বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

শেষ থেকেই শুরু করা যাক। আর্কাইভ ঘেঁটে ২৭ মে ১৯২৪, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর দু’দিন পরের তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকার হেডলাইনগুলো দেখছি: ‘বাঙ্গলার নরশার্দ্দূল আশুতোষের মহাপ্রয়াণ’। ‘হাওড়া ষ্টেশন, সহরের রাস্তাঘাট লোকে লোকাকীর্ণ’। ‘সিনেট-গৃহে মর্মস্পর্শী দৃশ্য’। ‘সহরের আফিস-আদালত, দোকানপাট বন্ধ’। ‘শবানুগমে জনসমুদ্র’। মামলার কাজে আশুতোষ পটনা-কলকাতা করছিলেন, সেই পটনাতেই হঠাৎ অসুস্থ এবং ২৫ মে আকস্মিক প্রয়াণ। মৃতদেহ নিয়ে স্পেশ্যাল ট্রেন হাওড়া এল সকাল দশটার একটু পরে, ভিড় থইথই চারদিকে। কাগজের রিপোর্টার হাওড়া পৌঁছে গিয়েছেন সকাল সাতটায়, তখন থেকে শুরু করে বিকেল চারটেয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে ‘বীরবপু’ চন্দনকাঠের চিতায় ওঠা ও ভস্মীভূত হওয়া অবধি মুহূর্তগুলি ধরা আছে মুদ্রিত অক্ষরে। হাওড়া ব্রিজ তখন পন্টুন ব্রিজ, সময়মাফিক খোলে, বন্ধ হয়। সে দিন খবর এল, সেতুর শেকল ছিঁড়ে গিয়েছে, দুটোর আগে ব্রিজ খুলবে না। কলকাতায় দেহ এল জাহাজে। পরে হ্যারিসন রোড ধরে ‘সিনেট হাউস’, কলেজ স্ট্রিট-এসপ্লানেড-হরিশ মুখার্জি রোড হয়ে রসা রোডে আশুতোষের বাড়ি, সেখান থেকে কেওড়াতলা। ২৮ মে ১৯২৪-এর সম্পাদকীয় পাতা জুড়ে প্রয়াণলেখ, পাঁচখানা ছবি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ‘সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, কে টি, সরস্বতী, শাস্ত্রবাচস্পতি, সম্বুদ্ধাগম চক্রবর্ত্তী, এম এ, ডি এল, ডি এস সি, পি এইচ ডি, সি আই ই, সি এস আই, এফ আর এ এস, এফ আর এস ই, এফ আর আই ই ইত্যাদি’র মৃত্যুতে বাঙালি কেমন নড়ে গিয়েছিল।

আজকের বাঙালি কি তাঁকে চেনে? ওঁর স্মরণে কলকাতায় একটা রাস্তা, একটা কলেজ, দুটো হলঘর আর সভাগৃহ… এতেই কি শেষ! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে তাঁর নামাঙ্কিত ভবনে দু’বছর ক্লাস করেছি, সে অর্থে ‘আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’ নামটা নিয়ে উচ্চবাচ্য শুনিনি (তাঁর জন্মের দেড়শো বছরে বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ কলেজও ভাল অনুষ্ঠান করেছে)। এ সেই বিশ্ববিদ্যালয়, যার জন্য মানুষটা কী করেননি! কিন্তু আজকের বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণে কোনও পড়ুয়াকে ‘আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এখানে উপাচার্য ছিলেন?’ শুধোলে পাল্টা ‘ভুল ক্যাম্পাসে এসেছেন, হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট তো আলিপুরে’ ধেয়ে আসতে পারে। অবশ্য কেউ কেউ ছেলেবেলার স্মৃতি চোঁয়ানো এফেক্টে ‘বাংলার বাঘ কে?’র উত্তরে আশুতোষের নাম বলতেও পারেন।

বাঙালি কী ‘হইয়াছেন’ তা তো চোখের সামনে জলজ্যান্ত পরিষ্কার। কী ‘ছিলেন’ তা জানতে চাইলে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন উপেক্ষার তাক থেকে নামিয়ে বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে একটু দেখা যেতে পারে। তাঁর জীবন এমনই এক বৃত্ত, যার পরিধির উপরে থাকা যে কোনও বিন্দুতে আঙুল ঠেকালে যে সম্পদ মেলে, তার মূল্য নির্ধারণ করবে এমন কোনও বান্দা নেই। কিছুটা করতে পারেন ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিকরা। ৭৭, রসা রোডের মুখুজ্যেবাড়ির ছেলে ছোটবেলা থেকে নিজেকে ঘষেপিটে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে পৌঁছতে পারা তো পরের কথা, শুধু ওই ‘হয়ে ওঠার’ ডিসিপ্লিনটুকুর কথা ভাবলেই আমবাঙালি কুলকুল করে ঘামবে। এত ছোটবেলা থেকে যে এত পড়াশোনা করা যায়, পড়াশোনা করলেও মনে রাখা যায়, শুধু মনেই রেখে দেওয়া নয়, বরং কাজেও লাগানো যায় এবং তা এমন কাজে, যা শুধু উনিশ শতক-শেষের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় একটা ধোপদুরস্ত ‘সরকারি’ চাকরি আর নিপাট নিরাপদ জীবনের গন্তব্যে এসেই গোত্তা খেয়ে পড়বে না, নিজের সঙ্গে নিজের জাতি-ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের ভাবনাচিন্তা আর আস্ত জীবনযাপনের ধারার মোড় ঘুরিয়ে দেবে— এ সমস্ত বুঝতে হলে আশুতোষকে জানতে হবেই।

পড়া বই, বই পড়া

১৯০৮ সালে, যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অতুলচন্দ্র ঘটক ছোট্ট একটা বই লিখেছিলেন, ‘আশুতোষের ছাত্রজীবন’। ভূমিকা দীনেশচন্দ্র সেনের। মজার কথা এই— তখন এবং অনেক পরে ১৯২১ সালেও আশুতোষ সেই বই প্রকাশে মত দেননি। প্রথম বার তো বইয়ের পাণ্ডুলিপি সিন্দুকে পুরে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বেরিয়েছিল সেই বই (আশুতোষ-পুত্র উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়), যার পাতায় পাতায় আছে আশুতোষের ‘হয়ে ওঠা’র ইতিহাস। বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন যশস্বী ডাক্তার, কিন্তু এহ বাহ্য। সে কালের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারি ছাত্রদের বাংলায় লেখা বইয়ের অভাব দেখে প্র্যাকটিসের ফাঁকেই লিখেছিলেন বেশ কয়েকটা বই। এই মানুষটাই রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন কবিতায়, আবার সেই তিনিই নিয়ম করে খাতায় লিখে রাখতেন সংসারের পাইপয়সা খরচের হিসেবও! গঙ্গাপ্রসাদের খাতাগুলো ঐতিহাসিক এই কারণেই, তাতে আশুতোষের জন্মতারিখ-দিনক্ষণ থেকে শুরু করে, বড় হতে হতে আশুতোষের জন্য নানান খাতে (বই কেনাই মুখ্য) খরচের হিসেব পাওয়া যায়। উইকিপিডিয়াতে তো বটেই, আশুতোষ-পুত্র শ্যামাপ্রসাদের লেখাতেও আশুতোষের জন্মতারিখ লেখা ২৯ জুন। গঙ্গাপ্রসাদের খাতায় কিন্তু লেখা: ‘Birth day of Ashoo: 28th June 1864 at 4am’, পরে স্পষ্টতর ব্যাখ্যা: ‘২৮ জুনের (মঙ্গলবার) প্রত্যুষে ৪টার সময়’। নীলমণি মিত্রের পুজোদালানে বসত চক্রবেড়িয়া শিশু শিক্ষালয়, বছর পাঁচের আশুতোষকে সেখানে ভর্তি করানো হল। প্রথম দিনই স্কুল থেকে ফিরে ছেলে বলল— ‘আমি স্কুলে যাব না। ও তো স্কুল নয়, যাত্রা!’ শিশু ক’দিন আগেই এক যাত্রার আসরে গিয়েছিল, পুজোদালানে ওই গোত্রেরই চেঁচামেঁচি দেখে বোধহয় ইস্কুলকেও যাত্রাপালা ভেবে থাকবে!

গঙ্গাপ্রসাদ তাঁকে ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস করালেন। বাবার সঙ্গে খানিক বেড়িয়ে এসে পড়তে বসা, আগের দিনের পুরনো পড়া ঝালানো। একটু বড় হয়ে বাড়িতে শিক্ষকের ব্যবস্থা, ছেলে ঘরেই ভাল পড়বে। আশুতোষ নিজে কয়েক বছর ডায়েরি লিখেছেন—প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে। অত বড় মানুষের ডায়েরি, না জানি কী মহানিধি থাকবে ভেবে পড়তে গেলে নিতান্ত নিরাশ হতে পারেন। কোন দিন অমুক বই থেকে তমুক চ্যাপ্টারগুলো পড়েছেন, তার বিবরণ। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কলকাতার এক বইয়ের দোকানে দেখা হয়েছিল কিশোর আশুতোষের। এক কপি ‘রবিনসন ক্রুসো’র পাতায় সই করে, উপহার হিসেবে হাতে তুলে দিয়ে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘মনোযোগ করে পোড়ো।’ আশুতোষ এই নির্দেশের অন্যথা করেননি, সারা জীবনই মন দিয়ে পড়েছেন। কোন দিন কী পড়ছেন, তাঁর ডায়েরি সাক্ষী। সংস্কৃত পড়ছেন, বাঘা বাঘা অঙ্কের, ফিজ়িক্সের বই। ক’দিনে একটা বই শেষ করছেন, সেই হিসেব স্বচ্ছন্দে কষা যেতে পারে। কলেজে কোন সাহেব শিক্ষক কেমন পড়াচ্ছেন, বা পড়াচ্ছেন না (‘অমুক শিক্ষক মোটেই পড়াতে পারেন না’— এমন কথাও বেশ ক’বার), লেখা আছে। কৈশোরে রুগ্‌ণ ছিলেন, ব্যারাকপুরে গঙ্গাতীরে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য পাঠিয়েছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ। সেখান থেকে রোজ চিঠি লিখতেন বাবাকে, তাতেও মূলত ওই পড়াশোনার কথাই। লেখাপড়াই এই ছেলের অবসেশন। স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে (এখনকার ক্লাস এইট-এর সমতুল্য) পড়ার সময়েই তাঁর মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর প্রথম পরিচ্ছেদ কণ্ঠস্থ, যা তখন এফ এ ক্লাসের (ইলেভেন-টুয়েলভ) পাঠ্য! ইংরেজিতে লেখা তিন খণ্ডের ইতিহাস বই বাংলায় আর ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’ বইগুলো তখনই ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন! কলেজে পড়ার সময়ে ফরাসি ভাষায় লেখা একটা জব্বর অঙ্ক বই না পড়লে চলছে না দেখে ফরাসি ভাষাটাই শিখে নিচ্ছেন!

বই পড়ার গায়ে গায়েই থাকবে বই কেনা, আর পরবর্তী জীবনে বই সংগ্রহ। বাবার সঙ্গে কলকাতার বিখ্যাত বইয়ের দোকানগুলোয় তাঁর যাতায়াত শুরু ছোটবেলা থেকেই। গঙ্গাপ্রসাদের খাতায় আশুতোষের বই কেনার হিসেব দেখলে চোখ কপালে উঠবে। ১৮৮০ সালে এনট্রান্স পাশ করছেন আশুতোষ; ১৮৮১ সালে তাঁর জন্য বই কেনার খরচ ৪,৭৬১ টাকা, ১৮৮৯ সালে (যে বছর গঙ্গাপ্রসাদের মৃত্যু) তা বেড়ে ২১,১৬০ টাকা! শুধু কলকাতার বইয়ের দোকানেই নয়, তিনি নিয়মিত যেতেন নিলাম ঘরগুলোয়, কিনতেন পুরনো বই, পুঁথি। দেশের তো বটেই, বিদেশের— জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইৎজ়ারল্যান্ডের— প্রকাশকদের সঙ্গেও রীতিমতো যোগাযোগ ছিল। বাবার মৃত্যুর পরে খাতায় হিসেব রাখতেন আশুতোষ নিজে। বইয়ের পাশাপাশি সেখানে যোগ হয়েছে আলমারি আর শেলফ কেনার খরচও। সারা জীবনে তিনি নাকি পাঁচ লক্ষ টাকারও (সে যুগে) বেশি বইপত্র কিনেছেন! ন্যাশনাল লাইব্রেরির সুবিখ্যাত ‘আশুতোষ কালেকশন’-এ বই ও অন্যান্য পাঠসামগ্রী মিলিয়ে সংখ্যাটা ৮৫ হাজারেরও বেশি। প্রায় ৯০০০ বর্গফুট জায়গায়, ১৩৫০০ ফুটেরও বেশি শেল্‌ফ জুড়ে আছে! কোন বিষয়ের বই নেই! আইন, গণিত, ইংরেজি সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, দর্শনের বিপুল সম্ভার থাকবে বলাই বাহুল্য, আশুতোষ নিজে এই বিষয়গুলি রীতিমতো পড়েছেন। এর পাশেই উজ্জ্বল জীবনীগ্রন্থ, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকার আধুনিক ইতিহাস, স্থাপত্যবিদ্যা, পুরাতত্ত্ব-নৃতত্ত্ব, চিত্রকলার অগুনতি বই! অজস্র মৌলিক চিত্রাবলি, এক ‘ইলাস্ট্রেশন’ সংক্রান্ত ছবি ও লেখাই কত যে খণ্ড তার শেষ নেই! আর ধ্রুপদী সংগ্রাহকদের যেমন ধারা— সে কালের যত ‘লিমিটেড’, ‘প্রেশাস’, ‘ফার্স্ট এডিশন’ আর ‘রেয়ার’ বইয়েরা আলো করে ছিল আশুতোষ-সংগ্রহ। ওক কাঠের প্রচ্ছদে ১৮৪৯ সালের বাইবেল, ১৯০৫-এ প্রকাশিত কোলরিজের ‘রাইম অব দি এনশিয়েন্ট মেরিনার’-এর স্পেশ্যাল ১২৫ কপির একটি, মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো আর গথিক স্ক্রিপ্টে লেখা গ্যেটের ‘ফাউস্ট’… এমন অজস্র মণিমুক্তো! ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘আশুবাবুর সখ্‌ বা বাতিক ছিল পুস্তক ক্রয় ও পাঠ।’ ৭৭ নম্বর বাড়ির তিনতলাটা ছিল লাইব্রেরি। আশুতোষ-পুত্র উমাপ্রসাদের লেখায় আছে সেই বাড়ির বই-যাপনের কথা।

এনট্রান্স পরীক্ষায় সেকেন্ড, এফ এ-তে থার্ড, বি এ পরীক্ষায় ফার্স্ট! ছোটবেলা থেকেই আশুতোষের দুটো ইচ্ছে— সে কালের বিখ্যাত বৃত্তি ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলারশিপ’ পাওয়া, আর হাইকোর্টের জজ হওয়া! দুই-ই পূর্ণ হয়েছিল হইহই করে। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ তখন এক বছর বিজ্ঞানে, এক বছর সাহিত্যে দেওয়া হত। আশুতোষ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বৃত্তি পেয়েছিলেন। পরে মনে হল, সাহিত্য নিয়েই বা পরীক্ষায় বসি না কেন? কর্তৃপক্ষের অনুমতি মেলেনি, নয়তো সেও পেতেন মনে হয়। ইঞ্জিনিয়ার কাকা রাধিকাপ্রসাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ হওয়ার সুবাদে ঘরে আসত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান কাগজপত্র, সভার বিবরণী। আশুতোষ সে সবও পড়তেন! এই পড়া কাজে দিয়েছিল পরে, যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট আর সিন্ডিকেটে ঢুকলেন বা পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়ার ইতিহাস ঢের আগে থেকেই জানা তাঁর! ১৮৮৫ সালে গণিতে, পরের বছর পদার্থবিদ্যায় এম এ হলেন। এমনই ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, গণিতে এম এ হওয়ার পরের বছরেই তিনি এম এ-র এগজ়ামিনার! আগাগোড়া ভাল ফলাফল দেখে শিক্ষা বিভাগের তৎকালীন সাহেব অধিকর্তা আশুতোষকে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরি অফার করেছিলেন। আশুতোষ সটান বললেন, ‘চাকরি করতে পারি, তবে কয়েকটা শর্ত আছে। আমার পদমর্যাদা ও বেতন ইত্যাদি সাহেব শিক্ষকদের সমান হতে হবে, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আমাকে অন্য কোথাও বদলি করা যাবে না, আর সবচেয়ে বড় কথা, গবেষণার সুযোগ ও পরিকাঠামো দিতে হবে।’ তরুণের স্পর্ধা দেখে তো সাহেব হতভম্ব! তদানীন্তন উপাচার্যও ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ!’ আশুতোষ অদ্ভুত একটা জিনিস চাইলেন— ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য করে নিন।’ একুশ বছর বয়সের একটা ছেলে ঢুকতে চায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে, যেখানকার সব সদস্যই কি না আদতে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বা অনুমোদিত! কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি, কিন্তু সেনেট সদস্য হয়েই ছাড়লেন আশুতোষ। পঁচিশ বছর বয়স তখন! তারও পর আছে। আইন পড়লেন, ১৮৮৮ সালে কলকাতা হাইকোর্টের উকিল হলেন, আর তারই বিচারপতি হলেন যখন, তখন তিনি মোটে চল্লিশ! ১৯২৩-এ যখন অবসর নিচ্ছেন, জজিয়াতি জীবনে রায়ের সংখ্যা দু’হাজারের বেশি! উত্তরসূরি, আশুতোষ-পুত্র রমাপ্রসাদের ছেলে চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যর অতুলচন্দ্র গুপ্তের কাছে শুনেছেন, আশুতোষের মতো বিচারপতি তাঁর মতে আর কেউ নন!

বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্ডারি

এই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই দু’দফায় উপাচার্য ছিলেন তিনি। ১৯০৬-এ তাঁকে যখন উপাচার্য করল ব্রিটিশ সরকার, তখন কী সময়ই না গিয়েছে! বঙ্গভঙ্গের বয়স এক বছর। লর্ড কার্জ়নের ইউনিভার্সিটি কমিশন আর ইউনিভার্সিটি অ্যাক্টের তীব্র প্রতিক্রিয়া বাংলার বিদ্বৎসমাজে। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়েছে, ব্রিটিশ বিরোধিতা তুঙ্গে। বাংলার মান্যগণ্য মানুষেরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে গালাগালি দিয়ে বলছেন ‘গোলদিঘির গোলামখানা’, ব্রিটিশদের চাকর তৈরির জায়গা। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার হাতে নেওয়া মানে তো অগ্নিপরীক্ষা! ঘরের লোক আর পরের লোক— দুয়েরই চক্ষুশূল হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু তিনি তো আশুতোষ মুখোপাধ্যায়! শুধু লাগাম হাতে তুলেই নিলেন না, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রথের ঘোড়া ছোটালেন অশান্ত ময়দানে। নিয়মিত ক্লাস, পড়াশোনা, পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। যে প্রতিষ্ঠান ছিল শুধু ইস্কুল-কলেজের পরীক্ষার ভারবাহী কেজো যন্ত্র, তাকে দিলেন দুটো ডানা— উচ্চশিক্ষা আর গবেষণার।

সংস্কার মানে তো আমূল উড়িয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া নয়। একটু ভাঙা তো অনেকটা গড়া। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা দুটোতেই অর্থের প্রয়োজন। তারকনাথ পালিত, রাসবিহারী ঘোষ-সহ বহু বিদ্যোৎসাহী ও অর্থবান মানুষের থেকে দান-অনুদান জোগাড় করলেন আশুতোষ। পাঠ্যসূচি সংস্কার করলেন, স্নাতকোত্তরে খুললেন নতুন নতুন বিষয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ফলিত রসায়ন, প্রাচীন ভারত ও ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো বিষয়ের শুরু তাঁর চেষ্টাতেই। শুধু তো নতুন বিভাগ খুললেই হল না, উপযুক্ত শিক্ষকও চাই। পদার্থবিদ্যায় সি ভি রমন, রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে নিয়ে এলেন পড়াতে। গণেশ প্রসাদ, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, হাসান সুরাবর্দি… কে না ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে এম এ পাশ করার পরেই এম এ ক্লাসে পড়ানোর ভার দিয়েছেন। দর্শনের চেয়ার-অধ্যাপক করে বসিয়ে দিয়েছেন এক দক্ষিণী তরুণকে— নাম সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ! অক্সফোর্ডের অধ্যাপক পল ভিনোগ্রাডফ, বন ইউনিভার্সিটির সংস্কৃতের প্রফেসর হার্মান জেকবি, বিখ্যাত ফরাসি অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি— সবাই এসেছেন আশুতোষের ডাকে সাড়া দিয়ে। সাধে কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মশ্রদ্ধার প্রবর্তন হয়েছে এইখানেই’! সেনেট হলে আইনের ছাত্রদের পরীক্ষা, ও দিকে কলকাতা অশান্ত অসহযোগ আন্দোলনে। সুকুমার সেনের স্মৃতিচারণায় আছে, আশুতোষ পরীক্ষার্থীদের বাড়ি যেতে দিলেন না। রেখে দিলেন হার্ডিঞ্জ হস্টেলে, পাছে ঘরে ফিরলে রাজনৈতিক নেতারা তাদের পরীক্ষা দিতে না দেন! আবার এই ব্রিটিশ সরকারই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত সংস্থার উপরে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করল, আশুতোষ তীব্র ভাষায় তার সমালোচনা করেছেন। এমন দিনও গিয়েছে, এম এ-র শিক্ষকদের মাইনে দেওয়ার টাকা নেই। সরকার টাকা দেবে বলছে, কিন্তু এমন শর্ত জুড়ছে যা দাসখত নেওয়ার নামান্তর। সমাবর্তন-সভায় আশুতোষ বললেন, ‘চাই না টাকা। না খেয়ে থাকব। আমাদের মাস্টারমশাইরা না খেয়ে থাকবেন, তাও দাসত্ব স্বীকার করবেন না। ফ্রিডম ফার্স্ট, ফ্রিডম সেকেন্ড, ফ্রিডম অলওয়েজ়…’ আশুতোষের উচ্চারিত শব্দগুলো আজকের শিক্ষাজগতের মাথারা মন্ত্র করলে উচ্চশিক্ষার ফল ফলত ঢের বেশি।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন গবেষণাকে। সতেরো বছর বয়সে যে ছেলের লেখা কেমব্রিজের গণিত-পত্রিকায় ছাপা হয়, তার গবেষণার মন তো কবেই তৈরি! প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিতে বিখ্যাত সব গণিত গবেষণাপত্রিকা আসত, পড়তেন মন দিয়ে। এম এ পাশের আগেই তাঁর তিনটে পেপার প্রকাশিত। ১৮৮৪-১৯০০, এই ক’বছরের মধ্যে তিনি লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি, রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, এডিনবরা রয়্যাল সোসাইটি, লন্ডন ফিজ়িক্যাল সোসাইটি, প্যারিস ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি, রয়্যাল আইরিশ অ্যাকাডেমি, আমেরিকান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির সভ্য! প্রচুর লিখেছেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল জার্নালে। মহেন্দ্রলাল সরকারের ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এ সাম্মানিক অধ্যাপক পদে পঞ্চাশের উপরে বক্তৃতা দিয়েছেন। ১৯০৮-এ গড়েছেন ক্যালকাটা ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি। তার জার্নালেই পরে বেরিয়েছিল সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহার গবেষণাপত্র! সি ভি রমন আক্ষেপ করেছিলেন, বাংলা আইনজীবী ও বিচারক আশুতোষকে পেয়েছে বটে, কিন্তু হারিয়েছে এক গণিত-নক্ষত্রকে! শুধু গণিত নিয়ে থাকলেই মানুষটা হইচই ফেলে দিত। ১৯০৮ সালেই ইউনিভার্সিটি ল কলেজ, দু’বছর পরে রাজাবাজারে সায়েন্স কলেজের দুয়ার খুলে গিয়েছিল, সৌজন্য স্যর আশুতোষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিছনে লেগে থাকতেন, যাতে তাঁরা গবেষণায় মন দেন। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সম্পাদনার কাজ দীনেশ সেন করেছেন তাঁরই প্রেরণায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আত্মকথায় লিখেছেন, গবেষণা করতেন যে শিক্ষকেরা, আশুতোষ তাঁদের ক্লাস কমিয়ে দিতেন। শিক্ষকদের রক্ষাও করতেন ঈর্ষাপরায়ণ সহকর্মীদের কাছ থেকে। এক বার মর্নিং ওয়াকে দেখা হলে আশুতোষ তরুণ রমেশচন্দ্রকে বলেন, ‘তোমার চাকুরি হওয়াতে বুড়োরা খুব চটেছে।’ ‘বুড়ো’দের বলা কথা যে তিনি বিশ্বাস করেননি, জানিয়ে তাঁকে বলেছেন, ‘খুব সাবধানে এদের সঙ্গে চলবে।’

বাংলার বাঘ, ‘বাংলা’য় বাঘ

বাংলা ভাষা ও স্যর আশুতোষ, এই নিয়েই লেখা যায় বিস্তর। সেনেটের কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ১৮৯১ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে চিঠিতে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন— এফ এ, বি এ, এম এ স্তরে দেশীয় ভাষা ব্যবহার শুরু হোক। সভায় সেই প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি হল, ১১-১৭ ভোটে হেরে প্রস্তাব খারিজ! আশুতোষের, এবং বাংলা ভাষা শুরুর পক্ষে মত দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু। অনেক পরে নিজে উপাচার্য হয়ে ব্রাত্য বাংলা ভাষাকে যোগ্য মর্যাদায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এনেছিলেন আশুতোষ। যোগ্য মর্যাদা মানে? দীনেশচন্দ্র সিংহ দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার প্রাক্কালে ম্যাট্রিকের সিলেবাসে বাংলা বলতে ছিল ‘বেঙ্গলি কম্পোজ়িশন’, নমো নমো করে খানিকটা ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ আর সাধু-চলিত, চলিত-সাধু রূপান্তর, ব্যাকরণের টুকিটাকি। বি এ ক্লাসেও ‘কম্পোজ়িশন’ ছিল, কিন্তু তাতে পড়ুয়ারা পাশ করুক কি ফেল, রেজ়াল্ট আটকাত না! এই জায়গা থেকে আশুতোষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার দীনহীন ভোল পাল্টে দিয়েছিলেন। ছেলে শ্যামাপ্রসাদ ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম এ চালু হলে আশুতোষ তাঁকে বাংলার ছাত্র করে ক্লাসে পাঠিয়েছিলেন! বাংলা নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার নমুনা লিখে গিয়েছেন দীনেশচন্দ্র সেন— ‘চৌদ্দ পনের বৎসর যাবৎ এমএ পরীক্ষায় বাঙ্গলাকে চালাইবার জন্য আমি তাঁহাকে অনুরোধ করিয়া আসিতেছিলাম। তিনি তাঁহার বিরাট গোঁপ ফুলাইয়া গর্জন করিয়া বলিতেন, ‘তোমার বাঙ্গলা আবার একটা ভাষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতম শ্রেণীতে তাহাই পড়াইতে হইবে— শোন কথা!’ …হঠাৎ ৪/৫ বৎসর পূর্বে একদিন আমার ডাক পড়িল। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘দীনেশ বাবু, এইবার এম এ-তে বাঙ্গলা ভাষা চালাইব, সিলেবাস তৈরি করুন…’ আমি বিস্ময়ের সহিত বলিলাম ‘হঠাৎ মত পরিবর্তনের কারণ কি?’ তিনি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন, ‘ঢাল নাই তরোয়াল নাই— যুদ্ধ করতে যাবেন! আপনাকে দিয়া এই ৪/৫ বৎসর যাবৎ যে আমি বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যের ইংরেজি ইতিহাস লিখাইয়াছি, বঙ্গসাহিত্য পরিচয় ও বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাস লিখাইয়াছি… এই বইগুলি না থাকিলে এম এ পরীক্ষার্থীদের কি পড়াইব? আপনারা যতক্ষণ সোরগোল করিয়াছেন, আমি ততক্ষণ জমি তৈরি করিয়াছি।’ সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ কি একেই বলে? আশুতোষের স্মরণসভায় সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘আজ যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি সে জন্য আমরা স্যর আশুতোষের নিকট কৃতজ্ঞ… তিনি বাংলা ভাষাকে সে যুগে ইংরেজির সমান মর্যাদা দেন।’ বাংলা আর সরল বাঙালিয়ানা, দুই-ই ছিল আত্মস্থ। কোর্টের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় ধুতি-চাদর, বাঙালি বেশ ছাড়া অন্য কিছুতে কেউ দেখেনি তাঁকে। মহাবোধি সোসাইটিতে বুদ্ধের পূতাস্থি আসবে; গোটা শহর দেখেছিল ধুতি পরা, খালি গায়ে, খালি পায়ে কলকাতার রাস্তায় হাঁটছেন স্যর আশুতোষ!

ভুতুর বাবা

শুধুই কাজের মানুষ? কাছের মানুষও। ডায়েরিতে প্রবল সিরিয়াস এক তরুণের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় অন্য এক আশুতোষ। ইনি নরম। প্রিয় বন্ধু কলেজে এড়িয়ে যাচ্ছে, কথা বলছে না, ক্লাসের পর অপেক্ষা করছে না দেখে বিচলিত হন, কষ্ট পান, অভিমান করেন। ১৮৮৬-র ১৬ জানুয়ারি যোগমায়া দেবীর সঙ্গে বিয়ের দিন ডায়েরিতে লিখছেন, ‘শুভদৃষ্টির সময়ে এক পলক দেখার মধ্যেই তার সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করলো।’ নতুন বৌ অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি যাবে, তখন কী করে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা যায় তার উপায় ভাবছেন। তার পরের লাইনগুলো— ‘তাকে কয়েক দিন ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে। আমি খুব কম লোককেই ভালবাসতে পারি, কিন্তু একবার বাসলে অত্যন্ত আন্তরিক এবং আবেগপূর্ণভাবেই ভালবাসি।’ এই আশুতোষ ছেলেমেয়েদের চিঠি লেখেন ‘রাণুমা, ভুনুবাবা, ভুতুবাবা, অমলামা’ সম্বোধনে। ছেলেদের বয়ানে ঘরোয়া আশুতোষকে পাওয়া যায় শ্যামাপ্রসাদ-উমাপ্রসাদের লেখায়-সম্পাদনায়।

ক’জন জানেন, সমাজ সময়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বিধবা বড় মেয়ে কমলার আবার বিয়ে দিয়েছিলেন আশুতোষ! জল কম ঘোলা হয়নি। ছোট মেয়ে রমলার বিয়ের সম্বন্ধ এলে পাত্রপক্ষ কমলার প্রসঙ্গ টেনে তাঁকে প্রায়শ্চিত্তের কথা বলেছিল। আশুতোষ উড়িয়ে দিয়েছিলেন সে প্রস্তাব। ‘‘কাজ, কীর্তিতে ভরা ওঁর বিরাট বহিরঙ্গের আলোচনাই সর্বত্র, অন্তরঙ্গ আশুতোষকে জানে না তেমন কেউ,’’ বলছিলেন রিনা ভাদুড়ী। আশুতোষ-কন্যা অমলার মেয়ে এই শহরে আশুতোষ-চর্চা ও গবেষণার ধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে। দাদুকে অবশ্য তিনি পাননি। পেয়েছেন তাঁর বড়দা পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাত বছর বয়স পর্যন্ত। পরে বইও লিখেছেন সেই সুখস্মৃতি নিয়ে। তার পাতায় পাতায় ধরা দেন স্নেহময় আশুতোষ। যিনি ছোট্ট নাতিকে নিয়ে পুরী, কোনার্ক, মধুপুর বেড়াতে যান। হাইকোর্টে নিয়ে যান, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের চেয়ারে বসিয়ে দেন। জজসাহেব, ভাইস চ্যান্সেলর স্যর আশুতোষের দু’চোখে ঝিকমিক করে স্নেহ। বাংলার বাঘ হালুমও করে, তার ভালবাসাও বিলক্ষণ মালুম হয় বইকি!

কৃৃতজ্ঞতা: রিনা ভাদুড়ী
লিখেছেন: শিশির রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.