কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে অষ্টমী তিথিতে উৎযাপিত হয় গোষ্ঠাষ্টমী। শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান হলেও, তার শিকড়ে রয়েছে লোকায়তিক সংস্কৃতি, বৃহত্তর লোকচারণা। ভারতের নানান প্রান্তে গো-কেন্দ্রিক যে বহুবিচিত্র লোকানুষ্ঠান উৎযাপিত হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান। সব মিলেমিশেই এক সমন্বিত রূপ পরিগ্রহ করেছে ভারতীয় সংস্কৃতি। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের জনপ্রিয় ‘বাঁদনা পরব’, জঙ্গল মহলের ‘সোহরী’, ওঁরাও-মুণ্ডা-বিরহর-কোরোয়া-অসুর জনজাতির ‘সোহরাই’ প্রভৃতি একই লক্ষ্যে রচিত সাংস্কৃতিক পালপার্বণ। গোষ্ঠাষ্টমী সেই বৃহত্তর বৃত্তেরই অমল সংস্কৃতি, এক অনবদ্য উত্তরাধিকার।
সারা বছর মাঠে মাঠে ফসলের জন্য খেটেছে গাই-বলদ, সম্বৎসর যাদের প্রহার করা হয়েছে, যাদের থেকে পাওয়া গেছে পুষ্টিকর দুধ, গোবর সার, জ্বালানি ঘুঁটে — আজ তাদেরই প্রণাম করার দিন। ধানের পরই যে গো-সম্পদের কদর! গরুকে নিয়েই তাই চিরন্তন ভারতবাসীর চিরকালের উৎসাহ! লোকসাহিত্য থেকে শিষ্টসাহিত্য সর্বত্র তার অনুরণন। লৌকিক ছড়ায় পাই, “ধান ধন বড় ধন/আর ধন গাই।/সোনারূপা কিছু কিছু/আর সব ছাই।”
তো গোষ্ঠাষ্টমীতে শাস্ত্রীয় আচার কি আছে?
“গোষ্ঠাষ্টম্যাং গবাং পূজাং গোগ্রাসং গোপ্রদক্ষিণম্।
গবানুগমনং কুর্য্যাৎ সঠবপাপবিমুক্তয়ে।।”
অর্থাৎ এইদিনে শাস্ত্রীয় মতে গো-পূজন হবে, গোগ্রাসদান হবে বা গরুকে ভালো খাবার পরিবেশিত হবে, গোপ্রদক্ষিণ করে সারা বছরের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হবে এবং গবানুগমন করে তার পশ্চাতে চলে তাকে গোশালায় সযত্নে রাখা হবে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে এতে মহাপুণ্যের অংশীদার হওয়া যায় এবং সর্বপাপ দূর হয়। এদিন আপন গো-সম্পদকে যত্ন করে স্নান করিয়ে, তার গায়ের ময়লা দূর করে, শিঙ ও খুঁড়ে তেল-হলুদ লাগিয়ে, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে দশোপচারে পূজা করতে হয়। আতপ চাল ছড়িয়ে আবাহন করা হয় “এতৎ পাদ্যং ওঁ গবে নমঃ।”
গরুকে কৃতজ্ঞতা জানানোর দিন এটি। ভালো খাইয়ে, আদর করে তার সেবা করার দিন। উপাদেয় খাবারে অবলা প্রাণীটিকে খুশি করার দিন। সবুজ গোখাদ্য পরিবেশন করা হয়, তাতে রকমারি গাছ, আর ঘাস-গোত্রীয় গাছ বাঁশের পাতা, থাকে পাকাকলা, ভেজানো দানাশস্য। এক এক গ্রাস খাবার খাবার দেওয়া হবে। গাভী ও বলদ উভয়েরই তা প্রাপ্য। আর মন্ত্রে বলা হবে —
“ওঁ সৌরভেয্যঃ সর্বহিতা পবিত্রাঃ পুণ্যরাশয়ঃ।
প্রতিগৃহ্নন্তু মে গ্রাসং গাবস্ত্রৈলোক্যমাতরঃ।।”
হিন্দু বিশ্বাস এদিনেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রথম গোচারণে যাওয়া। তাই গো-পালনের মধ্যে, রাখাল হবার মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির এক উচ্চ ধর্ম-দর্শন কাজ করে। রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মান্তর’ কবিতায় লিখছেন —
“যদি পরজন্মে পাই রে হতে
ব্রজের রাখাল বালক
তবে নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে
সুসভ্যতার আলোক।”
এ সেই গ্রাম-ভারত, ননী-ছানার গাঁ, যেখানে ঘরে ঘরে দধি-মন্থ-ধ্বনি ওঠে। মাঠের পথে ধেনু চলে গো-খুর-রেণু উড়িয়ে। আঙিনাতে বধূ দুগ্ধ দোহন করে, ঘাটে গোপাঙ্গনা, কুঞ্জবনে নৃত্যরত ময়ূর। সেই চিরন্তন ব্রজের গোপবালক হতে কে না চায়! সমৃদ্ধ অর্থনীতির প্রতীক গো-কেন্দ্রিক কৃষি। তা ভারত হোক বা ব্রিটেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক সেই সমৃদ্ধ কৃষির সামীপ্যে সান্নিধ্যে যাবেন ব’লেই গো-পূজন করেন, প্রাণী-পালকের পাশে পৌঁছেও যান। পৌঁছানোর চিরন্তন প্রণামমন্ত্র এমনতরো —
“ওঁ নমো গোভ্যঃ শ্রীমতীভ্যঃ সৌরভেয়ীভ্য এব চ।
নমো ব্রহ্মসুতাভ্যশ্চ পবিত্রাভ্যো নমো নমঃ।।”
ছবি: মেটা-ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং শ্রী অরিত্র ঘোষ দস্তিদার।