লোকমাতা রানী রাসমণির আবির্ভাব দিবসে শ্রদ্ধা। ১৭৯৩ সালে আজকের দিনে (২৮ শে সেপ্টেম্বর) তাঁর জন্ম। এক অব্রাহ্মণ বঙ্গনারী কতটা মানসিক ও ঐশী শক্তি ধারণ করলে আধ্যাত্মিক সংস্কার করতে পারেন, তার খোঁজ আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নেই। রানী ধর্ম আধারিত সংস্কার করেছিলেন বলেই সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি। রানী বিশ্ববাসীর জন্য এক অতুল্য মাতৃ-আরাধনার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন, যেখানে হিন্দু ধর্মের বহুধা বিভক্ত উপাসনা ধারার মধ্যে সমন্বয় করতে এলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেব। —
(১)
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ। কলকাতার জানবাজার নিবাসী কালী উপাসক এবং লোকহিতৈষণার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র লোকমাতা রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৮৪৭ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মনস্থ করেছিলেন সদলবলে নৌকাযোগে হিন্দুতীর্থ কাশীধামে যাবেন। তীর্থযাত্রার ঠিক একদিন আগে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন তিনি; দেবী অন্নপূর্ণা বলছেন, “কাশী যাবার কোনো প্রয়োজন নেই, গঙ্গার তীরে একটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করে সেখানে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো কর। এখানে সেই মূর্তিতেই আমি প্রকট হয়ে সেই পুজো গ্রহণ করবো।” শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে রাসমণি ছিলেন শ্রীজগদম্বার অষ্টনায়িকার একজন। তাঁর আবির্ভাব জগদম্বার পূজা-প্রশস্তির জন্য, মানুষের সেবার জন্য।
রানীর কাশীযাত্রা বাতিল হল। তিনি শীঘ্রই দক্ষিণেশ্বর গ্রামে ‘সাহেবন বাগিচা’ নামে পরিচিত জন হেস্টি নামক এক সাহেবের মালিকানায় থাকা ২০ একরের এক ভূখণ্ড কিনলেন। দক্ষিণেশ্বর তখন এক গণ্ডগ্রাম; আশেপাশে জঙ্গল, কলকাতার জনগণও সে গ্রামটি তেমনভাবে চিনতেন না। কূর্মপৃষ্ঠাকৃতি এই জমি, জল জমে না; সঙ্গে খ্রীষ্টান কুঠিবাড়ি আর গাজীপীরের তলা; কবরডাঙ্গা, কয়েকটি পুকুর, আমবাগান; পাশেই প্রবাহিত পতিতপাবনী গঙ্গা। তান্ত্রিক মতানুযায়ী এই অঞ্চলটি শক্তিপীঠ হিসাবে গড়ে তোলার উপযুক্ত। এখানেই নির্মিত হল হিন্দু-ধর্মসমন্বয়ের পুণ্যক্ষেত্র শ্যাম-শ্যামা-শঙ্করের মন্দির। মোট সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা জমি, কুঠিবাড়ি। রানী কিনলেন ৪২ হাজার ৫০০ টাকায়। ১৮৪৭ সালের ৬ ই সেপ্টেম্বর ‘বিল অফ সেল’-এর মাধ্যমে কেনা হল, তখনও জমির রেজিষ্ট্রেশন আইন চালু ছিল না। কুঠিবাড়িটি কিছুটা সংস্কার করে বাসপোযোগী করা হল। ১৮৬১ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর একদিন আগে মন্দির ও উদ্যানকে রানী দেবোত্তর দলিল করিয়ে গেলেন। মৃত্যুর প্রায় ৬ মাস বাদে ১৮৬১ সালের ২৭ শে আগষ্ট আলিপুরের রেজিস্ট্রি অফিসে আনুষ্ঠানিক নিবন্ধিকৃত হয়।
যে জমি রানী কিনলেন তার উত্তরে ছিল সরকারি বারুদখানা, পূর্বদিকে কাশীনাথ চৌধুরীদের জমি, দক্ষিণদিকে জেমস হেস্টির কারখানা (পরবর্তীকালে যদুনাথ মল্লিকের বাগানবাড়ি) এবং পশ্চিমে গঙ্গা। মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হল ১৮৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। রানী ঠিকাদারি সংস্থা ম্যাকিনটস অ্যান্ড বার্ণ কোম্পানিকে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার চুক্তিতে পোস্তা ও ঘাট তৈরির বরাত দিলেন; তা নিপুণভাবে সম্পন্ন হলে তাদেরকেই মন্দির নির্মাণ-কাজটির বরাত দেন। তারাই প্রস্তুত করেন মন্দিরের নক্সা। কোম্পানি ধীরে ধীরে রাধাকান্ত, ভবতারিণী, বারো শিবের মন্দির এবং নাটমন্দির ছাড়াও গড়ে তোলে দুটি নহবতখানা, চাঁদনি, বিস্তৃত পাকা চকমিলান উঠান, উঠানের উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণ দিকে নানান কাজে ব্যবহারযোগ্য একতলা ঘরের সারি, ভেতরের পুকুরগুলির ঘাট এবং চারপাশের বিস্তৃত প্রাচীর। সমুদয় কাজ শেষ হতে প্রায় আট বছর সময় লেগেছিল; মোট খরচ হয়েছিল আনুমানিক নয় লক্ষ টাকা।
(২)
বড় সংসারের ব্যয়ভার চালানোর জন্য ১৮৪৯-৫০ সাল নাগাদ মধ্যমভ্রাতা রামেশ্বরকে কামারপুকুর গ্রামের সংসারের দায়িত্ব দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় ৪৫ বছর বয়সে কলকাতার ঝামাপুকুর অঞ্চলে এসে সংস্কৃত চতুষ্পাঠী খুলে বসলেন। প্রায় তিন বছর পরিশ্রম করে টোলের প্রচার-প্রসারও করলেন; কিন্তু তবুও টোল থেকে আয় তেমন না হওয়ায়, রামকুমারকে ঝামাপুকুর পল্লীতে কয়েকটি বাড়িতে দৈনন্দিন দেবসেবার কাজ বা যজমানি করতে হল। ১৮৫২-৫৩ সাল নাগাদ রামকুমার তার ১৭ বছরের ভাই গদাধরকে কলকাতায় আনলেন। তারা প্রথমে কিছুদিন শ্যামাপুকুরে নাথের বাগানে উঠলেন, পরে উঠে আসলেন ঝামাপুকুরে। আনুমানিক ১৮৫২-৫৩ সাল থেকে ১৮৫৫-৫৬ সালের মধ্যে গদাধর (পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ) বড়দার সঙ্গে বাস করেছিলেন ঝামাপুকুরে। এই সময়ের মধ্যে তিনি দিগম্বর মিত্রের রাজবাড়িতে ‘শ্রীধর’ নামের নারায়ণ শিলার নিত্যপূজা করেছেন।
এদিকে রানী রাসমণি কৈবর্তবংশীয় হওয়ায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভবতারিণী ও রাধাকান্ত মন্দিরে গোঁড়া ব্রাহ্মণেরা পূজা করতে অসম্মতি জানালে গদাধরের দাদা রামকুমার সেই পূজাকে স্বীকৃতি দিয়ে কর্মগ্রহণ করলেন। যুবক গদাধর প্রথমে তা মেনে নেন নি, পরে দাদার ক্রমাগত প্রচেষ্টায় গদাধরের চিন্তার পরিবর্তন ঘটল এবং তিনি প্রথমে রাধাকান্ত ও পরে শক্তিসাধনায় দীক্ষিত হয়ে (দীক্ষাগুরু প্রবীণ শক্তিসাধক কেনারাম ভট্টাচার্য) ভবতারিণী মন্দিরের পূজকের পদ গ্রহণ করলেন। শূদ্রের মন্দিরে ব্রাহ্মণ গদাধর চট্টোপাধ্যায় — এক নতুন যুগের সূচনা হল।
(৩)
১৮৫৫ থেকে ১৮৮৫ এই ৩০ বছর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে অতিবাহিত করেছেন, যদিও মাঝে কিছুসময় তিনি কাটিয়েছেন কামারপুকুরে। এর প্রতিটি আনাচেকানাচে শ্রীরামকৃষ্ণের পবিত্র পদস্পর্শ; স্নান করেছেন পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গানদীর চাঁদনী ঘাটে। গঙ্গানদীতে নৌকা ভাসিয়ে এলে দক্ষিণেশ্বরের এই পবিত্র ঘাটের সোপান পেরিয়ে পূর্বমুখে কালীবাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। সেই বিস্তীর্ণ সোপানের পর চাঁদনী, তখন সেখানে থাকতেন মন্দিরের চৌকিদারেরা। পুণ্যস্নানের আশায় এখানেই লোকজন জড়ো হতেন, অপেক্ষমান থাকতেন মন্দিরের পুণ্যার্থী ও অতিথিগণ। এই চাঁদনীটি দ্বাদশ শিব মন্দিরকে দু’টি ভাগে ভাগ করেছে। উত্তরের ছয়টি শিব মন্দির যথাক্রমে যোগেশ্বর, রত্নেশ্বর, জটিলেশ্বর, নকুলেশ্বর, নাগেশ্বর এবং নির্জরেশ্বর। দক্ষিণের ছয়টি মন্দির হল যজ্ঞেশ্বর, জলেশ্বর, জগদীশ্বর, নাদেশ্বর, নন্দীশ্বর এবং নরেশ্বর। শিবরাত্রি, নীলের পুজো, চড়ক পুজো ছাড়াও মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন অর্থাৎ স্নানযাত্রার দিন শিবমন্দিরগুলিতে বিশেষ পুজোর আয়োজন হয়।
পশ্চিমের এই শিব মন্দির ও চাঁদনীর পূর্বে বিস্তীর্ণ পাকা চকমিলান উঠোন, তা ইষ্টক নির্মিত; উঠোনের উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর যথাক্রমে বিষ্ণুমন্দির বা রাধাকান্তের মন্দির, ভবতারিণী কালী মায়ের মন্দির, নাটমন্দির এবং বলিদান-ক্ষেত্র। উঠোনের তিনপাশে একতালা ঘরের সারি, যাকে বলা হয় ‘দালান বাড়ি’ — তা নানান কাজে ব্যবহৃত; কোনোটি ভাড়ার ঘর, কোনোটি রান্নাঘর, কোনটি আবার নৈবেদ্যর ঘর কিংবা ভোগের জন্য বরাদ্দ ঘর, অতিথিশালা, সেই সময়ের দপ্তরখানা বা খাজাঞ্চি-ঘর।
বিষ্ণু মন্দিরের ঘর ও তাতে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ পশ্চিমাস্য। মন্দিরে উঠতে সিঁড়ি, সামনে দালান এবং মন্দিরতল প্রস্তর-নির্মিত। কালী মন্দিরের পূজারী হবার আগে গদাধর চট্টোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ) প্রথমে এই মন্দিরে পূজারীর কাজে নিযুক্ত হন। ১৮৫৫ সালে(১২৬২ বঙ্গাব্দ)-র ভাদ্রমাসে নন্দোৎসবে শয়ন দেবার সময় এই মন্দিরের পূর্ববর্তী পুরোহিতের হাত থেকে পরে মূর্তির পা ভেঙ্গে যায়, ব্রাহ্মণ গদাধর তখন ঐতিহাসিক বিধান দেন, রানীর জানাই-এর পা ভেঙ্গে গেলে যেমন তাকে অচল বলে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে না, বরং যথাবিহিত চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে তাকে সুস্থ করে তোলা হবে, ঠিক তেমনই বিগ্রহের সামান্য একটি অঙ্গ ভেঙ্গে গেলেও তাকে বাতিল করে গঙ্গায় বিসর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি নিজেই বিগ্রহের ভঙ্গুর অংশ নিখুঁত ভাবে জুড়ে দিয়েছিলেন এবং সেই মূর্তিই দীর্ঘদিন ধরে সেখানে পুজো হয়ে আসছিল।
ভবতারিণী মন্দিরটি রাধাকান্ত মন্দিরের দক্ষিণে অবস্থিত,মন্দিরে উচ্চবেদী সোপান এবং মন্দির তল শ্বেতকৃষ্ণমর্মরপ্রস্তারাবৃত। শ্রীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত)-র বিবরণ থেকে উদ্ধৃত করা যাক, “বেদির উপরে রৌপ্যময় সহস্রদল পদ্ম, তাহার উপর শিব, শব হইয়া দক্ষিণদিকে মস্তক — উপর দিকে পা করিয়া পড়িয়া আছেন। শিবের প্রতিকৃতি শ্বেত প্রস্তরনির্মিত। তাঁহার হৃদয়োপরি বারাণসী-চেলিপরিহিতা নানাভরণালঙ্কৃতা, এই সুন্দর ত্রিনয়নী শ্যামাকালীর প্রস্তরময় মূর্তি।….. মন্দির মধ্যে উত্তর-পূর্ব কোণে বিচিত্র শয্যা — মা বিশ্রাম করেন। দেওয়ালের একপার্শ্বে চামর ঝুলিতেছে।…বেদির উপর পদ্মাসনে রূপোর গ্লাসে জল। তলায় সারি সারি ঘটী; তন্মধ্যে শ্যামার পান করিবার জল। পদ্মাসনের উপর পশ্চিমে অষ্টধাতু নির্মিত সিংহ, পূর্বে গোধিকা ও ত্রিশূল। বেদির অগ্নিকোণে শিবা, দক্ষিণে কালো প্রস্তরের বৃষ ও ঈশান কোণে হংস। বেদি উঠিবার সোপানে রৌপ্যময় ক্ষুদ্র সিংহাসনোপরি নারায়ণশিলা; একপার্শ্বে পরমহংসদেবের সন্ন্যাসী হইতে প্রাপ্ত অষ্টধাতু নির্মিত রামলালা নামধারী শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহ মূর্তি ও বাণেশ্বর শিব। আরো অন্যান্য দেবতা আছেন। দেবী প্রতিমা দক্ষিণাস্যা।”
শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর
দ্বাদশ শিব মন্দিরের একেবারে উত্তরে এবং চকমিলান উঠোনের উত্তর প্রান্তের ঘরগুলির একেবারে পশ্চিমের কোণের ঘরটিতে শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের শেষের দিকে ১৪ বছর (১৮৭১-১৮৮৫, তারপর কর্কট রোগের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় অবস্থান করেছিলেন, ১৮৮৬ সালের ১৬ই আগষ্ট তাঁর শরীর যায়) অতিবাহিত করেছিলেন। যদিও তার আগে তিনি থাকতেন কুঠিবাড়ির পশ্চিমের একটি ঘরে, যে ঘর দিয়ে সোজাসুজি বকুলতলার ঘাটে যাওয়া যায়। কুঠিবাড়িতে তিনি অবস্থান করেছেন ১৮৫৫ সাল থেকে ১৮৭০ বা ৭১ সাল পর্যন্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ অবস্থানের ঘরটির পশ্চিমদিকে একটি অর্ধমন্ডলাকার বারান্দা, যেখান দিয়ে পশ্চিমাস্য হয়ে গঙ্গা-দর্শন করা যায়। এই বারান্দা থেকে নেমে এলেই উদ্যানপথ, তারপর পুষ্পোদ্যান, তারও পরে পোস্তা এবং গঙ্গা। ঘরের ঠিক উত্তরে চারকোণা বারান্দা, বারান্দা থেকে নেমে এলে উদ্যানপথ এবং পুনরায় পুষ্পোদ্যান। ১৮৭২ সালের ৫ ই জুন ফলহারিণী কালীপূজার রাতে শ্রীরামকৃষ্ণ এই ঘরেই স্ত্রী সারদাদেবী-কে মাতৃজ্ঞানে ষোড়শী পূজা করেছিলেন।
মা সারদাদেবীর ঘর বা নহবতখানা
মন্দির চত্বরে তৈরি হয়েছিল দুটি নহবতখানা; একটি শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের উত্তরে পথ ও উদ্যান পেরিয়ে এবং অপরটি মন্দির জমির একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। দুটিই গঙ্গার প্রায় কাছাকাছি। নহবত থেকে দেবীর উদ্দেশ্যে ছয় দফায় বেজে উঠত রাগরাগিণী — প্রথমটি প্রভাতে মঙ্গলারতির সময়, দ্বিতীয়টি বেলা ন’টার সময় পূজার প্রারম্ভে, তৃতীয়টি দ্বি-প্রহরে ভোগারতির পর যখন দেবী-কে বিশ্রামে পাঠানো হত, চতুর্থটি বেলা চারটেয় যখন দেবী বিশ্রামান্তে উঠেছেন এবং মুখ ধোবেন এমন বিবেচনা করা হত, পঞ্চমটি সন্ধ্যারতির সময় এবং ষষ্ঠ বা শেষ নহবত বাজত রাত ন’টার সময় যখন দেবীকে শীতলের পর শয়ন দেওয়া হত।
উত্তরের নহবতখানা যার অবস্থান শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের ঠিক উত্তরে, সেইখানেই নিচের তলার একটি অপরিসর ঘরে থাকতেন মা সারদা (১৮৭২ সাল থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে মা সারদা এখানে অবস্থান করেছিলেন)। ঘরটির মাপ একেবারেই ছোটো, অষ্টভুজ, একক দক্ষিণ-দুয়ারি, ঘরের ক্ষেত্রফল প্রায় ৫০ বর্গফুট (দেওয়ালের মধ্যে সর্বাধিক দূরত্ব ৭ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং সর্বনিম্ন দূরত্ব ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি); দরজার পরিমাপ ৪ ফুট ২ ইঞ্চি x ২ ফুট ২ ইঞ্চি। এই ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের মা চন্দ্রামণী দেবীও থাকতেন, ১৮৭৭ সালে তার মৃত্যু হয়। নহবতে সারদা মায়ের সঙ্গে কাটাতেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইঝিও।
পঞ্চবটী
নহবতের পরেই বকুলতলা এবং বকুলতলার ঘাট। এই বকুলতলার কিছুটা উত্তরে বট, অশ্বত্থ, নিম, আমলকী ও বেল – এই পাঁচটি পবিত্র বৃক্ষের সম্নিলনে গঠিত পঞ্চবটী। পুরাতন একটি বট আর অশ্বত্থ গাছ ছিলই, তাতে অসংখ্য কোটর-বিশিষ্ট এবং পাখি ও নানান জীবজন্তুর বাসা; আর এই বৃক্ষ-যুগ্মকে কেন্দ্র করে শ্রীরামকৃষ্ণ বাকি গাছ রোপণ করলেন আর তার গোড়ায় বৃন্দাবনের রজঃ এবং রাধা ও শ্যামকুন্ড থেকে মাটি এনে ছড়িয়ে দিলেন; পবিত্র বৃক্ষ-পঞ্চমের পূর্বদিকে নির্মাণ করালেন ঈশ্বর-সাধনা ও চিন্তনের জন্য একটি পবিত্র – কুটির। পঞ্চবটীর অনতিদূরে শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনার পঞ্চমুণ্ডির আসন। বর্তমানে সেই কুটিরের সংস্কারসাধন করে তৈরি হয়েছে শান্তি-কুটির। পঞ্চবটীর পবিত্র ভূমিখণ্ডে তাঁর অনন্য সাধনা, নিশিযাপন, পরে ভক্তবৃন্দে পরিবৃত হয়ে তাতে অমল পদচারণা — ভক্তবৃন্দের মধ্যে এক অভূতপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করে।
গাজিতলা
মন্দিরের পূর্বদিকে যে পুকুর যাকে বলা হত ‘গাজিপুকুর’, যেখানে রয়েছে মন্দিরের বাসন-মাজার ঘাট, তারই ঈশানকোণে এবং মন্দির চত্বরের সদর ফটক পেরিয়ে পশ্চিমাস্য পথে মন্দির দেউড়ির কিছু আগে বাম পাশে পুরনো অশ্বত্থ-বটের তলায় পীর গাজীসাহেবের আস্তানা ছিল। জমি কেনার পর রাসমণি স্বপ্ন দেখলেন, গাজী সাহেব বলছেন, “আপনি আমার স্থান বাঁধাইয়া দিন, সন্ধ্যাবাতি দিন, দুগ্ধ-সিরনি দিন, মাগো লক্ষ্মীরূপিনী শক্তি, দেবী মা, আমি মুসলমানের গাজিপীর আর হিন্দুরও গাজিপীর, মাগো আমার কাছে জাত নাই, হিন্দু-মুসলনান নাই, সকলেই সমান। মা, আমার আশীর্বাদে শীঘ্র দেবতাদিগেরও দর্শন পাইবেন। আপনি যাহা মনে করিতেছেন, তাহা পূর্ণ হইবে।” রানী স্বপ্ন-বাণী অন্যথা করলেন না; গাজিবাবার বট-অশ্বত্থের গোড়া বাঁধালেন, নিয়োগ করলেন মুসলমান সেবাইত — তার মাইনে, সিধা ও অন্যান্য খরচ মন্দির ট্রাস্ট গ্রহণ করল।
ঝাউতলা ও বেলতলা
পঞ্চবটীর আরও খানিক উত্তরে ছিল সারি সারি চারটি ঝাউগাছ আর তারই খানিক পূর্বদিকে বেলতলা। বেলতলার আসনেও ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের কঠোর সাধনা। ঝাউতলা ও বেলতলার উত্তর সীমায় মন্দির-প্রাচীর, তার উত্তরে সরকারি বারুদঘর।
হাঁসপুকুর
পঞ্চবটীর পূর্বপ্রান্তে ছিল এক পুকুর, যা ‘হাঁসপুকুর’ নামে পরিচিত ছিল। মন্দির চত্বরে অবস্থিত ছিল আস্তাবল ও গোশালা, এদেরই দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে ছিল এই হাঁসপুকুর। আর এই গোশালার পূর্বদিকে ছিল খিড়কির দুয়ারের ফটক, যে পথ দিয়ে দক্ষিণেশ্বরের গাঁয়ের মানুষ মন্দিরে আসতেন আর মন্দির কর্মচারীদের পরিবার গ্রামে যেতেন। গাজিতলা থেকে গোশালার মধ্যে মন্দিরের কুঠিবাড়ি ও হাঁসপুকুরের পূর্বভাগে ছিল এক নান্দনিক কুসুমোদ্যান, ফল-বাগিচা এবং আরও একটি পুকুর।
(৪)
দক্ষিণেশ্বর উদ্যানে ছিল নানান ফুলের সৌকর্য, নহবতের প্রভাতী রাগের মূর্চ্ছনায় শুরু হত পুষ্পচয়নের কাজ। শ্রীম-র বর্ণনায় পাওয়া যায়, “গঙ্গাতীরে পঞ্চবটীর সম্মুখে বিল্ববৃক্ষ ও সৌরভপূর্ণ গুলচী ফুলের গাছ। মল্লিকা, মাধবী ও গুলচী ফুল শ্রীরাম বড় ভালোবাসেন। মাধবীলতা শ্রীবৃন্দাবনধাম হইতে আনিয়া তিনি পুঁতিয়া দিয়াছেন। হাঁসপুকুর ও কুঠির পূর্বদিকে যে ভূমিখণ্ড তন্মধ্যে পুকুরের ধারে চম্পক বৃক্ষ। কিয়দ্দূরে ঝুমকোজবা, গোলাপ ও কাঞ্চনপুষ্প। বেড়ার উপরে অপরাজিতা — নিকটে জুঁই কোথাও বা শেফালিকা। দ্বাদশ মন্দিরের পশ্চিম গায়ে বরাবর শ্বেতকরবী, রক্তকরবী, গোলাপ, জুঁই, বেল। ক্বচিৎ বা ধুস্তুরপুষ্প — মহাদেবের পূজা হইবে। মাঝে মাঝে তুলসী — উচ্চ ইষ্টক নির্মিত মঞ্চের উপর রোপণ করা হইয়াছে। নহবতের দক্ষিণ দিকে বেল, জুঁই, গন্ধরাজ, গোলাপ। বাঁধাঘাটের অনতিদূরে পদ্মকরবী ও কোকিলাক্ষ। পরমহংসদেবের ঘরের পাশে দুই-একটি কৃষ্ণচূড়ার বৃক্ষ ও আশেপাশে বেল, গন্ধরাজ, গোলাপ, মল্লিকা, জবা, শ্বেতকরবী, রক্তকরবী, আবার পঞ্চমুখী জবা, চীন জাতীয় জবা।”
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী