তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী অভেদানন্দ মহারাজ। স্বামীজী তাঁকে সস্নেহে ‘গ্যাঞ্জেস’ নামে সম্বোধন করতেন। শশী মহারাজ সহ রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রাচীন সাধুদের কাছে চিঠিতে নিজের পরিচয়বাচক শব্দবন্ধে লিখতেন, ‘তোমার দাসানুদাস Ganges’. কারণ তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল গঙ্গাধর গঙ্গোপাধ্যায়। মঠে তিনি ‘গঙ্গাধর মহারাজ’ নামে পরিচিত। তাঁর স্থাপিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম শাখাকেন্দ্র সারগাছি-মুর্শিদাবাদের মানুষ পরিব্রাজক সন্ন্যাসীকে ডাকতেন ‘দণ্ডীবাবা’ নামে।
স্বামী গম্ভীরানন্দজী স্বামী অখণ্ডানন্দজীর জীবনীতে লিখছেন, গঙ্গাধর তখন ব্রহ্মচর্যের সমস্ত নিয়ম পালন করেন, তিনবার গঙ্গাস্নান করেন, স্বহস্তে রন্ধন করে একবেলা হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন, মস্তকে তৈলমর্দন করেন না। প্রাণায়াম করতে করতে তাঁর অঙ্গে স্বেদ ও পুলক হয়। গঙ্গায় ডুব দিয়ে তিনি অনেকক্ষণ কুম্ভক করেন।
হরীতকীর প্রশংসাসূচক শ্লোক শুনে তিনি নিজ অন্তরের মলিনতা দূর করতে শ্রীহরি স্মরণ, হরীতকী ভক্ষণ, গায়ত্রী জপ ও গঙ্গাজল পান করতেন —
“হরিং হরীতকীঞ্চৈব গায়ত্রী জাহ্নবীজলম্।
অন্তর্মলবিনাশায় স্মরেদ্ ভক্ষেজপেৎ পিবেৎ।।”
গঙ্গাধর মহারাজের বাল্যকাল কেটেছে আহিরীটোলা পল্লীতে, তা গঙ্গার সন্নিকটে।
গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ‘গঙ্গাবারি ব্রহ্মবারি’। গঙ্গাধর মহারাজ ‘স্মৃতি-কথা’-য় লিখছেন সে কথা। দক্ষিণেশ্বরে সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে কয়েকজন ভক্ত এলেন। তিনি তাদের মাদুর পেতে দিয়ে পঞ্চবটীর দিকে বাহ্যে গেলেন। সেখান থেকে নহবতের কাছের ঘাট দিয়ে গঙ্গায় শৌচ করতে গেছেন৷ তখন ভাঁটার জল অনেক নেমে গেছে। এমন সময় দেখলেন পেছন থেকে ঠাকুর বলছেন, “ওরে আয়, ওরে আয়, গঙ্গাবারি ব্রহ্মবারি — এখানে কি ছোঁচাতে আছে? যা, হাঁসপুকুরে যা।” গঙ্গাধর বললেন, “যদি অন্য জল না পাই?” ঠাকুর বললেন, “যদি অন্য জল না থাকে, তখন ছোঁচাবি।”
গঙ্গাজলে ভোগ রেঁধে মা কালীকে পরিবেশনের পরে যে আর আমিষ-নিরামিষ ভেদ থাকে না, গঙ্গাধরকে শ্রীরামকৃষ্ণ একবার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সে কথা। গঙ্গাধর তখন মালসা পুড়িয়ে হবিষ্যি করেন। একদিন দক্ষিণেশ্বরে ভোগারতির পর তিনি শিষ্যকে মা-কালীর প্রসাদ গ্রহণ করতে বললেন, “যা, গঙ্গাজলে পাক, মা-কালীর প্রসাদ, মহা হবিষ্যি — যা, খেগে যা।” ঠাকুর তাঁকে বিষ্ণুঘরে প্রসাদ নিতে না বলে কালীঘরে পাঠালেন। কালীঘরে মাছ রান্না হয়। মুখ ফিরিয়ে গঙ্গাধর একবার দেখলেন, ঠাকুর দূরে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তাঁর গতি লক্ষ্য করছেন। গঙ্গাধরকে সেদিন কালীর প্রসাদই গ্রহণ করতে হল। ঠাকুর সেদিন তাঁকে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সংযম নিন্দনীয় নয়, কিন্তু আচারের আধিক্যই অন্যায়। তাঁর বুড়োপনার নিন্দা করলেও ঠাকুর জানতেন, গঙ্গাধরের সত্ত্বগুণ বেশি।
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এক ভিখারি পয়সা চাইতে এলে, তিনি গঙ্গাধরকে দিয়ে তাকের উপর রাখা চারটে পয়সা পাঠালেন। পয়সা দিয়ে ফিরলে তিনি গঙ্গাধরকে গঙ্গাজলে হাত ধুইয়ে মা-কালীর পটের সামনে নিয়ে গিয়ে হরিবোল বলিয়ে অনেকবার হাত ঝাড়িয়েছিলেন। একবার গঙ্গাস্নানে গিয়ে দেখেন ঘাটে এক ব্রাহ্মণ খাজাঞ্চির সঙ্গে বৈষয়িক বিষয়ে কথা বলছেন। ব্রাহ্মণ বিদায় নিলে তিনি গঙ্গাধরকে দিয়ে বিষয়ীর স্পর্শযুক্ত স্থান গঙ্গাজলে ধুইয়ে দিয়েছিলেন।
গঙ্গাধর মহারাজ হিমালয়-প্রেমী ছিলেন। হিমালয় ভ্রমণের কথা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সেই ভ্রমণ-সাহিত্যের মধ্যে হিমালয় উদ্ভূত গঙ্গার কথাও স্থান পেয়েছে। তাঁর রচিত একটি গ্রন্থ ‘তিব্বতের পথে হিমালয়’। সেখানে গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গম নিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা করেছেন মহারাজ। “অপরাবিদ্যারূপিণী শ্রীযমুনা যেন পরাবিদ্যারূপিণী ভাগীরথীর সলিলে মিলিতা হইয়াছেন; প্রবৃত্তিরূপা যমুনা আপন লীলা শেষ করিয়া যেন নিবৃত্তিরূপা ভাগীরথীর শান্তিবারিতে নিমগ্না হইয়াছেন।” এ এক দারুণ তত্ত্বকথা!
মৎস্য-পুরাণে প্রয়াগ মাহাত্ম্যে আছে —
“যত্রাস্তি গঙ্গা-যমুনা-প্রমাণং
স তীর্থরাজো জয়তি প্রয়াগঃ।।”
প্রয়াগ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির যুগপৎ লীলাক্ষেত্র। দুই পরস্পরবিরোধী ভাবের চরমোৎকর্ষ এখানে দৃষ্ট হয়৷ প্রয়াগ জীবের ভুক্তি এবং মুক্তিদাতা। প্রয়াগ যেমন প্রবৃত্তিপরায়ণ জীবের পক্ষে কল্পতরু, তেমনই নিবৃত্তিপরায়ণ মুমুক্ষু জীবের পক্ষে মুক্তিদাতা।
প্রয়াগভূমি ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান তীর্থ। প্রয়াগরাজ বিবেক, বৈরাগ্য ও ত্যাগের লীলাভূমি। আবার অনন্ত ঐশ্বর্য ও ভোগের লীলাভূমি। এক ঐশী বৈপরীত্য — যমুনা প্রয়াগের বিচিত্র কূলে নিজের অনন্ত ঐশ্বর্যভাণ্ডার ঢেলে রেখেছেন। আর গঙ্গা মাহাত্ম্য প্রচারে নিবৃত্তির জয় ঘোষিত হয়েছে। আপন আপন কাজ সাধন করে জাহ্নবীসঙ্গিনী হয়ে এই নিবৃত্তি লাভ হয়। গতিদায়িনী ভাগীরথী তাই জীবের মোক্ষদায়িনী।
প্রয়াগের প্রাচীন কীর্তির তুলনা নেই। এই পরম মহাক্ষেত্রে রোপিত বীজ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে মহাবেদান্ত-মহীরুহ যা ভারতকে আচ্ছন্ন করেছে। সুবিশাল অনন্তবিস্তীর্ণ মহাবৃক্ষের সুশীতল ছায়া ত্রিতাপদগ্ধ জীবের আশ্রয় হয়েছে। বেদান্তের মহাবিজয়ের নির্ঘোষ প্রথম প্রয়াগেই বেজে উঠেছে। এখনও প্রয়াগে তীর্থ মাহাত্ম্যের কিছুমাত্র হ্রাস হয় নি।
গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গম-লহরীর মহাশক্তির প্রভাবে আবহমানকাল ধরে বিচিত্র ক্ষেত্রে অসংখ্য লোকহিতকর মহৎকাজ অনুষ্ঠিত হয়। অসংখ্য বিচিত্র ও অলৌকিক কীর্তিসমূহের আধারভূমি পুণ্যধাম এই প্রয়াগ। গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গম হওয়াতেই প্রয়াগভূমির এই বিচিত্রতা, এত শক্তি, এত মহত্ত্ব। গঙ্গা ও যমুনার একত্র সম্মিলনই তার কারণ, এমনটাই উল্লেখ করেছেন গঙ্গাধর মহারাজ। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে তিনি লিখেছেন, “শ্রীভগবানের লীলাসঙ্গিনী যমুনা-দর্শনে যেমন আসন্বমুক্ত পুরুষের হৃদয়েও সেই অনুপমা মধুময়ী ভগবল্লীলারসমাধুরী পান করিবার ইচ্ছা বলবতী হয়, তেমনি অন্তসলিলা ভাগীরথীদর্শনেও জীবের সকল বাসনার নিবৃত্তি হয়।”
একবার হিমালয়ের পথে নিভৃত গঙ্গোত্রীর দিব্যভূমিতে সপ্তাহকাল কাটিয়ে উত্তরকাশীর পথ ধরলেন মহারাজ। সে সময় তিনি ভীষণ উদরাময় রোগে আক্রান্ত হলেন৷ কাউকে বিব্রত না করে মহারাজ গ্রাম থেকে কিছু দূরে ভাগীরথী-তীরে এক প্রশস্ত শিলাকে আশ্রয় করে নীরবে নির্জনে রোগভোগ করতে লাগলেন। তিন দিন পর কিছুটা সুস্থবোধ করলে এক সুন্দর পাহাড়ি যুবক তাঁকে সেই অবস্থায় দেখে আপন কুটিরে নিয়ে গেলেন এবং উপযুক্ত পথ্য পরিবেশন করে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুললেন। এরপরই দেখা যায় তিনি গঙ্গোত্রী থেকে আনা একশিশি গঙ্গাজল টিহরী থেকে ডাকযোগে বরানগর মঠে পাঠাচ্ছেন। তখন গুরুভাই ও সতীর্থেরা জানতে পারলেন তিনি হিমালয়ে আছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৮৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বরানগর মঠ থেকে পরিব্রাজকের বেশে হিমালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।
তথ্যসূত্র: স্বামী অখণ্ডানন্দের রচনা সংকলন। সার্ধ শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ (১৮৬৪-২০১৪), রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, সারগাছি, মুর্শিদাবাদ।
(তথ্য সহায়তা ড. কল্যাণ চক্রবর্তী)
অসীমলাল মুখার্জি এবং অরিত্র ঘোষ দস্তিদার
ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য।