“ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে…” কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা মহাসাগরের সুদূরতম প্রান্ত থেকে আগত ক্ষীণতম শব্দও হয়ত শুনতে পান।
পৃথিবী-সহ সৌর জগতের অন্যান্য গ্রহগুলি যখন সূর্য দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে,বাষ্পাকারে মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করছিল,যখন গ্রহগুলি তাদের নিজস্ব আকার-আকৃতিও নিতে পারে নি,সেই সময়কার ক্রন্দন ধ্বনিও আজ বিজ্ঞানীরা শুনতে পারছেন।প্রাগ্রসর দেশগুলির ব্রম্ভাণ্ড অন্বেষী সংস্থা “ইসরো”, “রসকসমস” , “নাসা” ইত্যাদি সৃষ্টির সেই প্রাগ মুহূর্তের ধ্বনি সংগ্রহ করে বিশ্ববাসীর শ্রবণযোগ্য শব্দে পরিণত করেছে।সাধারণ মানুষ তা শুনছেও।
স্বাভাবিক ভাবে সকলেই জানেন যে,মহাসমুদ্রের বা মহাবিশ্বের সুদূরতম প্রান্তের শব্দ সরাসরি মানব কর্ণে শোনা সম্ভব নয়। মহাসিন্ধুর পরপারের সঙ্গীত কবিরা শুনছেন কল্পনায়।আর মহাবিশ্বের ধ্বনি বিজ্ঞানীরা শুনছেন যান্ত্রিক উপায়ে।শব্দের এই দুই উৎসে উৎপন্ন শব্দ উৎস ও শ্রোতার মধ্যেকার বিশাল দূরত্বের কারণেই সাধারণ ভাবে শোনা সম্ভব নয়।প্রথমত ভৌগোলিক দূরত্বের একটি বিরাট ব্যবধান দুইয়ের মধ্যে বিদ্যমান।দ্বিতীয়ত শব্দের উৎস ও শ্রোতা কাছাকাছি থাকলেও উৎপন্ন সকল শব্দ মানুষ শুনতে পায় না।উৎস থেকে শব্দ বা ধ্বনি তরঙ্গাকারে বায়ু মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।এবং শব্দ গ্রাহক যন্ত্রে সেগুলি শ্রবণ যোগ্য হলে অর্থাৎ মানুষের কর্ণেন্দ্রিয়ের শ্রবণ যোগ্য সেগুলি সাধারণ ভাবে শোনা যায়।কিন্তু সেখানেও বিপত্তি আছে।শব্দের কম্পাঙ্ক যদি সেকেন্ডে কুড়ি থেকে কুড়ি হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে,তবেই সেই শব্দগুলি মানুষ শুনতে পায়।তবে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তা পনের / ষোল হাজার কম্পাঙ্ক পর্যন্ত শুনতে পান।শিশুরা কুড়ি হাজার কম্পাঙ্কের শব্দও শুনতে পায়।অন্যদিকে,শব্দের উৎস থেকে শ্রোতার দূরত্ব,মাধ্যমের ঘনত্ব ইত্যাদির কারণেও শ্রবণের ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়ে থাকে।সাধারণ বায়ু মাধ্যমে উৎস ও শ্রোতার মধ্যেকার দূরত্বের ব্যস্তানুপাতে শব্দের তীব্রতা কমে।অর্থাৎ দূরত্ব বাড়লে শ্রবণের স্পষ্টতা কমবে।

এ তো গেল বস্তু জগতে দূরত্বের বিষয়।শ্রবণের বিষয়।যেখানে ভৌগোলিক দূরত্ব,শারীরিক দূরত্ব,শব্দ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক,মাধ্যমের ঘনত্বের তারতম্য ইত্যাদি জড় বস্তুর একাধিপত্যের নিরঙ্কুশ রাজত্ব এবং সর্বোপরি শ্রবণেন্দ্রিয়ের কার্যক্ষমতা।

এছাড়াও আরেকটি বিষয় এতটাই গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ যে,যা উপরের কারণগুলিকে সরাসরি অস্বীকার করেও যে-কোনো শব্দ শুনতে পায়!অবশ্যই সে-শ্রবণ জড় জগতের শ্রবণ নয়।সেটা পুরোপুরি-ই মনো জগতের বিষয়।এখানে বাহ্যিক দূরত্ব একেবারেই গুরুত্বহীন।দুটি মানুষের দুটি মন যদি পরস্পরকে অনুভব করতে পারে,তবে ভৌগোলিক,শারীরিক,মাধ্যমের ঘনত্ব,বায়ু প্রবাহের অভিমুখ কিছুরই প্রয়োজন হয় না।যত দূরেই দুই ব্যক্তি থাকুক না কেন,একের হৃদয়ের আহ্বান অন্যের হৃদয়ে গিয়ে ঠিক পৌঁছবেই।আবার দু’জন ব্যক্তি যত দীর্ঘ সময় ধরেই পাশাপাশি,কাছাকাছি থাকুক-না কেন , তা সে কর্মস্থলেই হোক বা সংসার জীবনেই হোক হৃদয়ের দূরত্ব না-ঘুছলে কোনো আহ্বানই শোনা যায় না! এ-এক বিচিত্র লীলাখেলা মানব হৃদয়ের!পরস্পরকে উপলব্ধির ক্ষেত্রে হৃদয়ই যেন রাজাধিরাজ ! কেন-না,দুটি মানুষের হৃদয়ের দূরত্ব যেখানে নেই,দুটি হৃদয় যেখানে পরস্পরের প্রতি দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ,বাহ্যিক কোনো দূরত্বই তাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারে না !
এই হৃদয়ের বন্ধন দুই নারী-পুরুষ,পুরুষ-পুরুষ বা নারীতে নারীতে হতে পারে।আবার সমষ্টিগত ভাবেও হতে পারে।হৃদয়গত বিচ্ছিন্নতাও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যেমন হয়ে থাকে,তেমনি সমষ্টিতে সমষ্টিতেও হতে পারে।সমষ্টির সাথে সমষ্টির হৃদয়-বন্ধন মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় উন্নতির সর্বোচ্চ শীর্ষে।এখানে কোনো ধর্মীয়,পেশাগত,জন্মগত সম্প্রদায়ের বাহ্যিক ভেদাভেদ থাকলেও মানসিক কোনো দূরত্ব থাকে না।সকলেই সকলের বিপদে-আপদে,সুখে-দুখে,শান্তি-আনন্দে সহভাগী ও সহমর্মী হয়।ব্যক্তিগত কলুষতা থাকলেও সমষ্টিগত ভাবে,মানসিক ভাবে তারা একই মালায় গ্রন্থিত পুষ্পের মতো!

সমষ্টিগত ভাবে দীর্ঘ দিন পাশাপাশি বাস করেও যারা হৃদয়ের দূরত্ব ঘোচাতে পারেনি,তারা কতটা নিষ্ঠুর-ভয়ঙ্কর হতে পারে–তা প্রতিটি হিন্দুই অনুভব করতে পারে মরমে মরমে।ভারত স্বাধীনের প্রাক মুহূর্তে মুসলিমরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে নেমেছিল হিন্দু নিধনে।লক্ষ লক্ষ হিন্দুর জীবন-সম্পদ-সম্ভ্রম সব লুটেছিল মুসলিমরা।শেষ পর্যন্ত দেশকে খন্ডিত করে আপাতত শান্তি পেয়েছিল হিন্দুরা।আপাতত এই কারণে যে,সেই অত্যাচার এখনও চলেছে হিন্দুর উপরে।তা সে ভারত-বাংলাদেশ বা পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক।
অথচ ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গকে ভঙ্গ করার চক্রান্ত করেছিল ইংরেজ,লাগাতর আন্দোলনের মাধ্যমে তা বানচাল করেছিল হিন্দু-মুসলিম যৌথ ভাবেই।১৯১১-তে বঙ্গকে পুনরায় এক করতে বাধ্য হয় ইংরেজ।এই সময় কালে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ছিল প্রবল প্রতাপশালী।তাদের সাম্রাজ্যে তখন সূর্য অস্ত যেত না।এই ভয়ানক শক্তি নিয়েও বঙ্গকে খন্ডিত করে রাখতে পারে নি।কিন্তু ১৯৪৭ সালে দিব্যি ভারতকে ভেঙে দিল ! যখন ব্রিটিশের “মরণ দশা” ! বলা চলে “মৃত্যু শয্যায়” শায়িত ইংরেজ।সেই ১৯৪৩ থেকে জাপান-জার্মানির মার খেয়ে খেয়ে ইংরেজ সাম্রাজ্যের তখন খোঁড়া অবস্থা!সেই “অন্তর্জলী যাত্রা”-র যাত্রী হয়েও ভারতকে টুকরো করতে পারল ! পারল কারণ,হিন্দু-মুসলিমের মানসিক-হৃদয়িক দূরত্ব তখন প্রকট আকার নিয়েছিল।নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বও মুসলিমদের হৃদয়ের দূরত্ব ঘোচাতে পারেন নি।আজাদ হিন্দ‌্ ফৌজের যারা বিভিন্ন সময়ে শত্রু শিবিরে যোগ দিয়েছে,নেতাজী ও ফৌজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে,তারা বেশির ভাগই মুসলমান।এমনিতেই মুসলিমের সাথে অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের মানসিক-বন্ধন কোনোদিনই আন্তরীক হয় না।

হৃদয়িক নৈকট্য কখন, কাদের মধ্যে,কীভাবে জেগে উঠবে তা “দেবা ন জানন্তি।কুতঃ মনুষ্যাঃ”! এ এক অপার রহস্য।আর হৃদয় সেই “রহস্য নিকেতন”!
শিশুকাল থেকে দুটি ছেলে-মেয়ে এক সাথে বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিও পেরিয়ে গেল।সংসার জীবনের উপান্তে এসে তাদের মধ্যে হয়ত হৃদয়ের দূরত্ব হঠাৎই মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল।দীর্ঘকালের ‘মানসিক খরা” কেটে গিয়ে কোমল বৃত্তির হিমেল হাওয়া বইতে লাগল ! অমনি তারা এক অভিনব আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করল পরস্পরের প্রতি।যা এত দীর্ঘ সময় এক সাথে কাটানো কালে ঘটেনি।যখন দু’জনই কর্মে-সংসারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।মিলনের আর কোনো সম্ভাবনা নেই।কিন্তু মিলিত হতে না-পারলে কোনো সংসারেই সুখ নেই।শান্তি উধাও! এমনও ঘটে যে, বিদ্যালয় জীবনে ক্ষণিকের জন্য হৃদয়ের টান হয়ত সামান্য অনুভূত হয়েছিল।তার পর নানা চাপে কিশোর মন আর এগোতে পারেনি।পরস্পরের আর কথাও হয় নি ভয়ে।সুদীর্ঘ দশকের পর দশক পেরিয়ে এসে অকস্মাৎই যোগাযোগ স্থাপিত হল দুজনের।সময়-সামাজিক-ভৌগোলিক-অর্থনৈতিক কোনোরূপ দূরত্বই টিকল না! এক হৃদয়ের দূরত্ব কমে যেতেই সব দূরত্ব দূরে পালিয়ে গেল ! মানব জীবনে দূরত্বের এ এক অদ্ভুত খেলা যেন।মানসিক দূরত্ব যতই কমতে থাকে,ততই অন্যান্য দূরত্বের বাধা ভাঙতে থাকে।অন্যান্য দূরত্ব যতই বৃদ্ধি পাক-না কেন,মহাবিশ্বের সুদূরতম প্রান্ত থেকেও যেন দুই হৃদয় পরস্পরের মহা সঙ্গীত শুনতে পারে।পরস্পরের প্রতি এই মানসিক বোধ-নৈকট্য জীবনানন্দের ভাষায় তা যেন “আমাদের অন্তর্গত রক্তের মধ্যে খেলা করে”!আবার জীবনানন্দেরই “আট বছর আগের একদিন” কবিতায় এক যুবক আত্মহত্যা করে।তার মৃতদেহ নিয়ে রাখা হয়েছে “লাশকাটা ঘরে টেবিলের পরে”।কবিতার ভাষ্য অনুসারে যুবকের স্ত্রী-সন্তান ছিল।ছিল আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যও।আত্মহত্যা করার রাতে সে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়েই ঘুমিয়েছিল।স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেমও ছিল গভীর।তারপরও সে আত্মহত্যা করে।এবং লাশকাটা টেবিলের উপর “চিৎ হয়ে ঘুমায়”! এই যুবকের মনের কোনায় কোথাও কোনো বিষয়ে মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়েছিল।যা তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।শেষ পরিণতিও তার কাছে ছিল অপ্রতিরোদ্ধ।

বিভূতিভূষণ তাঁর অতি রোমান্টিক মন নিয়ে অনুভব করেছেন যে, একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনয়নের জন্য অনন্তের কাছে আহ্বান পাঠায় ভাবী পিতা মাতা।তাদের একান্ত আবাহনেই শিশুটি পৃথিবীতে আসে।গর্ভে সন্তান আগমণের প্রথম দিন থেকেই মা তার সাথে এক নিবিড় মানসিক সান্নিধ্য-নৈকট্য অনুভব করতে শুরু করে।যতদিন যায় ততই তা বাড়ে।এই নৈকট্যবোধ একপক্ষীয়।কেন না গর্ভস্থ সন্তানের এই অনুভূতি তখন গড়ে ওঠে না।জন্মের পর স্বাভাবিক মমত্বের মধ্য দিয়েই সব চলতে লাগল।সন্তানের প্রাপ্ত বয়সের সময় কোনো কারণে পিতা মাতার সাথে যদি আদর্শের দ্বন্দ্ব বাধে,উভয় পক্ষই যদি নিজ নিজ আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান হয়,তাহলে হয়ত তা বিচ্ছেদ পর্যন্তও গড়াতে পারে।একই বাড়িতে থেকেও পরস্পরের মুখ দর্শন নাও হতে পারে।এমনকি তারা একে অপরের মৃত্যুও চাইতে পারে।মৃত্যুর পর জীবিত জন মৃতের দিকে ফিরে চাইতে নাও পারে !
শিশুকালে যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন ছিল,সামান্য আদর্শ নিয়ে এত বড় ফাটল তৈরী হল ! মানুষগুলো তো একই ছিল।এখানেও সেই মানসিক দূরত্ব ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছিল।মানসিক দূরত্ব যতই কমে ততই পরস্পরের কাছে নিজেদের মেলে ধরা যায়।অন্যান্য দূরত্ব তখন যতই বাড়ুক না কেন,সবই অর্থহীন।
মানসিক নৈকট্য বোধ শুধু মাত্র মানুষে মানুষে হবে এমনটা নয়।মানুষ পশুর প্রতি,পাখির প্রতি,গাছের প্রতি এমন-কি জড় পদার্থের প্রতিও মানসিক সান্নিধ্য অনুভব করে।পশু-পাখি-উদ্ভিদের জগতেও এই মানসিক বন্ধন বিদ্যমান।পশু-পাখিরাও পরস্পরের প্রতি প্রেমে-আবেগে মুগ্ধ হয়।তারাও সংসার গড়ে।প্রতিপালন করে।বংশধর রেখে যেতে লালায়িত থাকে।তাদের মধ্যেও হৃদয়িক দূরত্ব সক্রিয় ভাবে কাজ করে।তবে মানুষের কোমল বৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ও অন্যান্য প্রাণীদের বহিঃপ্রকাশের মধ্যে রকমফের রয়েছে।এমন-কি মানুষের মধ্যেও দুই যুগল ভিন্ন ভাবে তাদের মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ করে থাকে।
দুই ব্যক্তির মধ্যে হৃদয়-ঘটিত দূরত্ব যত কমতে থাকে,ততই অন্যান্য জাগতিক দূরত্ব গুরুত্ব হারাতে থাকে।হিমালয়ের শীর্ষে বসেও কেউ আল্পসে দাঁড়ানো প্রিয়জনের স্পর্শ অনুভব করতে পারে।
আবার হৃদয়ের দূরত্ব বাড়তে থাকলে,অন্যান্য বন্ধন যত দৃঢ়ই থাকুক না কেন,সেগুলিও শিথিল হতে শুরু করে।আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য-বিলাসী জীবন সব কিছুই পিছনে ফেলে পরস্পরকে ত্যাগ করে যেতে কোনো-ই কষ্ট হয় না।মানসিক দূরত্ব যেখানে বিদ্যমান,স্পর্শের মধ্যে থাকলেও দুটি মন তখন দুই ছায়াপথের দুই নক্ষত্রের মতো নিজেদের ভিতরের আগুনে নিজেরাই জ্বলতে থাকে !

    :: সুজিত চক্রবর্তী ::

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.