কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা সরকারি হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির দুটি ছাত্রী কুমারী সুনীতি চৌধুরী ও কুমারী শান্তি ঘোষের রিভলবারের গুলিতে নিজের বাড়িতেই নিহত হয়েছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্টিভেন্স ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। শান্তির বয়স তেরো এবং সুনীতির চৌদ্দ হলেও ইংরেজ জজ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন কী ধাতুতে গড়া ওই দুই বালিকা। বিচার চলার সময় একদিন বসার জন্য চেয়ার না থাকায় তাঁরা দুজনেই পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থেকে জজ সাহেবকে বাধ্য করেছিলেন চেয়ার দেওয়ার হুকুম দিতে। অন্য আর একদিন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এস. ডি. ও. নেপাল সেন যখন সাক্ষী দিচ্ছিলেন তখন শান্তি ও সুনীতি একসঙ্গে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন- ‘বিশ্বাসঘাতক! দেশদ্রোহী!’ শেষপর্যন্ত নাবালিকা বলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি হওয়ায় তাঁরা দুঃখ করে বলেছিলেন- “আমাদের খুব আশা ছিল ফাঁসির দড়িটা আমরা নিজেদের হাতেই গলায় পরতে পারব। কিন্তু সে আশা অপূর্ণ রয়ে গেল।”
শান্তি ও সুনীতির যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর [আনন্দবাজার: ২৮/১/৩২]
“গত ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে কুমিল্লার জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্টিভেন্স তাঁহার নিজ বাংলোয় পিস্তলের গুলিতে নিহত হন। পুলিশ এই সম্পর্কে শান্তিসুধা ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী নাম্নী দুইটি বালিকাকে গ্রেফতার করেন। উহারা উভয়েই স্থানীয় ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।
উহাদের বিচারের জন্য কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মি. পিয়ার্সন, বিচারপতি মি. পি. মল্লিক এবং বিচারপতি মি. এস. কে. ঘোষকে লইয়া একটি বিশেষ আদালত গঠিত হয়। গতকল্য বুধবার বিশেষ আদালত এই মামলার রায় প্রদান করেন। বিচারে শান্তি ও সুনীতি উভয়েই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিতা হন। বিচারকগণ আসামীদ্বয়কে স্বেচ্ছায় ও মিলিতভাবে মি. স্টেভেন্সকে হত্যা করিবার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করিয়াছেন।”
১৯১৭ সালের ২২ মে কুমিল্লার এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে সুনীতির জন্ম হয়। ত্রিপুরা জেলার নবীনগর থানার ইব্রাহিমপুর গ্রামের তাঁর পিতৃভূমি। বাবা উমাচরণ চৌধুরী সরকারি চাকরি করতেন। মা সুরসুন্দরীদেবী একজন বিদূষী মহিলা। সুনীতি যখন কুমিল্লার ফৈজন্নেসা গার্লস স্কুলের ছাত্রী তখন তাঁর দুই দাদা বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। বাড়ির এবং জেলার রাজনৈতিক পরিবেশ সুনীতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কুমিল্লার বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের বিপ্লবী জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনী তাঁর মনে খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে বাড়িয়ে তুলেছিল। সুনীতির এক সহপাঠী প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ছিলেন বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলের সভ্য। তিনিই সুনীতিকে ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে যুক্ত করেন। শীঘ্রই সুনীতি দলের উৎসাহী কর্মী হয়ে ওঠেন।
১৯৩১-এর গোড়ার দিকে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত একটি ছাত্র-সমাবেশ কিশোরী ছাত্রীদলের উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। তাদের নিয়ে একটি ‘ছাত্রীসংঘ’ গড়ে ওঠে। সুনীতি ছিলেন সেই ছাত্রী স্বেচ্ছাসেবী দলের অধিনায়িকা। কুমিল্লার কাছাকাছি ময়নামতী পাহাড়ে সুনীতি লাঠি চালানো, ছোরা খেলা, রিভলবার ছোঁড়া প্রভৃতি প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ও তাঁর সহপাঠিনী শান্তি ঘোষ পরস্পরের সহযোগী হয়ে ওঠেন। ক্রমশ তাঁরা বিপ্লবী কাজের শিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। দলের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে, শান্তি ও সুনীতি কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে চরম আঘাত হানবেন। একাজে সাহায্য করবার জন্য বিপ্লবী দলের কিছু কর্মী আত্মগোপন করে থাকলেন।
১৯৩২-এর ১৪ ডিসেম্বর সাঁতারের ক্লাব করার অনুমতি নেওয়ার অছিলায় তাঁরা মি. স্টিভেন্সের বাংলোয় যান এবং মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুলি করেন। সুনীতির প্রথম গুলিতেই স্টিভেন্স মারা যান। কিন্তু শান্তি ও সুনীতি ধরা পড়েন। পুলিশ তাঁদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালায়। এ সত্ত্বেও তাঁদের কাছ থেকে গুপ্ত কথা আদায় করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লা জেলে- সেখান থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। বিচারে তাঁদের কিশোরী বয়সের কথা বিবেচনা করে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
সুনীতির কারাজীবন ছিল এক দীর্ঘ অত্যাচারের কাহিনী। প্রতিহিংসাপ্রবণ বিদেশি সরকার তা যতদূর সম্ভব নিষ্ঠুর ও অসহনীয় করে তুলতে চেয়েছিল। তাঁকে তৃতীয় শ্রেণির কয়েদী করে রাখা হয় এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের থেকে তাঁকে আলাদা করে রাখা হয়। তাঁর দুই দাদাকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়। পুরো পরিবারকে বছরের পর বছর কাটাতে হয় অনাহারে, অর্ধাহারে। অপুষ্টিতে ভুগে যক্ষ্মা রোগে মারা যায় তাঁর ছোট ভাই। এই অসহনীয় অত্যাচার কিন্তু সুনীতির চরিত্রকে করে তোলে ইস্পাতের মতো দৃঢ় কঠিন।
“কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্টিভেন্সকে হত্যার পর সুনীতির পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবার জন্য ইংরেজ সরকার অমানুষিক চক্রান্ত শুরু করে দিলো। সুনীতির বাবা উমাচরণ চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। উমাচরণ চৌধুরীর চার ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। চার ছেলের নাম সুকুমার, শিশির, সুখেন্দু ও সুধীর। সুনীতির মেজদা শিশির চৌধুরী মি. স্টিভেন্স হত্যার দিন গ্রেফতার হন। প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান। কিন্তু তাঁকে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত জেলে বন্দি থাকেন তিনি। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আরো এক বছর গৃহবন্দি রাখা হয় তাঁকে।
সুনীতির পরিবারের ওপর ইংরেজ সরকারের চক্রান্তের এখানেই শেষ নয়। সুনীতির বড়দা সুকুমার চৌধুরীকেও বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে বন্দি করা হয়। দেউলী বন্দিনিবাসে ১৯৩২ সালে থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত বন্দি থাকেন তিনি।
সুনীতির বাবার পেনশন বন্ধ। তার ওপর দু’ছেলে জেলে বন্দি। আয়ের সমস্ত পথ বন্ধ। ইংরেজ সরকার সুনীতির পরিবারকে হাতেও মারছে, ভাতেও মারছে। নিদারুণ দুঃখের দিনে সুনীতির মা সুরসুন্দরী ভাবলেন ছেলে দু’টিকে দু’মুঠো ভাত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা দায়। তাই উমাচরণ আর সুরসুন্দরী পরামর্শ করে শহর ছেড়ে ত্রিপুরা জেলার নবীননগর থানার অন্তর্গত ইব্রাহিমপুরে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। গ্রামে তাঁদের জীবননির্বাহের খরচ কমলো। কিন্তু আয়ের অভাবে তাঁরা দারিদ্রের কালগ্রাস থেকে রেহাই পেলেন না। আর্থিক চাপে ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হলো। আত্মীয়েরা সাহায্যের হাত বাড়ালে পুলিশ তাঁদের ওপর অত্যাচার শুরু করলো।
সুনীতির তৃতীয় ভাই সুখেন্দু চৌধুরী। স্টিভেন্স হত্যার পর পুলিশের অত্যাচার ও উৎপীড়নের শিকার হন তিনি। তাঁর লেখাপড়া বন্ধ। নিয়মিত খাওয়া জুটছে না। সুনীতির পরিবারের দুর্দশা দেখে কুমিল্লার কংগ্রেস নেতা বসন্ত মজুমদার কিছু একটা ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়ে সুখেন্দুকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন।
সুখেন্দুর বয়স তখন মাত্র বারো-তোরো বছর। ভাগ্যের এমনি নির্মম পরিহাস যে কংগ্রেস নেতা বসন্ত মজুমদার পুলিশের উৎপীড়ন এড়াতে তাঁর বাড়ি থেকে সুখেন্দুকে চলে যেতে বাধ্য করেন। সুখেন্দু বস্তিতে ঘর ভাড়া নিলেন। তারপর কলকাতার ফুটপাথে বসে কাটা-কাপড়ের ব্যবসা আরম্ভ করলেন।
জীবনের বন্ধুর পথে চলতে চলতে একদিন কলকাতা করপোরেশনের এক কর্মীর সঙ্গে পরিচয় হলো সুখেন্দুর। ভদ্রলোক সুখেন্দুকে সুনীতি চৌধুরীর ভাই বলে জানতে পেরে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এবং তাঁকে নিজের ছোট মেয়ের শিক্ষক নিযুক্ত করেন। সুখেন্দুর থাকার ব্যবস্থা হলো। তিনি সুখেন্দুকে করপোরেশনের কাজে নিযুক্ত করলেন। কাজটি হলো- কলকাতা শহরের গ্যাসবাতি জ্বালানো আর নেভানো। পরে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে সুখেন্দুর মৃত্যু হয়।”
………………
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা (https://www.facebook.com/pratapcsaha) ধন্যবাদ।