কয়েকদিন আগেই চলে গেলেন বাংলার বিখ্যাত ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার।
ভবানীপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাওড়া জেলার জগাছা থানার অন্তর্গত দাশনগরের কাছে দক্ষিণ শানপুর গ্রামে ৯ এপ্রিল ১৯৫৩ সালে। তাঁর পিতা নারায়ণচন্দ্র মজুমদার এবং মাতা নিরুপমা দেবী। কবির শৈশব জীবন তাঁর গ্রামেই কেটেছিল। পেশায় ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। কর্মস্থল ছিল হাওড়া জেলার শানপুর গ্রামের কালিতলা প্রথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি এই বিদ্যালয়টিরই প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
প্রধানত ছোটদের উপযোগী মজার মজার ছড়া-কবিতা লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর প্রকাশিত ছড়ার সংখ্যা কুড়ি হাজারেরও বেশি। ছড়া নিয়ে নিরন্তর নানান রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে ভালোবাসতেন। প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: মজার ছড়া, সোনালী ছড়া, কোলকাতা তোর খোল খাতা, হাওড়া-ভরা হরেক ছড়া, ডাইনোছড়া প্রভৃতি। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে শ্রেষ্ঠ ছড়া সমগ্রও।তিনি সত্যজিৎ রায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখেছেন: ছড়ায় ছড়ায় সত্যজিৎ এবং রবীন্দ্রনাথ নইলে অনাথ।
তাঁর বিখ্যাত দুটি ছড়ার নাম: ‘আ-মরি বাংলাভাষা’ ও ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’
‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ ছড়াটি হল:
“ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
‘ইংলিশ’ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা প’ড়ে?
বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?
বেঙ্গলি ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
বাংলা আবার ভাষা নাকি, নেই কোনও ‘চার্ম’ বেঙ্গলিতে
সহজ-সরল এই কথাটা লজ্জা কীসের মেনে নিতে?
ইংলিশ ভেরি ফ্যান্টাসটিক
হিন্দি সুইট সায়েন্টিফিক
বেঙ্গলি ইজ গ্ল্যামারলেস, ওর ‘প্লেস’ এদের পাশে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
বাংলা যেন কেমন-কেমন, খুউব দুর্বল প্যানপ্যানে
শুনলে বেশি গা জ্ব’লে যায়, একঘেয়ে আর ঘ্যানঘ্যানে।
কীসের গরব? কীসের আশা?
আর চলে না বাংলা ভাষা
কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না?
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
ইংলিশ বেশ বোমবাস্টিং শব্দে ঠাসা দারুণ ভাষা
বেঙ্গলি ইজ ডিসগাস্টিং, ডিসগাস্টিং সর্বনাশা।
এই ভাষাতে দিবানিশি
হয় শুধু ভাই ‘পি.এন.পি.সি’
এই ভাষা তাই হলেও দিশি, সবাই ভালোবাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
বাংলা ভাষা নিয়েই নাকি এংলা-প্যাংলা সবাই মুগ্ধ
বাংলা যাদের মাতৃভাষা, বাংলা যাদের মাতৃদুগ্ধ
মায়ের দুধের বড়ই অভাব
কৌটোর দুধ খাওয়াই স্বভাব
ওই দুধে তেজ-তাকত হয় না, বাংলাও তাই হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
বিদেশে কী বাংলা চলে? কেউ বোঝে না বাংলা কথা
বাংলা নিয়ে বড়াই করার চেয়েও ভালো নীরবতা।
আজ ইংলিশ বিশ্বভাষা
বাংলা ফিনিশ, নিঃস্ব আশা
বাংলা নিয়ে আজকাল কেউ সুখের স্বর্গে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
শেক্সপীয়র, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী বা কীটস বা বায়রন
ভাষা ওদের কী বলিষ্ঠ, শক্ত-সবল যেন আয়রন
কাজী নজরুল- রবীন্দ্রনাথ
ওদের কাছে তুচ্ছ নেহাত
মাইকেল হেরে বাংলায় ফেরে, আবেগে-উচছ্বাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।”
বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সম্মানও পেয়েছিলেন। তাঁকে আনন্দ পুরস্কার , সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার , পদ্মশ্রী, সঙ্গীত নাটক আকাশ ভরা সুরজ এবং সাহিত্য আকাডেমি ফেলোশিপ প্রদান করা হয়েছে। এই কবিকে আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না। আমাদের শৈশব তাঁর সাহিত্যের কাছেই নিজেদের খুঁজে পাব এবং পাবে।
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার: সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
জন্ম: ৯ এপ্রিল ১৯৫৩, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ
পরিচয়:
বিখ্যাত বাঙালি ছড়াকার
শিশুদের কাছে ‘ছড়ার দাদা’ নামে পরিচিত
২০ হাজারেরও বেশি ছড়া রচনা করেছেন
প্রারম্ভিক জীবন:
হাওড়ার সানপুরে জন্মগ্রহণ
সানপুর কালীতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা
হাওড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক
হাওড়া গভর্নমেন্ট মাল্টিপারপাস স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর
কর্মজীবন:
সানপুর কালীতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু
হাওড়ার বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা
সাহিত্যকর্ম:
হাওড়া-ভরা হরেক ছড়া
ডাইনোছড়া
কলকাতা তোর খোল খাতা
আ-মরি বাংলা ভাষা
বাংলাটা ঠিক আসে না
ছাগলের কাণ্ড
রঙ বদলের ব্যাপার স্যাপার
বৈশিষ্ট্য:
সহজবোধ্য ভাষা
রসাত্মক
শিক্ষণীয়
বিভিন্ন বিষয়
উদাহরণ:
‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ কবিতায় বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলাকারীদের সমালোচনা
‘ছাগলের কাণ্ড’ ছড়ায় ছাগলের চঞ্চলতা ও দুষ্টুমি
‘রঙ বদলের ব্যাপার স্যাপার’ ছড়ায় প্রকৃতির রঙ বদলের বর্ণনা
পুরস্কার:
সুকুমার রায় শতবার্ষিকী পুরস্কার
আরও অনেক পুরস্কার
অন্যান্য:
‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক
‘শিশু সাহিত্য পরিষদ’-এর সক্রিয় সদস্য
মৃত্যু:
৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
উপসংহার:
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার বাংলা শিশুসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর ছড়া শিশুদের মনে আনন্দ, জ্ঞান এবং ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর রচনা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।