি, হায়দ্রাবাদ যদি তাঁদের নির্ভয়াদের দোষীদের মৃত্যুদন্ড দিতে পারে, আমরা কেন এখনো কামদুনি, গেদে বা মধ্যমগ্রামের অপরাধীদের এখনো জামাই আদরে জেলে বসিয়ে বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছি?  সহণশীল তকমা পাওয়ার যোগ্য কে? একমাত্র বলবান, সফল, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, বহুত্ববাদী, উদার মানুষ বা জনগোষ্ঠীই এই পরীক্ষা দেবার জন্য মনোনীত হতে পরে, যেমন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য স্নাতক হতে হয় l দুর্বল, অসফল, একনাকতন্ত্রে বিশ্বাসী কোন মানুষ সহণশীল বলে নিজেকে দাবী করা তো দূরের কথা, এই বিবেচনার যোগ্যও নন তারা l বিরাটপর্বের শেষ দিনে একা পুরো কৌরবকূলকে পরাজিত করার পরেও অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুরুতে যুদ্ধ করতে নিমরাজি ছিলেন l একজন শ্রেষ্ঠ বীর এখানে সবকিছু ছেড়ে ভিক্ষাবৃত্তি করার সংকল্প করেন l একে বলে সহণশীলতা l দুর্বল মানুষ যদি যুদ্ধ করতে ভয় পেয়ে অহিংসার বাণী দেন, তখন তাকে ভীরুতা বলে l আর সেটাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বলার চেষ্টা করেন l অপরদিকে, মহাত্মা গান্ধীকে ভগবৎগীতার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে হিন্দুকে সহণশীল ও অহিংস হতে উপাদেশ দিয়ে গেছেন l আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ l তারা কাউকে আক্রমন করতে যায় নি l কিন্তু 11ই সেপ্টেম্বর 2001 এ যখন তাঁদের উপর আক্রমন হল, তখন আক্রমনকারীকে সে পিষে ফেলে  l ভগবান শ্রীকৃষ্ণ 100 বার ক্ষমা করেন শিশুপালকে, কিন্তু তারপরে তাকে মৃত্যুদন্ড দেন l 

আধুনিক ভারতের জাতির জনক গান্ধীজী ভগবৎগীতার ভুল ব্যাখ্যা করে আমাদের সহণশীলতার মিথ্যা পাঠ দিয়ে গেছেন l গান্ধীজি নিজের জীবনে সহণশীল ছিলেন? কেন উনি ভগৎ সিং, উধম সিং বা সুভাষচন্দ্র বোসের প্রতি সহণশীলতা দেখান নি l রশিদ যখন স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে হত্যা করলো, গান্ধীজি সেই হত্যাকে সমর্থন করে বললেন যে, শ্রদ্ধানন্দ হয়তো এমন কিছু বলেছে যাতে, রসিদের বিশ্বাসে আঘাত লেগেছে l তাই এই হত্যায় কোন অন্যায় নেই l যদি গান্ধীজী সত্য হন এবং গান্ধীবাদী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতই গান্ধীবাদী হন, তবে গান্ধীজীর এই তত্ব অনুসারে সেই সময় তো তাঁদের নাথুরাম গডসেকেও ছেড়ে দেয়া উচিৎ ছিল? কারণ নাথুরামও তো দাবী করেছিলেন যে তাঁর বিশ্বাসে আঘাত করেছেন গান্ধীজি l রশিদ যে অন্যায় করেছেন, সেই অন্যায় নাথুরামও করেছেন l কিন্তু আমাদের জাতির জনকের ভুল মনগড়া দর্শন এঁদের দুজনকেই ন্যায্যতা দান করে l

গান্ধীজীর মৃত্যুর পর দেশবাসী এই INTOLARENCE  শব্দটি প্রায় ভুলতে বসেছিল l 2014 তে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী প্রধানমন্ত্রী হবার পর ভারতের সংবাদমাধ্যম এই শব্দটি আবার কবর খুঁড়ে বের করলেন, যখন ভারত সরকার রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিবদের ইতিহাসের বইয়ের সঙ্গে রমেশ মজুমদার, যদুনাথ সরকারদের লেখা ইতিহাস বই মেলাতে শুরু করেন l কিছু উদাহরণ নেয়া যাক l গত অর্ধশতক আমাদের ইতিহাস, নাটক, সাহিত্য আমাদের শ্রীরামচন্দ্রের ভালবাসাকে অশ্রদ্ধা এবং শাহজাহানের ভালোবাসাকে স্বর্গীয় বলে দাবী করেছে l একবার দুজনের ভালবাসার তুলনা করা যাক l প্রভু শ্রীরাম লঙ্কা যাবার জন্য রামসেতু বানালেন এবং যারা সেই সেতু বানিয়েছিলেন, তাঁদের অযোধ্যায় নিয়ে গিয়ে দিওয়ালি পালন করেন l অপরদিকে যারা তাজমহল বানিয়েছিলেন,  শাহজাহান আঙ্গুল কেটে নেন l 1943 এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণা করেন অমর্ত্য সেন, সিনেমা করেন সত্যজিৎ রায় l কিন্তু দুজনেই বাদ দিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নাম l আর এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় যোগ করতে গেলেই মাথায় লেগে যাবে INTOLERANT তকমা l

দেশভাগের পর, বিশেষ করে গত 44 বছর, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, বাণিজ্য এবং জীবন দর্শনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত অধঃপতনের সম্মুখীন হয়েছে l দুর্বল হয়েছে সংবাদমাধ্যম, মেরুদন্ডহীন হয়েছে সিভিল সোসাইটি আন্দোলন l  এই সর্ববিষয় দুর্বল জনগোষ্ঠী আজ কামদুনি, মধ্যমগ্রাম বা গেদের মত নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ হারিয়েছে এবং সেটাকে তারা TOLERANCE বলে চালানোর চেষ্টা করছে l আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়লে আমি কি সহণশীলতার পরীক্ষা দেব? আমাদের অধিকাংশ দেবদেবীর হতে অস্ত্র আছে, কিন্তু সেটা অন্যেকে লুট করার জন্য নয়, আত্মরক্ষার জন্য l শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কাজয়ের পর একটা কনা সোনাদানা নিয়ে ফেরেন নি l

অথচ বাঙালী কোনদিন ভীরু ছিল না, ধৰ্মভীরু ছিল l আরএসএস, হিন্দু মহাসভা থেকে আরএসপির অনুপ্রেরণা এই বাংলার অনুশীলন সমিতি l সিপাহী বিদ্রোহ থেকে নৌবিদ্রোহ সবক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিল বাঙালী, অথচ আজ কামদুনি থেকে কুমিল্লায় তারা নির্বাক l সংবাদমাধ্যম নির্বাক, সাধারণ মানুষ নির্বাক, স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা নির্বাক l এবং সবক্ষেত্রেই কারণ বিশুদ্ধ অর্থনীতি l আমাদের রাজ্যের শিল্প নেই, কৃষিতে ক্ষেত্রে চলছে নৈরাজ এবং ব্যাবসায় মাৎস্যন্যায় l শিল্প না থাকার ফলে সংবাদমাধ্যম সরকারি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল l একই টাইমস অফ ইন্ডিয়ার চাকরির পাতা বম্বেতে 24 পাতা অথচ কলকাতায় কোন রকমে 4 পাতা l ফলে সরকারের কথা শুনে তাঁদের খবর লিখতে হয় l কৃষিতে নৈরাজ এবং ব্যাবসায় মাৎস্যন্যায় বাঙালীর জীবন ও জীবিকার সুযোগের  সীমাবদ্ধতা সাধারণ মানুষকে আরও রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদনির্ভর করে তুলছে l ফলে, ইচ্ছা থাকলেও প্রতিবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না সাধারণ মানুষের l ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে তালমিলিয়ে সাধারণ মানুষকে অন্যায়কে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে l তাই দিল্লীর মত নির্ভয়া আন্দোলন, বা হায়দ্রাবাদের মত নির্যাতিতার সমর্থনে আন্দোলন আজ আর দেখা যায় না l এমনকি কয়েক দশক আগেও যে বাঙালী বানতলা, বিরাটির অন্যায়ের প্রতিবাদে আকাশবাতাস এক করে দিয়েছিল, আজ বাংলাদেশে এতো বড় ঘটনায় তারা নির্বাক l

আর স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী? জ্যোতি বসু ইংরেজি তুলে দেবার পর মধ্যবিত্ত বাঙালী সন্তানদের ইংরেজী মিডিয়ামে পাঠাতেই বাংলা সাহিত্য, কবিতা, সঙ্গীত, নাটক, থিয়েটার, যাত্রা, সিনেমার পৃষ্ঠাপোষকতা কমতে থাকে এবং বাংলা বিনোদন জগতের নির্ভরতা বাড়তে থাকে বাংলাদেশের বাজারের উপর l বাজার এতটা খারাপ যে, টলিউড ইন্ডাস্ট্রির নায়কদের গড় পাওনা তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রায় একশো ভাগের একভাগ l আর তাই বাংলাদেশীদের খুশি করতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ‘একতরফা দাঙ্গা’ কিম্বা  ‘লাভ জেহাদ’ দেখানো শুরু হয় l মিস্টার এন্ড মিসেস আয়ার, ব্যোমকেশ, বোঝেনা সে বোঝে না, বিসর্জন, গোত্র ইত্যাদি বহু চলচ্চিত্র এই তালিকায় স্থান পেতে পরে l ঠিক এই আর্থিক কারণেই আজ এই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা দিনে তারা আবার নিজেদের TOLERANT হয়ে উঠলেন মুখে কুলুপ এঁটে  l 

আমাদের ইতিহাস কি বলে এই ব্যাপারে?  হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় জানা যায়, গত আড়াই হাজার বছরে গণহত্যায় 140 কোটির উপর মানুষ মারা যায় l গণহত্যার কারণগুলির মধ্যে আছে যুদ্ধ, কৃত্তিমভাবে তৈরি দুর্ভিক্ষ ( 42 এর বাংলার দুর্ভিক্ষ), শাসকের দ্বারা প্রজার হত্যা ( স্তালিন 2.2 কোটি এবং মাও 8 কোটি প্রজার হত্যা করেন)  l এই রিপোর্টে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনা তা হল ভারতবর্ষে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মাত্র তিনবার গণহত্যা হয়েছিল এবং সেক্ষেত্রেও মৃত্যুর সংখ্যা নগন্য l অথচ এদেশে গড়ে  500 -600 রাজা রাজত্ব করতেন l তাদেরও যুদ্ধ হত l কিন্তু দর্শন, তত্ব, ভগবান, রাজত্ব নিয়ে সারা বিশ্বে যখন  এতো বিরোধ, এতো গণহত্যা, তখন পৃথিবীর এই ভূখণ্ডে কিভাবে তার কোন প্রভাব পড়লো না? কারন, এই দেশের শিক্ষা, দীক্ষা, দর্শন ও বৌদ্ধিক ক্ষমতা মানুষকে বিপুল দ্বন্দ্বগুলিকে নিয়ে সুস্থভাবে বেচে থাকার ক্ষমতা দান করে এসেছে l ইতিহাস যদি আমাদের দেশের এই দর্শন বা বৌদ্ধিক ক্ষমতার সন্ধান না দিতে পারে তবে তার প্রয়োজন কি? আমরা কোথায় বাকিদের থেকে আলাদা? কেন আলাদা? ইতিহাস কি কিছু কেচ্ছা, ষড়যন্ত আর হত্যার গল্প? রাম মহান ছিলেন কারণ তিনি তার পিতার আদেশ পালন করেন l আবার প্রহ্লাদও মহান, যিনি তাঁর পিতার আদেশ অমান্য করেন l পতিব্রতা সীতা এবং পতিকে অমান্য করা মীরা দুজনেই আমাদের আরাধ্য l একই পাপের জন্য যুধিষ্টির চার ব্যক্তিকে চার রকম শাস্তি বিধান করেন এবং গুরু কৃপাচার্য সেই সিদ্ধান্ত সমর্থন করলেন l এই দ্বন্দ্ব বৌদ্ধিক ও সূক্ষ্ম l স্থূল বস্তুবাদের নাগপাশে মানুষের সমস্যাগুলিকে কোন নির্দিষ্ট নিয়মে বাধা অসম্ভব l তাই কোন সরলরৈখিক নিয়মে মানুষের জীবনের জটিল দ্বন্দ্বগুলিকে সমাধানের চেষ্টা করেনি আমাদের দেশ l আর এখানেই ভারতবর্ষের অতীত ও ইতিহাস সারা বিশ্ব থেকে আমাদের আলাদা করে দেয় l আর এই ইতিহাস পড়াতে গেলেই আমাদের বলা হচ্ছে INTOLERANT l

আমাদের দেশের জনসংখ্যার থেকে ভগবানের সংখ্যা গত শতাব্দী পর্যন্তও বেশী ছিল l সারা পৃথিবীতে যখন ‘আমার ভগবান তোমার ভগবান’ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলত এবং সেই কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ও হচ্ছে, তখন এদেশের ধৰ্মগুরুরা নাস্তিকতাকেও অধর্ম বলে উড়িয়ে দেন নি l আদি শঙ্করাচার্য, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ সবাই এই দ্বন্দ্ব থেকে সত্য আবিষ্কার করেছেন আর এটাই আমাদের অতীত, এটাই ইতিহাস l তাহলে শুধুমাত্র মধ্যযুগীয় ইতিহাসের কিছু পাতা পড়িয়ে কেন প্রমান করার চেষ্টা হচ্ছে যে, এটাই আমাদের ইতিহাস? ভারতের সঠিক ইতিহাস সিলেবাসে আনতেই হবে, যা রমেশচন্দ্র মজুমদার বা যদুনাথ সরকাররা লিখে গেছেন l আর এই ইতিহাস চর্চা শুরু করলেই আমরা INTOLERANT l সভ্য সমাজ কতটা সহণশীল এবং কতটা অসহিষ্ণু হওয়া উচিৎ, তা আমাদের সনাতনী ভারতীদের থেকে ভালো কেউ জানেনা l কিন্তু সহণশীলতার নামে অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে বিরত থাকা কাপুরুষতা, অসততা, দুর্বলতা l বাঙালী 75 বছর ভাতঘুমের পর এই দুর্বলতা কাটিয়ে জেগে উঠেছে l 

সুদীপ্ত গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.