মামুদের আক্রমণ হইতে লড্ কার্জনের সাম্রাজ্যগর্বোদ্গার-কাল পর্যন্ত যে-কিছু ইতিহাসকথা তাহা ভারতবর্ষের পক্ষে বিচিত্র কুহেলিকা; তাহা স্বদেশ সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টির সহায়তা করে না, দৃষ্টি আবৃত করে মাত্র। তাহা এমন স্থানে কৃত্রিম আলোক ফেলে, যাহাতে আমাদের দেশের দিকটাই আমাদের চোখে অন্ধকার হইয়া যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে নবাবের বিলাসশালার দীপালোকে নর্তকীর মণিভূষণ জ্বলিয়া উঠে, বাদশাহের সুরাপাত্রের রক্তিম ফেনোচ্ছ্বাস উন্মত্ততার জাগররক্ত দীপ্তনেত্রের ন্যায় দেখা দেয়; সেই অন্ধকারে আমাদের প্রাচীন দেবমন্দির-সকল মস্তক আবৃত করে এবং সুলতান-প্রেয়সীদের শ্বেতমর্মররচিত কারুখচিত কবরচূড়া নক্ষত্রলোক চুম্বন করিতে উদ্যত হয়। সেই অন্ধকারের মধ্যে অশ্বের ক্ষুরধ্বনি, হস্তীর বৃংহিত, অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা, সুদূরব্যাপী শিবিরের তরঙ্গিত পাণ্ডুরতা, কিংখাব-আস্তরণের স্বর্ণচ্ছটা, মসজিদের ফেনবুদ্বুদাকার পাষাণমণ্ডপ,
খোজাপ্রহরিরক্ষিত প্রাসাদ-অন্তঃপুরে রহস্যনিকেতনের নিস্তব্ধ মৌন–এ-সমস্তই বিচিত্র শব্দে ও বর্ণে ও ভাবে যে প্রকাণ্ড ইন্দ্রজাল রচনা করে তাহাকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলিয়া লাভ কী? তাহা ভারতবর্ষের পুণ্যমন্ত্রের পুঁথিটিকে একটি অপরূপ আরব্য উপন্যাস দিয়া মুড়িয়া রাখিয়াছে–সেই পুঁথিখানি কেহ খোলে না, সেই আরব্য উপন্যাসেরই প্রত্যেক ছত্র ছেলেরা মুখস্থ করিয়া লয়। তাহার পরে প্রলয়রাত্রে এই মোগলসাম্রাজ্য যখন মুমূর্ষু, তখন শ্মশানস্থলে দূরাগত গৃধ্রগণের পরস্পরের মধ্যে যে-সকল চাতুরী প্রবঞ্চনা হানাহানি পড়িয়া গেল, তাহাও কি ভারতবর্ষের ইতিবৃত্ত?
কবিগুরুর এই প্রশ্ন আজও প্রাসঙ্গিক , বিশ্বকবি যেভাবে ‘স্বদেশ’ কে , মাতৃভূমির ইতিহাস কে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন আমরা কি তা পেরেছি ? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটি আমাদের মর্মে আঘাত করছে।
কবিগুরু যে সময় এই প্রশ্নটি রেখেছিলেন , সেইসময় দেশ পরাধীন ছিল আর খুব স্বাভাবিকভাবেই আসল ‘ভারতবর্ষ’ কে লুকিয়ে রেখে বিদেশী শাসক ইতিহাস রচনা করেছিল কিন্তু স্বাধীনতার পর এই অবস্থার পরিবর্তন হয় নি কেনো ?
দেশের ইতিহাস এমন হবে যা স্বদেশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগস্থাপন করবে , সে দেশীয় সংস্কৃতি কে , তাঁর মহানতা কে দেখতে শিখবে , ভিন্ন দেশের থেকে প্রয়োজন অনুসারে নেওয়ার সময় সে জানবে স্বদেশের কোন বিশেষত্বের জন্য তার কাছেও দেবার সামগ্ৰীর অভাব নেই। কিন্তু ভারতবর্ষে তা হয় নি।
কবিগুরুর কথায়—
“যে-সকল দেশ ভাগ্যবান্ তাহারা চিরন্তন স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজিয়া পায়, বালককালে ইতিহাসই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয়সাধন করাইয়া দেয়। আমাদের ঠিক তাহার উল্টা। দেশের ইতিহাসই আমাদের স্বদেশকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে।”
ভারতবর্ষ প্রায় ৮০০ বছর বিদেশীয় শাসকের অধীনে থেকেছে।ফলে এই ভীনদেশীয়রা ভারতবর্ষের মস্তিষ্ক কে পরাধীন করতে , ‘স্বদেশবোধ’ কে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে ‘ইতিহাস’ কে নিজেদের মনস্তাত্বিক অস্ত্র রূপে প্রয়োগ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের কথায় এই আক্ষেপ শোনা যায়—- “আমরা ভরতবর্ষের আগাছা-পরগাছা নহি; বহুশত শতাব্দীর মধ্য দিয়া আমাদের শতসহস্র শিকড় ভারতবর্ষের মর্মস্থান অধিকার করিয়া আছে। কিন্তু দুরদৃষ্টক্রমে এমন ইতিহাস আমাদিগকে পড়িতে হয় যে, ঠিক সেই কথাটাই আমাদের ছেলেরা ভুলিয়া যায়। মনে হয়, ভারতবর্ষের মধ্যে আমরা যেন কেহই না, আগন্তুকবর্গই যেন সব।”
কিন্তু কবি আশাবাদী।কবি জানতেন বিদেশী শাসকদের বিজয়রথ একদিন থেমে যাবে। কিন্তু ‘ইতিহাস’ এর মাধ্যমে যে মনস্তাত্ত্বিক দাসত্বের সৃষ্টি করা হয়েছে , তার থেকে মুক্ত হতে প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস-চর্চা। তাই কবির আহ্বান…..
“মামুদ ও মহম্মদ ঘোরির বিজয়বার্তার সন তারিখ আমরা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হইয়াছি, এখন যিনি সমস্ত ভারতবর্ষকে সম্মুখে মূর্তিমান করিয়া তুলিবেন অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া সেই ঐতিহাসিককে আমরা আহ্বান করিতেছি।”
পিন্টু সান্যাল